খুলনা উপকূলের ১০ উপজেলায় সুপেয় পানির তীব্র সংকটে ভুগছে মানুষ। বছরের ছয় মাসই সুপেয় পানির সংকট থাকে এই অঞ্চলে। সমস্যা সমাধানে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও, এখন পর্যন্ত কোনও সুফল আসেনি। জানা গেছে, জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত উপকূলের ১০ উপজেলার মানুষ ভালোভাবে পানযোগ্য পানি পেয়ে থাকেন। বাকি ছয় মাস পানির জন্য সংগ্রাম করতে হয়। খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা উপজেলা, সাতক্ষীরার আশাশুনি, শ্যামনগর ও কালিগঞ্জ উপজেলা এবং বাগেরহাটের রামপাল, মোংলা ও মোড়েলগঞ্জ উপজেলার মানুষ পানির কষ্টে ভোগেন সবচেয়ে বেশি। এসব এলাকায় পানি সমস্যা সমাধানে স্থাপন করা হয়েছে পিএসএফ ও রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের মতো প্লান্ট, যা সংরক্ষণের দায়ভার দেওয়া হয় স্থানীয়দের ওপর। এ কারণে এগুলো নষ্ট হয় দ্রুত। পরে সেগুলো আর মেরামত বা সংরক্ষণ করা হয় না।
এছাড়া এনজিওগুলো পৌর এলাকায় ওভারহেড ট্যাংকের মাধ্যমে পাইপলাইনে পানি সরবরাহ, রিভার্স অসমোসিস প্লান্ট, বায়ো স্যান্ড ফিল্টার বসানোর পর সেগুলোও নষ্ট হচ্ছে। প্রকৃতিনির্ভর টেকসই প্রকল্প গ্রহণ না করায় এর সুফল পাচ্ছে না মানুষ। খুলনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৬৭ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি ব্যবহার করতে পারে। বাকি ৩৩ শতাংশ মানুষকে নিজস্ব পদ্ধতিতে পানি সংগ্রহ করতে হয়।
খুলনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী আকমল হোসেন জানান, খুলনা জেলায় এক হাজার ৮৪৮টি নলকূপ চালু রয়েছে। এগুলো দিয়ে সুপেয় পানি উত্তোলন করা হয়। এছাড়া দুই হাজারের মতো রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ও পিএসএফ রয়েছে। একই সঙ্গে জেলার সুপেয় পানি সমস্যা সমাধানে দাকোপে আরও ফিল্টার স্থাপন, দাকোপ, পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর এবং মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের উদ্যোগে কমিউনিটি ভিত্তিক ১৫ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং প্লান্ট স্থাপন করা হচ্ছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে ওই এলাকার মানুষের দুর্ভোগ কিছুটা কমবে।
জানা গেছে, ২০১৮ সালে দাকোপের তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের বটবুনিয়ায় একটি পিএসএফ স্থাপন করে দুস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্র (ডিএসকে)। স্থানীয়রাই এটি দেখাশোনা করতো। দুই বছর পর ২০২০ সালের ঘূর্ণিঝড় আম্পানে পুকুরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর থেকে সেটি বন্ধ রয়েছে। মানুষকে এখন মজা পুকুরের পানি পান করতে হচ্ছে। ২০১১ সালে কয়রার বাগালী ইউনিয়নের বাঁশখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একটি পিএসএফ বসায় বেসরকারি সংস্থা জেজেএস। ২০১৬ সালের ২০ আগস্ট একই বিদ্যালয়ে দুই হাজার লিটার ধারণক্ষমতার রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম স্থাপন করে সংস্থাটি। বর্তমানে এই দুটি পদ্ধতি থেকে আর পানি পাচ্ছে না মানুষ। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ না করায় দুটোই নষ্ট হয়েছে। কয়রার বাগালী গ্রামের বাসিন্দা আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘আমাদের বাড়ি থেকে বাঁশখালী স্কুল প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে। প্রথম দিকে আমরা ভালো পানি পেতাম। তবে ওই সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা এখন এলাকার পুকুরের পানি খাই।’ দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের এলাকায় চারিদিকে (নদীর পানি) পানি। তবে খাবার পানি আনতে হয় ৮ কিলোমিটার দূরের নলকুপ থেকে। সরকার যে উদ্যোগই নেয় প্রতি বছর ঝড়ে তা নষ্ট হয়। লবণ পানির ব্যবহারের কারণে এলাকার নারী ও শিশুদের মধ্যে রোগ বাড়ছে। দুর্গম এলাকা হওয়ায় কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারে না।’ বেসরকারি সংস্থা এওসেড’র নির্বাহী পরিচালক শামীম আরেফিন বলেন, ‘এই অঞ্চলে প্রতি তিন কিলোমিটারের মধ্যে পরিবেশ ও প্রতিবেশ পরিবর্তন হয়। একইভাবে ভূ-গঠনও ভিন্ন। পৃথিবীতে এমন অবস্থা আর কোথাও আছে কিনা জানা নেই। শুধু পানি নয় আরও সমস্যা রয়েছে। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। মানুষের সমস্যা সমাধানে সরকারি-বেসরকারিসহ সব দফতরের সমন্বয়ে স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। তাহলে অর্থের অপচয় হবে না এবং মানুষ সুফল ভোগ করতে পারবে।’