সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৩২ অপরাহ্ন

খরার ঝুঁকিতে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চল

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট অ্যান্ড ডিজাস্টার রিস্ক অ্যাটলাস’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন দুটি খ-ে গত বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের খরাপ্রবণ জেলাগুলোয় মোট জমি রয়েছে প্রায় ৫৪ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। খরাপ্রবণ এসব এলাকা মূলত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত। এর মধ্যে খরাপ্রবণ জেলা ১৩টি, খরা ও বন্যাপ্রবণ জেলা ছয়টি, খরা ও আকস্মিক বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে তিনটি জেলা। নওগাঁ, রাজশাহী, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, ঠাকুরগাঁও এ ছয়টি জেলা খুবই উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও দুর্যোগ ঝুঁকি চিহ্নিত করা এ প্রতিবেদনের মূল উদ্দেশ্য। পাশাপাশি অবকাঠামো পরিকল্পনা, নকশা ও কৌশল প্রণয়ন, বিপদ প্রশমনে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ মোকাবেলায় একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে এ অ্যাটলাস। এছাড়া কৃষিতে টেকসই জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক উন্নয়ন প্রচার করা, স্টেকহোল্ডারদের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশের পানি সম্পদ খাত জলবায়ু এবং দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবেলায় তাদের নির্দেশনা দেয়াও হবে এর লক্ষ্য।
পৃথিবীর বেশির ভাগ অংশের জলবায়ুর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো খরা। মূলত দীর্ঘ সময় ধরে চলা শুষ্ক আবহাওয়া, অপর্যাপ্ত বৃষ্টি, বৃষ্টিপাতের তুলনায় বাষ্পীভবন ও প্রস্বেদনের পরিমাণ বেশি হলে খরার সৃষ্টি হয়। এতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় দেখা দেয় পানির অভাব। কুয়া, খাল, বিলের মতো নিত্যব্যবহার্য পানির আধার শুকিয়ে যায়। গত কয়েক দশকের মধ্যে বাংলাদেশ ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালে সবচেয়ে বড় খরা মোকাবেলা করেছে। খরার কারণে সে সময় দেশের প্রায় ৪২ শতাংশ জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর ১৯৯৭ সালে খরার কারণে কৃষিতে প্রায় ৫০ কোটি ডলারের ক্ষতি মোকাবেলা করতে হয় বাংলাদেশকে। এত বছর পর এসেই প্রাকৃতিক এ দুর্যোগের ঝুঁকি এখনো কমেনি। দেশের প্রায় ২২টি জেলা খরার ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে খুবই উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে ছয় জেলা।
খরার মূল কারণ দেরিতে বৃষ্টি হওয়া কিংবা মৌসুমি বৃষ্টি দ্রুত শেষ হয়ে যাওয়া। এ ধরনের খরা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালে। সে সময় দেশের প্রায় ৪২ শতাংশ আবাদি জমি সরাসরি ক্ষতির শিকার হয়েছিল। যার কারণে চালের উৎপাদন কমে গিয়েছিল প্রায় ২০ লাখ টন। একইভাবে ১৯৯৭ সালে খরার কারণে ১০ লাখ টন ধান ক্ষতির শিকার হয়। যার মধ্যে ছয় লাখ টন ছিল রোপা আমন। সব মিলিয়ে কৃষিতে এ ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০ কোটি ডলার। খরার ঝুঁকিতে থাকা উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর, রংপুর, জয়পুরহাট, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এছাড়া খুলনা বিভাগের মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা এবং ঢাকা বিভাগের গাজীপুর জেলাও রয়েছে খরার ঝুঁকিতে। খরার সঙ্গে বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে রাজশাহী, নাটোর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও কুষ্টিয়া। খরার সঙ্গে আকস্মিক বন্যার ঝুঁকিতে থাকা জেলাগুলো হলো বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি। অর্থাৎ খরার পাশাপাশি অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করছে দেশের এ ২২ জেলা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাকৃতিক ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট নানা ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে। খরার পাশাপাশি শুধু ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে তিনটি জেলা, বন্যার ঝুঁকিতে নয়টি, আকস্মিক বন্যা ও ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে ছয়টি, বন্যা ও ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে ছয়টি জেলা। অন্যদিকে লবণাক্ততা ও ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে থাকা জেলার সংখ্যা ১৬টি। বাংলাদেশের একটি বিশাল এলাকাজুড়ে ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা ও মেঘনা নদীর মোহনা। ১৯৯২ ও ১৯৯৮ সালে বন্যার সময় দেশের অর্ধেকেরও বেশি অঞ্চল প্লাবিত হয়। ২০১৭ সালের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ২৪ জেলার তিন লাখ হেক্টরের বেশি জমি। ২০০০-২০১৯ সালের মধ্যে প্রাকৃতিক ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম। ফলে দেখা গেছে, দেশের ৬৪ জেলার প্রতিটিই কোনো না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বের বৃৃহত্তম ব-দ্বীপ হিসেবে বিবেচিত। ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা ও মেঘনা নদী হলো পানির প্রধান নিষ্কাশন ব্যবস্থা। নদীমাতৃক দেশটি উচ্চতর জলবায়ুু এবং আবহাওয়া সম্পর্কিত এবং ভূ-ভৌতিক ও ভূ-সংস্থানের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশের ভূ-সংস্থানকে নি¤œ ও সমতল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। গড় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ছয় মিটারের কম উচ্চতা রয়েছে। বাংলাদেশের ঝুঁকিগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে জলবায়ুু সংক্রান্ত বিপদ ও ঝুঁকিগুলো হলো- বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, শৈত্যপ্রবাহ, লবণাক্ততা ও নদী ক্ষয়। ভূ-ভৌতিক বিপদ ও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ভূমিকম্প ও ভূমিধস। বাংলাদেশের ভূ-তাত্ত্বিক বিন্যাসের কারণে গ্রীষ্মম-লীয় মৌসুমি জলবায়ু বিস্তৃত। বৃষ্টিপাতের ঋতুগত তারতম্য, উচ্চতাপমাত্রা এবং উচ্চআর্দ্রতা, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ এরই মধ্যে বর্ধিত তাপমাত্রার সম্মুখীন হচ্ছে, অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের ধরন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ ত্বরান্বিত হওয়ার কারণে বিপর্যয় আরো তীব্র হচ্ছে।

এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য ভয়ংকর সমস্যা। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ঝুঁকি মোকাবেলা করেই আমরা টিকে আছি। এ ধরনের ঝুঁকি ও দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী নানা ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছেন। আমাদের উন্নয়ন সহযোগীরা নানা ধরনের কার্যক্রম ও সহায়তা করছে। এ বিষয়ে আমরা উন্নত দেশের মতোই কাজ করছি। উপকূলীয় মানুষ, হাওরের মানুষ, খরা অঞ্চলের মানুষ, পিছিয়ে পড়া মানুষ যাতে ভালো থাকে, সে ধরনের কার্যক্রম ও উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিরসনে কার্যকর প্রকল্প আনার জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও মন্ত্রণালয়গুলোকে অনুরোধ করছি। পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প আনার জন্য আমরা উৎসাহিত করছি। সম্মিলিতভাবেই আমরা জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করব।
শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান তথা ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’-কে দেশের সব ধরনের প্রাকৃতিক ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলা এবং উন্নয়নের অন্যতম বৃহৎ মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানান পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ড. শামসুল আলম। তিনি বলেন, এটি বাস্তবায়নে ৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। এরই মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কান্ট্রি ডিরেক্টরের সঙ্গে কথা বলেছেন জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ডেল্টা প্ল্যানকে উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে ধরে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। সেখানে এডিবির বিনিয়োগ বাড়লে এ ধরনের ঝুঁকি ও বিপদগুলো মোকাবেলা করা সহজ হবে। টেকসই উন্নয়নের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা জরুরি। যেহেতু সরকার টেকসই উন্নয়নে নানা ধরনের প্রকল্প হাতে নিচ্ছে, তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায়ও যথাযথভাবে কাজ করা জরুরি।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com