বিশ্বজুড়ে দ্রুত বাড়ছে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা। ফলে বড় হচ্ছে চামড়ার বৈশ্বিক বাজারও। ২০২০ সালে এর আকার ছিল ৩৯৪ দশমিক ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের, ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০৭ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলারে। এরপর থেকে বার্ষিক ৫ দশমিক ৯ শতাংশ হারে বেড়ে ২০২৮ সালে বৈশ্বিক চামড়া বাজারের মূল্যমান ৬২৪ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতভিত্তিক বাজার বিশ্লেষক এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্রান্ড ভিউ রিসার্চের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। মূলত ভোক্তা আয়, জীবনযাত্রার ব্যয়, ফ্যাশন ট্রেন্ডের পরিবর্তন এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটনের ওপর নির্ভর বৈশ্বিক চামড়া বাজারের ভাগ্য। তবে এর ওপর মানুষের ব্র্যান্ড সচেতনতার পাশাপাশি আরামদায়ক, ট্রেন্ডি এবং অভিনব চামড়ার পোশাক, জুতাসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রভাবও উল্লেখযোগ্য। চামড়া দিয়ে তৈরি আকর্ষণীয় বিলাসবহুল পণ্যগুলো প্রায়ই আধুনিক স্টাইল ও স্ট্যাটাসের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। সেদিক থেকে জর্জিও আরমানি, বারবেরি, প্রাডা, ডলস অ্যান্ড গাব্বানার মতো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর তৈরি সমসাময়িক ডিজাইনের পোশাক, জুতা ও অন্যান্য জিনিসপত্রের চাহিদা ব্যাপক। তবে করোনাভাইরাস মহামারি সামগ্রিক চামড়া বাজারের ওপরই মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ওয়ার্ল্ড ফুটওয়্যারের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই চামড়ার জুতা বিক্রি কমেছে প্রায় ৩২ শতাংশ। তাছাড়া সামগ্রিকভাবে জুতার চাহিদা কমে গেলে চামড়াজাত জুতা বিক্রিও কমে। এ ধরনের অনেক প্রতিষ্ঠানই প্রস্তুত ও কাঁচা চামড়ার জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু করোনা মহামারিতে সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘœ ঘটায় তাদের হাতে সময়মতো পণ্য পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু সেই পরিস্থিতি দ্রুতই কাটিয়ে উঠছে বৈশ্বিক চামড়ার বাজার। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সের মতো প্রধান বাজারগুলোতে ব্র্যান্ডেড পোশাকের প্রতি মানুষের আগ্রহের পাশাপাশি অতিধনীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছে। চামড়ার তৈরি পোশাকগুলো সাধারণত এক্সক্লুসিভ ডিজাইন ও চড়া দামের হয়, যার প্রধান ক্রেতাই অতিধনী ব্যক্তিরা। ২০১৯ সালে ক্রেডিট সুইস গ্রুপ এজি প্রকাশিত গ্লোবাল ওয়েলথ রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৮ সালে বিশ্বের ১০ শতাংশ অতিধনী ব্যক্তিই ছিলেন চীনে।
চামড়াজাত পণ্যের ভবিষ্যৎ: ২০২০ সালে চামড়াজাত পণ্য বাজারের ৪৭ শতাংশের বেশি দখলে রেখে নেতৃত্ব দিয়েছে ফুটওয়্যার বা জুতা সেগমেন্ট। সম্প্রতি নাইকি, নিউ ব্যালেন্স, অ্যাডিডাস, পুমা, রিবক, অল বার্ডস এবং কনভার্সের মতো ব্র্যান্ডগুলো চামড়ার অ্যাথলেটিক ফুটওয়্যারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বিবেচনায় এ ধরনের পণ্যে বিনিয়োগ করেছে।
২০১৭ সালে ‘ফ্লাই লেদার’ থেকে তৈরি স্নিকার্স বাজারে ছাড়ে নাইকি। এই ফ্লাই লেদার হচ্ছে ট্যানারিতে অবশিষ্ট চামড়ার স্ক্র্যাপ ও পলিয়েস্টার মিশ্রণের সমন্বয়ে তৈরি একধরনের নতুন উপাদান। চামড়াজাত পণ্যের বাজারে ২০২১ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত বাড়বে হোম ডেকর ও ফার্নিশিং সেগমেন্ট। এর বার্ষিক বৃদ্ধির হার হতে পারে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। বাড়ির আসবাবপত্র ও সংস্কারের পেছনে মানুষের ব্যয়বৃদ্ধি এই অংশের প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কয়েক বছর ধরে বিশ্বব্যাপী আবাসন বাজার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো হাউজিং সূচক, যা আবাসিক সম্পত্তির পরিবর্তনের মূল্য প্রতিফলিত করে।
আঞ্চলিক সম্ভাবনা: ২০২০ সালে বৈশ্বিক চামড়া বাজার থেকে অর্জিত মুনাফার ৩৪ শতাংশ শেয়ার নিয়ে আধিপত্য ছিল উত্তর আমেরিকার। ২০১৯ সালে এ অঞ্চলে চামড়াজাত পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার ছিল যুক্তরাষ্ট্র, এরপর কানাডা ও মেক্সিকো। উত্তর আমেরিকায় চামড়াজাত পণ্যগুলো প্রধানত ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, ডিসকাউন্ট স্টোর, ফ্যাক্টরি আউটলেটসহ ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিক্রি ও বিতরণ করা হয়। চামড়াজাত পণ্যের জনপ্রিয়তার পাশাপাশি অনলাইনে কেনাকাটার হার বাড়তে থাকায় ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে চামড়ার বাজার আরও বড় হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ক্রীড়াবিদ এবং স্বাস্থ্য ও ফিটনেস-সচেতন ব্যক্তিদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যাও সেখানে চামড়া বাজারের প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে। তবে ২০২১ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে চামড়ার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধমান আঞ্চলিক বাজার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এশিয়া প্যাসিফিক। চীন-ভারতের নেতৃত্বে এ অঞ্চলে চামড়ার তৈরি বিলাসবহুল পণ্যের দ্রুত প্রসার ঘটছে। এশিয়ায় কাঁচা চামড়ার অন্যতম প্রধান উৎস ধরা হচ্ছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে। লেদারেক্স ফুটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নাজমুল হাসানের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০টি নতুন চামড়াজাত পণ্য ও জুতা তৈরির কারখানা খোলা হয়। চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি শুল্ক খুব কম হওয়ায় বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর জন্য আকর্ষণীয় বাজার হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ।-জাগোনিউজ২৪.কম