বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হ্যাস বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্ক আরো এগিয়ে নিতে তিনি ঢাকার সঙ্গে একত্রে কাজ করতে আগ্রহী। গত শুক্রবার ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন। আজ সকালে এখানে প্রাপ্ত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রদূত হ্যাস ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস পরিদর্শন করেন, তিনি আশা করছেন নতুন দায়িত্ব গ্রহণের জন্য মার্চের প্রথম দিকে ঢাকায় আসবেন। যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম শহীদুল ইসলাম ও মিশনের অন্যান্য কর্মকর্তা নতুন দূতকে স্বাগত জানান। আলোচনাকালে দুই রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো জোরদার করতে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
তারা বাংলাদেশ-মার্কিন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপনে উভয় পক্ষের বৃহত্তর সম্পৃক্ততা এবং পারস্পরিক লাভজনক কর্মসূচি ও পদক্ষেপ গ্রহনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এর আগে রাষ্ট্রদূত হ্যাস দূতাবাস প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবক্ষ মূর্তিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। রাষ্ট্রদূত হ্যাস রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলারের উত্তরসূরি।
গত মাসে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের র্যাব ও বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সময় সাপেক্ষ এবং জটিল হবে ধারণা করছেন মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সামনে রেখে দেয়া এ বিধি-নিষেধ প্রত্যাহারে বাংলাদেশ সরকারের নানামুখী তৎপরতা চালাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে অবস্থানরত মার্কিন নীতি বিশ্লেষক প্রশান্ত পরমেশ্বরণ বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞা এবং এটি প্রত্যাহারের ব্যাপারটি মার্কিন স্বার্থ এবং ভূরাজনৈতিক জটিল সমীকরণের অংশ হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, “বিধি-নিষেধ আরোপ সহজে হলেও এটি প্রত্যাহার বেশ কঠিন – বিশেষকরে ট্রেজারি যখন সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে মনোনীত করে দেয়।”
“সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা আচরণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অর্থ – এটি মোকাবেলার জন্য নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ লাগবে। এছাড়া আমার সন্দেহ, যেহেতু আরো কিছু দেশের সঙ্গে একসাথে এই নিষেধাজ্ঞা এসেছে, তাই এটি অন্যান্য দেশের সাথে একত্রে পর্যালোচনা করতে হবে। আমি মনে করি এটি হলো বড় চ্যালেঞ্জ,” বলে মি. পরমেশ্বর।
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে লবিস্ট নিয়োগ: মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি পুঁজি করে বাংলাদেশে সরকার বিরোধীরা জনমত গড়ে তুলতে চাইছে। অন্যদিকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে তৎপর হয়েছে সরকার।
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহ্যারের পদক্ষেপ এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ। প্রয়োজনে সেখানে লবিস্ট নিয়োগেরও পরামর্শ দেয়ার খবর বেরিয়েছে। সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক প্রত্যাহার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলেন, “নিশ্চয়ই আমেরিকা সরকারকে কনভিন্স করা হয়েছে। কাজেই যে তথ্যের ভিত্তিতে দিয়েছে সেই তথ্য যতটুকু আছে সেটা কতটুকু সত্য কতটুকু মিথ্যা বা সঠিক কি সঠিক না এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে একটা বক্তব্য যাবে।” “এছাড়া আমেরিকাতে লবিস্ট নিয়োগের একটা কালচার আছে, সেই লবিস্ট নিয়োগ করে আমেরিকান সরকারকে বুঝাতে হবে। আর ব্যক্তিদের ওপরে যে নিষেধাজ্ঞা সেটি প্রত্যাহার চেয়ে আমেরিকা সরকারের কাছে আপীল করতে হবে।” যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন এবং বিরোধীদলের রাজনীতির অনেক সমর্থক ও শুভাকাঙ্খী রয়েছে। উভয় দলের পক্ষে মার্কিন প্রশাসনকে প্রভাবিত করতে লবিস্ট নিয়োগের কথাও শোনা যায়। সরকার বিরোধীরা বক্তব্য দিচ্ছেন এরকম আরো নিষেধাজ্ঞা আসবে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আরোপ কিংবা প্রত্যাহার করতে লবিং কতটা কাজ করছে – সেটি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন যুক্তরাষ্ট্র অবস্থানরত বিশ্লেষক ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারণের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি বলেন, যে আদর্শিক এবং কৌশলগত অবস্থান থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এসেছে সেখানে লবিস্ট নিয়োগ করে বাইডেন প্রশাসনকে প্রভাবিত করা কোনো পক্ষের জন্যই সহজ কাজ হবে না। তাঁর ভাষায়, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আমার যে দীর্ঘ অবজারভেশন সেখানে মনে হয়েছে লবিস্টদের বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্র নীতির সিদ্ধান্ত নেয়নি।”
