(শেষাংশ, গতকালের পর)
শবেবরাত তথা লাইলাতুন নিসফি মিন শাবানের দুটি দিক আছে। একটি হলো ফজিলত, আরেকটি হলো আমল। শবেবরাতের রাতে আল্লাহ বান্দাদের গোনাহ মাফ করেন এটা সহিহ হাদিস। হাদিসে এসেছে, ‘মধ্য শাবানের রাতে আল্লাহ তার সৃষ্টিকুলের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। তখন শিরকে লিপ্ত ও হিংসা-হিংসিতে লিপ্ত এই দুই শ্রেণীর মানুষ ছাড়া সব বান্দাকে আল্লাহ মাফ করে দেন।’ এটি সহিহ হাদিস। তাহলে আমরা যদি অন্তরটাকে শিরক থেকে মুক্ত করতে পারি, হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা থেকে মুক্ত করতে পারি তবে এ রাতে আমরা মাফ পেয়ে যাব। আমাদের কোনো চিন্তা করা লাগবে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই রাতে আল্লাহ তো মাফ করবেন; এই রাতে আমরা কিছু ইবাদত করব কি না? আসুন তাহলে জানার চেষ্টা করি। মূলত এ রাতে রাসূল সা: কোনো ইবাদত করেছেন কি করেননি এ বিষয়ে সহিহ কোনো বর্ণিত হাদিস পাওয়া যায় না। তবে মোটামুটি আলোচনাযোগ্য একটি দুর্বল হাদিস এ বিষয়ে আছে। আর নিয়ম হলো-কোনো বিষয়ে সহিহ হাদিস না থাকলে সেই বিষয়ের দুর্বল হাদিসের ওপর কেউ যদি আমল করে তাতে নিষেধ করা যায় না। তাবেয়ীদের যুগ থেকে অনেকেই এ রকম আমল করেছেন। তবে দুর্বল হাদিসের বিষয়ে কেউ যদি আমল না করে তাকে কিছু বলাও যাবে না।
শবেবরাতের বিষয়ে বর্ণিত দুর্বল হাদিসগুলোতে তিনটি আমল পাওয়া যায়। প্রথমটি হলো- এ রাতে দোয়া করা। দোয়া করলে আল্লাহ কবুল করবেন। দ্বিতীয়টি হলো-এ রাতে কিছু নফল সালাত, কিয়ামুল লাইল তথা তাহাজ্জুদ আদায় করা। তৃতীয়টি হলো- এ রাতে কবর জিয়ারত করা। তিনটিই দুর্বল সনদে বর্ণিত হাদিস থেকে পাওয়া যায়। এ হাদিসের ওপর আমল করা যেতে পারে। এখন বড় বিষয় হচ্ছে- রাসূল সা: এ তিনটি আমল কিভাবে করেছেন এটি আমাদের জানতে হবে। আমরা তিনটি আমল হাদিসে পেয়েছি; এখন যদি আমরা রাসূলের পদ্ধতি অনুসরণ না করে নিজেদের মতো করে আমল শুরু করি তাহলে সমস্যা আছে। দুর্বল বর্ণনায় পাওয়া হাদিসগুলোতে এসেছে এ রাতের আমলগুলো সবার সাথে মিলিত হয়ে নয়, বরং রাসূল সা: একাকী করেছেন। মসজিদে নয়, নিজের ঘরে অবস্থান করে আমলগুলো করেছেন। আবার এ রাতে কবর জিয়ারত করতে রাতের গভীরে একাই গিয়েছেন। ঘরের স্ত্রীকেও বলেননি।
সুতরাং সুন্নাত পদ্ধতি হলো এসব আমল একা একা করা। মসজিদে নয়, আনুষ্ঠানিকভাবেও নয়। এ জন্যই আমাদের ফকিহগণ বারবার লিখেছেন, ‘এ রাতে মসজিদে বা কোথাও সমবেত হওয়া মাকরুহ। প্রতি রাতেই তো অনেকেই কিছু নফল সালাত আদায় করি বা কিয়ামুল লাইল করি। এ রাতেও স্বভাবতই কিছু নফল সালাত আদায় করলেন। প্রতি রাতেই আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি; এ রাতেও কিছু দোয়া করতে পারেন।
লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান তথা শবেবরাতের রাতের দোয়ার বিষয়ে যে হাদিসটি প্রসিদ্ধ, সেটা সহিহ ইবনে মাজাহতে বর্ণিত হয়েছে। হজরত আলী রা: থেকে এটি বর্ণিত রয়েছে- এটিকে অনেক বড় বড় মুহাদ্দিস জাল হাদিস বলেছেন। হাদিসটি হলো- ‘আল্লাহ তায়ালা মধ্য শা’বানের রাত শুরু হওয়ার পর প্রথম আসমানে অবতরণ করেন (ফিকহুল আকবার কিতাবে আছে, আল্লাহ তার নিজের মতো করে নামেন। আমাদের মতো করে নয়। আমরা একই মানুষ দুই জায়গায় থাকতে পারি না)। তখন আল্লাহ পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হবে। কেউ কি আছো দোয়া করার? আমি দোয়া কবুল করব। কেউ কি আছো গোনাহ মাফ চাওয়ার? আমি মাফ করে দেবো। কেউ কি আছো বিপদগ্রস্ত? আমি বিপদ কাটিয়ে দেবো। ফজর পর্যন্ত আল্লাহ এভাবে দোয়া কবুলের সুযোগ দিয়ে রাখেন।’ হাদিসটি সনদের দিক থেক খুবই দুর্বল।
