আলেম-ওলামা সাধারণ কোনো মানুষ নয়। তাঁদের যোগসূত্র সরাসরি সারা বিশ্বের প্রতিপালক আল্লাহপাকের সাথে। কোরআনের ইলম অর্জনকারীই হলেন আলেম। আর কোরআন শিক্ষা স্বয়ং রাব্বুল আলামীন আল্লাহতায়ালা থেকে ধারাবাহিকভাবে আলেমরা অর্জন করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘দয়াময় আল্লাহ! তিনিই কোরআন শিক্ষা দিয়াছেন।’ (সুরা আর-রাহমান, আয়াত-১ ও ২)। আল্লাহতায়ালা সর্বপ্রথম জিবরাইল (আ.) এর মাধ্যমে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন। নবীজি শিক্ষা দিয়েছেন সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-কে। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) শিক্ষা দিয়েছেন তাবেঈনদেরকে। তাবেঈনরা শিক্ষা দিয়েছেন তাবে-তাবেঈনদেনকে। অতঃপর তারা শিক্ষা দিয়েছেন আলেম-ওলামাকে। এভাবে পর্যায়ক্রমে বর্তমানের আলেম-ওলামা কোরআনের শিক্ষা অর্জন করেছেন।
মানুষের জীবনযাপনে অনেক সমস্যারই সম্মুখীন হতে হয়। অনেক কিছুই জানার প্রয়োজন হয়। আর আলেমরা যেহেতু আল্লাহ প্রদত্ত ইলম অর্জনকারী, সেহেতু সমস্যা নিরসনে আলেমদের দ্বারস্থ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মহান আল্লাহতায়ালা নিজেই। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘অতএব আলেম-জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করো, যদি তোমাদের জানা না থাকে।’ (সুরা নাহল, আয়াত-৪৩)। শুধু এতটুকুই নয়। আল্লাহ ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্যের সাথে সাথে আলেমদের আনুগত্যেরও নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহতায়ালা। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর নির্দেশ মান্য করো, অনুসরণ করো রাসুলের এবং তোমাদের মধ্যে যাঁরা কর্তৃত্বসম্পন্ন (ন্যায়পরায়ণ শাসক ও আলেম) তাঁদের।’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত-৫৯)। অন্যত্র আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘(হে নবী) আপনি বলুন, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান?’ (সুরা জুমার, আয়াত-৯)। আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘তোমাদের যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, আল্লাহ বৃদ্ধি করেন তাদের মর্যাদা।’ (সুরা মুজাদালাহ, আয়াত-১১)। আলেমদের জীবনের মূখ্য উদ্দেশ্য হলো দিন প্রচার ও রক্ষা করা। কোরআন-সুন্নাহর জ্ঞান মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত তারা। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক তৈরি করেন তারা। মানুষদের আল্লাহর বিধি-বিধান শিক্ষা দেন। হালাল-হারাম শিক্ষা দেন। সৎপথ দেখান। তাদের সংস্পর্শে এসে অন্ধকার জগতের মানুষ আলোকিত জীবনের সন্ধান পায়। হাসান বসরি (র.) বলেন, ‘আলেমরা না থাকলে মানুষ গবাদিপশুর তুল্য হয়ে যেত।’ আলেম তারাই যারা শরিয়ত বহন করেন। কথা বলেন কোরআন-সুন্নাহর আলোকে। রক্ষা করেন ইসলামের পবিত্রতা। দূরে রাখেন তার থেকে সব কদর্যতা। লক্ষ্য রাখেন জনগণের দিনের প্রতি। শিক্ষা দেন জাহেলদের। স্মরণ করিয়ে দেন আল্লাহভোলা বান্দাদের তাঁর কথা। ফেতনা চিহ্নিত করেন। দূরীভূত করেন অন্ধকার। ফাঁস করেন ভ্রান্তলোকদের গোমর। তারা যদি আল্লাহর বিধিবিধান রক্ষা না করতেন, ইসলাম মিটে যেত। শরিয়ত বিলুপ্ত হতো। এক বর্ণনায় এসেছে, ‘জমিনে আলেমদের অবস্থান আসমানের নক্ষত্রতুল্য। যখন মানুষ তা দেখে, পথ চলে। যখন তা অদৃশ্য হয়ে যায়, অস্থির হয়ে পড়ে।’ (বায়হাকি : ১/৩৫৪)।