“বরং লবিস্টদের দ্বারা যে জিনিসটা হয়েছে যে আপনার যে কনসার্নটা এখানকার রাজনীতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থাটা সম্পর্কে একটা ব্রিফ তাদের কাছে যাচ্ছে। এর বাইরে খুব বড়দাগে কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধন হয় বা হবে বলে আমার কাছে কখনোই মনে হয়নি।”
বাংলাদেশের সামনে পথ কী: এদিকে বাংলাদেশে যে ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে সেটি প্রত্যাহারে করণীয় কী হবে – সেটি নিয়েও রয়েছে আগ্রহ। এ অঞ্চলের ভূরাজনীতি এবং বাইডেন প্রশাসনে নীতিগত অবস্থানের দিকটি তুলে ধরে প্রশান্ত পরমেশ্বরণ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা এবং সম্পর্ক উন্নয়নই হবে একটা বড় উপায়। “বহুমুখী পন্থা কাজ করবে। প্রথমত যেহেতু সুনির্দিষ্ট আচরণকে তুলে ধরা হয়েছে, তার সংশোধন বা সামধান করতে হবে। একইভাবে বৃহত্তর কৌশলগত তাৎপর্যটি খতিয়ে দেখতে হবে যে কেন এটি করা হলো।”
তার মতে, ” এশীয় প্রশান্ত অঞ্চলে বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতির অগ্রাধিকার কী – সেখানে বাংলাদেশকে ভূমিকা রাখতে হবে। বিশেষ করে চীনের ব্যাপারে। আঞ্চলিক সহযোগিতা, জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানি খাতে সহযোগিতার মত বহু বিষয় বাইডেন প্রশাসন আলোচনার টেবিলে আছে যা নিয়ে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভূমিকা রাখার ব্যাপার আছে।” অন্যদিকে ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ বলছেন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে এখন দক্ষ কূটনীতিই ভরসা।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছেন, “স্ট্রিকট কোনো রুল নেই যে ঠিক এটা এটা করলে প্রত্যাহার হবে বা এটা হলে প্রত্যাহার হবে না। বিষয়টা অনেকটা সেরকম নয়।” “সুতরাং নির্ভর করছে যে বাংলাদেশ কতটা কূটনৈতিক তৎপরতা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চালাতে পারছে এবং বাংলাদেশ তার অবস্থানে থেকে কতটা নেগোশিয়েট করতে পেরেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সেই কূটনৈতিক তৎপরতার ওপর নির্ভর করছে আগামী দিনে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার ভবিষ্যৎ। মি.আহমেদ বলেন, “আগামী দিনে নিষেধাজ্ঞা কি বলবৎ থাকে না সেটা পরিধি বৃদ্ধি পাবে না কমবে – সেটা পুরোটাই নির্ভর করছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনৈতিক দক্ষতার ওপর।”
নিষেধাজ্ঞার পর কথিত বন্দুকযুদ্ধে কেউ মারা যায়নি: বাংলাদেশে নিষেধাজ্ঞা এসেছে বিশেষ বাহিনী র্যাব এবং এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। দেখা যাচ্ছে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর একমাসে দেশে কেউ বন্দুকযুদ্ধে মরেনি। মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নকেও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ বাস্তবতায় র্যাবের কার্যক্রমে একটা সংস্কারের সুযোগ আছে বলেও মনে করেন সাবেক আইজিপি শহীদুল হক। “সংস্কার করতে হলে বেপরোয়াভাবে যেন কিছু না হয়। সবকিছু কন্ট্রোলের মধ্যে রাখতে হবে।”
তিনি বলেন, “আপনি গুলি করবেন এনকাউন্টার, আপনি বিপদে পড়েছেন, দুস্কৃতিকারীরা আপনাকে হামলা করছে সেক্ষেত্রে ব্রাশ ফায়ার করে মানুষ মারতে থাকলেতো হবে না। আপনাকে বাঁচানোর জন্য যতটুকু করার দরকার অতটুকুই করতে হবে। এই সংস্কারটা আনতে হবে।” যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বাংলাদেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে। অবিলম্বে এ সমস্যার সমাধানে সরকারের চেষ্টা থাকলেও সেটি কীভাবে সম্ভবপর হবে – সেদিকে এখন দৃষ্টি সবার।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা হলে, জনগণ ভোটাধিকার ফিরে পেলে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক উন্নয়ন হবে খুব শিগগিরই।