গাজীপুরের কালীগঞ্জে জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভুল চিকিৎসায় শিরিন বেগম(৩০) নামের এক প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে। রক্তশূন্য ওই প্রসূতির ‘এবি’ পজিটিভ রক্তের প্রয়োজন হলেও তাকে পুশ করা হয় ‘বি’ পজিটিভ রক্ত। এ ঘটনায় হাসপাতালের পরিচালক বন্যা আক্তারসহ(৩১) ৬ সহযোগীকে কালীগঞ্জ পৌর এলাকার বড়নগর সড়কের বালীগাঁও থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এ সময় ভিকটিমের চিকিৎসা সংক্রান্ত ও হাসপাতাল পরিচালনার মেয়াাদোত্তীর্ণ নথিপত্র উদ্ধার করা হয়। বুধবার (২৪ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গ্রেফতারের বিষয়টি গণমাধ্যমকর্মীদের নিশ্চিত করেন র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। গ্রেফতাকৃতরা হলো হাসপাতালের পরিচালক বন্যা আক্তার, মো. আশিকুর রহমান(২৫), সংগীতা তেরেজা কস্তা(৩৩), মেরী গোমেজ(৪০), সীমা আক্তার(৩৪) ও শামীমা আক্তার(৩২)। র্যাব জানায়, হাসপাতালটির চিকিৎসক মাসুদ গাইনোকোলোজিস্ট না হয়েও রোগীর সিজার করতেন। এছাড়া হাসপাতাল ও ডায়গনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্সের মেয়াদ গত বছরের ৩০ জুন শেষ হয়েছে। ট্রেড লাইসেন্সের মেয়াদ চলতি বছরের ৩০ জুন শেষ হলেও তারা আর নবায়ন করেনি। ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স ও শিল্প প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সসহ পরিবেশগত কোনো ছাড়পত্রও ছিল না তাদের। ঘটনার বিবরণে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক জানান, গত ২১ আগস্ট সকালে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার তুমলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ চুয়ারিয়াখোলা গ্রামের শিরিন বেগমের প্রসব বেদনা উঠলে পূর্ব পরিচিত জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বন্যা আক্তারের মাধ্যমে ওই হাসপাতালে সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য ভর্তি হয়। পরে ওটি বয় আশিকের তত্ত্বাবধানে রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা ও আল্টাসনোগ্রাম করে সিজারের জন্য রোগীকে ওটিতে নেওয়া হয়। চিকিৎসক মাসুদ গাইনোকোলোজিস্ট না হয়েও রোগীর সিজার করেন। অপারেশন শেষে ব্লিডিং হওয়ায় চিকিৎসক মাসুদের পরামর্শে আশিক ও বন্যা রোগীর পরিবারকে ‘এবি’ পজিটিভ রক্ত সংগ্রহের কথা বলেন। ভিকটিমের ভাই ও ননদের ছেলের ‘এবি’ পজিটিভ গ্রুপের রক্ত হওয়ায় তাদের কাছে রক্ত সংগ্রহ করার ব্যবস্থা হয়। প্রথমে ভিকটিমের ভাইয়ের শরীর থেকে এক ব্যাগ রক্ত নিয়ে রোগীর শরীরে পুশ করা হয়। আরও এক ব্যাগ রক্ত নিতে ননদের ছেলেকে বেডে শোয়ানো হয়। এরমধ্যেই হাসপাতালের কর্তব্যরত নার্সরা ভিকটিমের শরীরে ‘বি’ পজিটিভ গ্রুপের রক্ত পুশ করেন। ভিকটিমের ‘এবি’ পজিটিভ গ্রুপের রক্তের পরিবর্তে ‘বি’ পজিটিভ রক্ত পুশ করায় রোগীর খিঁচুনি ওঠে। এ সময় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় আশিকের তত্ত্বাবধানে রোগীর চিকিৎসা চলতে থাকে। এক পর্যায়ে রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে সন্ধ্যার দিকে তাকে ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। ভিকটিমের পরিবার রোগীকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় আসার পথে অবস্থার আরও অবনতি হওয়ায় উত্তরার একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। এ সময় চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়মিত কোনো ডাক্তার ছিল না। অথচ সেখানে গড়ে প্রতি মাসে ২৫ থেকে ৩০টি সিজারিয়ান অপারেশনসহ ৫০ টির অধিক বিভিন্ন অপারেশন করা হতো। মেয়াদোত্তীর্ণ কাগজে চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাচ্ছিল হাসপাতালটি। ওটির জন্য রোগী ভেদে বিভিন্ন প্যাকেজে ১০-১৫ হাজার টাকা নেওয়া হতো। বন্যা আক্তার ওই হাসপাতালের অন্যতম অংশীদার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তার কোনো নার্সিং ডিগ্রি নেই। তবে তিনি স্থানীয় একটি হাসপাতালে ৭ বছর নার্সিং ও আড়াই বছর ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন। গ্রেফতার আশিক এসএসসি পাস করে ২০১৬ সালে ম্যাটস থেকে ৩ বছরের ডিএমএফ কোর্স করেন। হাসপাতালে ২০ হাজার টাকা মাসিক বেতনে ওটি বয় ও চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে কাজ করে আসছিলেন তিনি। ঘটনার দিন আশিক ডা. মাসুদের সহকারী হিসেবে ওটিতে উপস্থিত ছিলেন। তবে সেখানের নার্স ও ভিকটিমের পরিবার তাকে চিকিৎসক হিসেবে জানতেন। রোগী তদারকি, চিকিৎসকদের সঙ্গে সমন্বয় রাখা, বিভিন্ন ধরনের টেস্ট করা ও চিকিৎসকদের পক্ষে কাগজপত্রে ভুয়া স্বাক্ষর করতেন তিনি। গ্রেফতার সংগীতা তেরেজা কস্তা এসএসসি পাস এবং ওই হাসপাতালে সিনিয়র নার্স হিসেবে কর্মরত। মেরী গোমেজ এসএসসি পাস ও জুনিয়র নার্স, সীমা আক্তার এসএসসি পাস ও নার্স, শামীমা আক্তার এসএসসি পাস ও হাসপাতালে রিসিপশনিস্ট হিসেবে কর্মরত। এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।