সহিহ মুসলিমের একটি হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহ প্রত্যেক রাতের তিন ভাগের এক ভাগ অতিবাহিত হওয়ার পর প্রথম আসমানে অবতরণ করেন। আর ঘোষণা দিতে থাকেন- কেউ কি আছো গোনাহ মাফ চাওয়ার? আমি মাফ করে দেবো। কেউকি আছো বিপদের পড়েছ? আমার কাছে চাও আমি উদ্ধার করে দেবো। … এভাবে সুবেহ সাদিক পর্যন্ত চলতে থাকবে।’
খেয়াল করুন, শবেবরাতের বিষয়ে বর্ণিত দুর্বল হাদিসে আছে, সন্ধ্যার পর আল্লাহ প্রথম আসমানে আসেন। আর সহিহ হাদিসে আছে সারা বছর প্রতিটি রাতের তিন ভাগের এক ভাগ অতিবাহিত হওয়ার পর আল্লাহ প্রথম আসমানে আসেন এবং বান্দাকে এভাবে আহ্বান করতে থাকেন। হিসাব করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে ঋতু ভেদে সাড়ে ১০টা থেকে ১২টার মধ্যেই রাতের তিন ভাগের এক শেষ হয়ে যায়। আর তখন আল্লাহ প্রথম আসমানে অবতরণ করেন। এভাবে বছরের প্রতিটি রাতেই আল্লাহ অবতরণ করেন। ধরি রাতের সময় ১১ ঘণ্টা। তাহলে তিন ভাগের একভাগ হবে চার ঘণ্টার কিছু কম সময়। যদি সন্ধ্যা ৬টায় বেলা ডোবে তাহলে রাত সাড়ে ১০টা বাজতেই রাতের তিন ভাগের এক ভাগ চলে যায়। আর মহান আল্লাহও প্রথম আসমানে নেমে আসেন। আর শবেবরাতের রাতে আসেন সন্ধ্যা রাতে। তাহলে আমরা একটু চিন্তা করলে বুঝতে পারব দুর্বল হাদিসের বর্ণনা মতে, শবেবরাতের রাতের সাথে অন্য রাতে আল্লাহ প্রথম আসমানে আসার পার্থক্য হলো মাত্র চার ঘণ্টার মতো।
তাই আমার বুঝে আসে না, সারা বছর সুযোগ থাকতেও আমরা কেন বছরে একদিন তথা শবেবরাতের রাতের জন্য হুড়াহুড়ি করি। এভাবে গোনাহ মাফ, বিপদে মুক্তি, অভাব দূরসহ সব সমস্যার সমাধান তো আল্লাহ সব রাতেই দিয়ে থাকেন। সুতরাং আমাদের উচিত প্রতিদিন রাতেই কিছু কিছু ইবাদত করা। একদিন না একদিন আল্লাহ কবুল করবেন।
আমরা বাংলাদেশের মানুষ রাত ১০টার আগে খুব কমই ঘুমাই। যদি রাত সাড়ে ১০টার দিকেই আল্লাহ দোয়া কবুলের জন্য আহ্বান করতে শুরু করেন তাহলে আমরা প্রতি রাতেই ঘুমানোর আগে দুই-চার রাকাত সালাত আদায় করে আল্লাহর কাছে দোয়া করে ঘুমাতে যাব। সুতরাং শবেবরাতের রাতেও আমরা আমল করব সুন্নত পদ্ধতি অনুসারে। আর সারা বছরও আমরা আমল করব। শুধু শবেবরাতের জন্য আমরা অপেক্ষায় থাকব না। আমার একটি বই আছে নাম হলো- ‘কুরআন সুন্নাহর আলোকে শবেবরাত’। তো আমার এক দুলাভাই বইটি পড়েছেন। পড়ার পর আমাকে বললেন, ‘তোমার বইটি পড়লাম, খুব ভালো লিখেছ। তবে বইয়ের শেষের দিকে এসে বলেছ, ‘আমাদের জন্য প্রতি রাতই শবেবরাত। এতে তো শবেবরাতের রাতের গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছ।’
তখন আমি বললাম, দেখুন দুলাভাই, আমাদের উদ্দেশ্য হলো রাসূল সা:-এর সুন্নতকে জীবিত করা। রাসূল সা: এক রাত ইবাদত করেছেন আর বছরের বাকি রাতগুলো ইবাদত করেননি এ রকম কিছু আমার জানা নেই। সাহাবিরাও এমনটি করেননি। সুতরাং মুমিনের জীবনের প্রতিটি রাতই শবেবরাত হওয়া উচিত। আল্লাহ আমাদের বোঝার তাওফিক দান করুন। আমিন।