আলেমদের কাছে ইসলাম সবার আগে। দিনের অতন্দ্র প্রহরী তাঁরা। ইসলামের বিরুদ্ধে সব ধরনের ষড়ষন্ত্রের মোকাবিলায় তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন। আল্লাহর দিন রক্ষায় নিজের জানের পরোয়া করেন না তাঁরা। হক কথা বলতে দ্বিধাবোধ করেন না। হক প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জান-মাল ব্যয় করাটা গৌরবের মনে করেন। বাতিলের মুখোশ উন্মোচন এবং ইসলামের শত্রুদের দমন করতে কালক্ষেপণ করেন না। তাঁরা দুনিয়ার কাউকে ভয় করেন না। একমাত্র আল্লাহকে ভয় করেন তাঁরা। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল আলেমগণই আল্লাহকে ভয় করে।’ (সুরা ফাতির, আয়াত-২৮)। আল্লাহতায়ালা সবাইকে আলেম বানান না। আল্লাহতায়ালা যাকে ইচ্ছা করেন এবং যার কল্যাণ চান তাকে এই ইলমের দৌলত দান করেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি (আল্লাহ) যাকে ইচ্ছা আল-হিকমাহ (গভীর ইলম) দান করেন। আর যাকে আল-হিকমাহ দেওয়া হয়, তাকে মূলত দেওয়া হয় অঢেল কল্যাণ।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-২৬৯)। হাদিস শরিফে হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ যার কল্যাণ করতে চান, তাকে দিনের ব্যাপারে ফকিহ (প্রসস্থ ও গভীর ইলমধারী বিজ্ঞ) বানিয়ে দেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ৭১)
হজরত আবু দারদা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘আবেদের ওপর আলেমের ফজিলত এরূপ, যেরূপ পূর্ণিমার রাতে চাঁদের ফজিলত সব তারকারাজির ওপর। আর আলেমরা হলেন নবীদের ওয়ারিশ। আর নবীরা দিনার-দিরহাম মিরাস হিসেবে রেখে যান না; বরং তাঁরা রেখে যান ইলম। কাজেই যে ব্যক্তি ইলম হাসিল করল, সে প্রচুর সম্পদের মালিক হলো।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৩৬৪২)। হাদিসে নবীজি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন আলেমগণ নবীদের ওয়ারিস। আমাদের নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন সর্বশেষ নবী। কেয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নবী আসবে না। পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত আলেমরাই নবুয়তি কাজ আঞ্জাম দিয়ে যাবেন। তাই আলেমদের সম্মান করা জরুরি। এটা মানুষের ঈমানি দায়িত্ব। আলেমদেরকে সম্মান-মর্যাদা করার ব্যাপারে হাদিসে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘বৃদ্ধ মুসলমান, কোরআনের আদব রক্ষাকারী ও কোরআন অনুযায়ী আমলকারী হাফেজ এবং ন্যায়পরায়ণ বাদশার সম্মান করা মহান আল্লাহর সম্মান করার অন্তর্ভুক্ত।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৪০৫৩) অন্যত্র রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘ওই ব্যক্তি আমার আদর্শের ওপর নাই, যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না, ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের আলেমদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান করে না।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং-২২১৪৩) হাদিসে কুদসিতে আছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কোনো ওলির সঙ্গে দুশমনি করবে আমি তার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম।’ (বুখারি, হাদিস নং-৬৫০২)। ওলামায়ে কেরাম নবীদের ওয়ারিস। কোরআন-সুন্নাহর ধারক-বাহক। সমাজে তাঁদের মর্যাদা সর্বোচ্চ পর্যায়ে। তাঁদের সঙ্গে উপহাস করা, তাঁদেরকে গালি দেওয়া, তাঁদের শানে বেয়াদবি, তাঁদেরকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা অনেক বড় অন্যায়। আলেম তো দূরের কথা, কোনো মুসলমানকে গালি দেওয়া, বিদ্বেষী মনোভাব ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা নাজায়েজ ও ফাসেকি কাজ। আর কোনো আলেমের বিরোধিতা করা বা গালিগালাজ করা কুফুরির পর্যায়ে। আল্লামা জাইনুদ্দিন ইবনে নুজাইম মিসরি (র.) বলেন, ‘যদি কেউ কোনো আলেম বা ফকিহকে ব্যক্তিগত কোনো কারণ ছাড়া (আলেম হওয়ার কারণে) গালি দেয়, তাহলে সে কাফির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’ (আল-বাহরুর রায়েক : ৫/১৩২) শায়খজাদাহ আল্লামা আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ কালয়ুবি (র.) বলেন, ‘যদি কেউ ইসলামী শরিয়ত বা শরিয়তের সুস্পষ্ট কোনো মাসয়ালা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে, তাহলে সে কুফুরি কাজ করল। যদি কেউ কোনো আলেমের সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো কারণ ছাড়া (আলেম হওয়ার কারণে) শত্রুতা বা বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করে, তাহলে তার কাফির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি কেউ কোনো ফকিহ আলেমকে বা হজরত আলী (রা.)-এর বংশধরকে গালি দেয়, তাহলে (একদল ফুকাহয়ে কেরামের মতে) সে কাফির হয়ে যাবে, তার স্ত্রী তিন তালাকপ্রাপ্তা হয়ে যাবে।’ (মাজমাউল আনহুর : ১/৬৯৫, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ২/২৭০, ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া : ৫/৫০৮) আমাদের সমাজে অনেকেই বুঝে, না বুঝে বা ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় আলেমদের সমালোচনা করে থাকেন। আবার অনেকেই দুনিয়াবি কোনো স্বার্থে আলেমদের বিরোধিতা বা গালিগালাজ করে থাকেন। সাবধান! কোনো অবস্থাতেই এমনটি করা যাবে না। ভুলক্রমে যাদের দ্বারা এমনটি হয়ে গেছে তাদের এখনই উচিত তওবা করা। আলেমগণ পৃথিবীতে এতোই মর্যাদাবান এবং গুরুত্বপূর্ণ যে, তাঁদের জন্য আসমান-জমিনের সবকিছুই দোয়া করতে থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ইলমের অন্বেষণে পথ ধরে অগ্রসর হয়, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথকে সহজ করে দেন। আর ইলম অন্বেষণকারী যা (কিছু কষ্ট-ক্লেশ ও শ্রম বরদাস্ত) করে, তাতে ফিরেশতাকুল খুশি হয়ে তার জন্য অবশ্যই তাদের পালকগুলোকে বিছিয়ে দেয়। নিশ্চই আলেমের জন্য আসমানসমূহে যারা আছে এবং জামিনে যারা আছে, এমনকী পানির তিমি মাছ পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে। আর আবেদের (বে-আলেমের) ওপরে আলেমের ফজিলত হলো, যেমন তারকারাজির ওপরে চাঁদের ফজিলত। নিশ্চই আলেমরা হলো নবীগণের উত্তরাধিকারী। আর অবশ্যই নবীগণ দিনার ও দিরহামের উত্তরাধিকারী বানিয়ে যান না; বরং তাঁরা উত্তরাধিকারী বানান কেবলমাত্র ইলমের। কাজেই যে ব্যক্তি তা আঁকড়ে ধরলো, সে বিরাট ভাগ্যের জিনিস আঁকড়ে ধরলো।’ (সুনানে তিরমিযি, হাদিস নং-২৬৮২)
কোরআন ও হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী স্পষ্ট হলো যে, নবীগণের পরেই আলেমদের স্থান। সাধারণ মানুষের তুলনায় আলেমদের মর্যাদা অনেক ওপরে। সুতরাং আমরা যারা আলেম হতে পারিনি, আমাদের ইমানি দায়িত্ব হলো আলেমদের যথাযথ সম্মান করা। তাঁদেরকে অন্তর থেকে মুহাব্বত করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, (সম্ভব হলে) তুমি আলেম হও কিংবা ইলম অর্জনকারী হও। অথবা (ইলম) শ্রবণকারী হও কিংবা (আলেম ও ইলম অন্বেষণকারীর প্রতি) মুহাব্বাতকারী হও। তবে পঞ্চম কেউ হয়ো না তাহলে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।’ (মুসনাদে বাযযার, হাদিস নং-৩৬২৬, ত্বাহাবী শরিফ, হাদিস নং-৬১১৬) লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া শায়খ আবদুল মোমিন, মোমেনশাহী