করোনাকালে বন্যা নতুন বিপর্যয়ের জানান দিচ্ছে। মানবসৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়, উজানের পাহাড়ি ঢল, অতিবৃষ্টির মিলিত গ্রাসে ডুবেছে মানুষ ও মানবতা। প্রাকৃতিক জলাধারের ধারণ-অক্ষম পানি যখন লোকালয় ছাপিয়ে প্রবাহিত হয় তখন তাকে বন্যা বলা হয়। নদীবিধৌত ভাটির দেশে বন্যা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পবিত্র কোরআনের শাশ্বত শিক্ষা—‘ভূমিতে ও পানিতে সব জায়গায়,/লোকজন কুকাজে অশান্তি ছড়ায়/যেরূপ কাজ ওরা থাকে করিতে,/আল্লাহ চান তার শাস্তি দিতে…। ’ (কাব্যানুবাদ সুরা রুম, আয়াত : ৪১)
পবিত্র কোরআন ও প্রাচীন সূত্রে ‘নুহের বন্যা’ ও ‘সাবা জাতি’র প্রকৃতির চরম বৈরী শিক্ষা বহুল আলোচিত। একজন বিশিষ্ট নবী নুহ (আ.)। পবিত্র কোরআনে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে ৪৯ বার এবং একটি সুরার নাম ‘নুহ’। প্রায় হাজার বছর আয়ুষ্কালে তিনি মানুষের হেদায়েতে সচেষ্ট থাকলেও তা ছিল প্রায় নিষ্ফল। মাত্র ৪০ জোড়া ‘সামানিন’ (৮০ জন) নর-নারী তাঁর চেষ্টায় ইসলামের সুশীতল ছায়ায় সমবেত হয়। অন্যরা সবাই নুহ (আ.)-কে অতিষ্ঠ করে তোলে। অতঃপর বন্যার কড়াল গ্রাসে নিঃশেষ হয়ে যায় তারা। মহান আল্লাহ নুহ (আ.)-কে বন্যার পূর্বাভাস দেন। নুহ (আ.)-কে নৌকা তৈরির নির্দেশ দেন। এরপর জ্বলন্ত চুলার তলদেশ থেকে পানি উিক্ষপ্ত হয়ে প্রবল বন্যার সূচনা করে। এই বন্যা অবিশ্বাসীদের জীবনের পাট চুটিয়ে দেয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘…তারপর মহাপ্লাবন ওদের গ্রাস করে। কেননা ওরা ছিল সীমা লঙ্ঘনকারী। তারপর আমি তাকে ও যারা জাহাজে উঠেছিল তাদের রক্ষা করলাম…। ’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত : ১৪-১৫) বন্যার বিপর্যয় শেষে পাহাড়ের চূড়া ভাসতে লাগল, আস্তে আস্তে নুহ (আ.)-এর কিশতি ‘জুদি’ পাহাড়ে ভিড়ল। এ বন্যার ভয়াবহতা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘…আমি ওদের ঢেউ-তাড়ানো আবর্জনার মতো করে দিলাম…। ’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ৪১)
এমনই আরেক অভিজ্ঞতা ‘সাবা জাতি’র কাহিনি। দক্ষিণ আরবের সমৃদ্ধ জনগোষ্ঠী ‘সাবা’। পবিত্র কোরআনে ‘সাবা’ নামক সুরায় এদের অবাধ্যতা, পতন ও পরিণতির খোঁজ মেলে। কেননা মহান আল্লাহ বলেন, ‘সাবা অধিবাসীদের জন্য তাদের বাসভূমিতে ছিল একটি নিদর্শন : দুটি উদ্যান, একটি ডানে এবং অন্যটি বাঁয়ে… তারপর তারা অবাধ্যতা করল। ফলে আমি তাদের ওপর প্রেরণ করলাম প্রবল বন্যা। আর তাদের দুই বাগানকে পরিবর্তন করে দিলাম এমন দুই বাগানে, যাতে উদ্গত হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউগাছ এবং সামান্য কুলবৃক্ষ। ’ (সুরা সাবা, আয়াত : ১৫-১৬) নদী শাসন, নগরায়ণ, বিপণিবিতান, পর্যটন ইত্যাদিতে ওরা চরম উন্নতি করে এবং সেচ সুবিধা ও উন্নত চাষাবাদ, নগরের সুরক্ষার জন্য নির্মাণ করেছিল বহুমাত্রিক ব্যবহার উপযোগী ১২টি শক্তিশালী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। মহাসুখের সব আয়োজন শেষে তাদের পেয়ে বসে অনাচার ও অবাধ্যতার অসুখ। মহান আল্লাহ সাবা জাতির হেদায়েতের জন্য ১৩ জন নবী পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু তারা ঈমান আনেনি। অবশেষে আজাব আসে। আল্লাহর শাস্তির মোকাবেলায় নিমেষেই সব প্রতিরোধ ভেঙে যায়। এ জন্য আল্লাহ পাঠিয়ে দিলেন ‘ইঁদুর বাহিনী’। ইঁদুর আল্লাহর হুকুমে বাঁধ কেটে দিলে জোয়ারের পানিতে ওদের সব সাফল্য ও দম্ভ তলিয়ে যায়। এতে ওই এলাকার পরিবেশ-প্রকৃতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। বন্যার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ, মানবসৃষ্ট নানা পরিকল্পনার ত্রুটি ও দুর্বল প্রতিরোধব্যবস্থা। পাশাপাশি এটি আল্লাহর মহা পরীক্ষা। এ পরীক্ষা বন্যার্ত ও বন্যামুক্ত সব মানুষের জন্য।
বন্যার্তসহ সব বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোই ইসলামের আদর্শ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা আল্লাহর প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে দরিদ্র, এতিম ও বন্দিদের খাদ্য দান করে। ’ (সুরা দাহর, আয়াত : ৮) আর্ত মানবতার সেবায় উৎসাহ দিয়ে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘মানুষের মধ্যে সে-ই উত্তম যার দ্বারা মানবতার কল্যাণ সাধিত হয়। ’ আসুন, আমরা দুর্গত ও বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াই, একটু মানবিক দায়িত্ব পালন করি। লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান,ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ,কাপাসিয়া, গাজীপুর।