গ্রামের উন্নয়ন ছাড়া দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই উপলব্ধি থেকে প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগরের সুবিধা সম্প্রসারণে ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর বাস্তব রূপ দিতে ২৪৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের ২০টি মন্ত্রণালয়ের ২৬টি সংস্থা ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এসব মন্ত্রণালয় ‘আমার গ্রাম- আমার শহর’ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২৪৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর সমন্বয়কারী হিসেবে আছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
স্থানীয় সরকার বিভাগের মন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ সম্পর্কিত আন্তঃমন্ত্রণালয় প্রকল্প বাস্তবায়নে সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করছে। বিগত অর্থবছরে এ কমিটির তিনটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং ‘আমার গ্রাম- আমার শহর’ বাস্তবায়নে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ২৪টি প্রকল্প পর্যালোচনা এবং বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এলজিইডির আওতায় দেশে উপজেলা সড়ক, ইউনিয়ন সড়ক, গ্রাম সড়ক মিলে মোট প্রায় ১ লাখ ২৯ হাজার কিলোমিটার পাকা সড়ক রয়েছে। যেসব গ্রাম এখনো সড়ক যোগাযোগের বাইরে আছে, তাদের তথ্য সংগ্রহ করে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির ফলে গ্রামীণ সড়কে ভারী যানবাহনের চলাচল বৃদ্ধি পাওয়ায় রোড ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ড পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, গ্রামের কৃষিপণ্য শহরে বাজারজাত করতে হাটে যেমন জায়গা প্রয়োজন, তেমনি শহরের ভোগ্যপণ্য গ্রামে পৌঁছানোর জন্যও হাটে জায়গার সংস্থান প্রয়োজন। দেশব্যাপী ২১০০টি গ্রোথ সেন্টার এবং ১৫ হাজার ৫৫৫টি গ্রামীণ হাটবাজার রয়েছে। দেশের সব উপজেলায় আধুনিক সম্প্রসারিত হাটবাজার নির্মাণের জন্য ১ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। ২০২০ সালে ‘আমার গ্রাম- আমার শহর’ নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়েছে। এতে স্থানীয় সরকার বিভাগ সংশ্লিষ্ট আটটি বিষয় রয়েছে।
বিষয়গুলো হলো- গ্রামীণ যোগাযোগ, গ্রামীণ গ্রোথ সেন্টার ও হাটবাজার, গ্রামীণ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কম্যুনিটি স্পেস ও বিনোদন ব্যবস্থা, উপজেলা মাস্টার প্ল্যান, গ্রামীণ গৃহায়ণ এবং উপজেলা পরিষদ-ইউনিয়ন পরিষদের সক্ষমতা বৃদ্ধি।
প্রধানমন্ত্রী অনুমোদিত এ কর্মপরিকল্পনায় আটটি বিষয়ে দেশব্যাপী পরিকল্পিতভাবে ‘আমার গ্রাম- আমার শহর’ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ৩০টি গাইডলাইন-নীতিমালা তৈরি এবং ৩৬টি সমীক্ষা পরিচালনা করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি দেশের গ্রামসমূহ ২০৪১ সালের ভিশন সামনে রেখে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার জন্য ১৫টি পাইলট গ্রাম উন্নয়নের একটি প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে।
গ্রামীণ যোগাযোগ: বাংলাদেশে সমতল জেলার গ্রামগুলোতে গ্রাম পর্যন্ত সংযোগ রয়েছে। কিছু গ্রামে সেতুর অভাবে সরাসরি সড়ক সংযোগ নেই। এলজিইডির অধিকাংশ প্রকল্পে গ্রামের ভেতরের সড়ক উন্নয়ন বা আগে নির্মিত সড়কের আপগ্রেডেশন করা হচ্ছে। হাওর-চর-পার্বত্যা লের প্রায় ৪২০০ গ্রামে সড়ক যোগাযোগ নেই। এসব গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে সমীক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে যা মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্টসহ অন্যান্য বিষয়ও বিবেচনা করবে।
গ্রামীণ গ্রোথ সেন্টার ও হাটবাজার: গ্রামীণ গ্রোথ সেন্টার ও হাটবাজার গ্রামীণ অর্থনীতির হৃৎপি-। ২০৪১ সালের উন্নত দেশ গড়ার ভিশন অনুযায়ী পল্লি অর্থনীতিতে অধিকতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স ার করতে হলে গ্রোথ সেন্টার-হাটবাজার সমূহের পরিকল্পিত উন্নয়ন প্রয়োজন। এজন্য গ্রোথ সেন্টার-হাটবাজার কেন্দ্রিক অধিকতর কর্মসংস্থান তৈরি এবং উচ্চ আয়-মধ্য আয়ের অর্থনীতি সংস্থানে সক্ষম গ্রামীণ হাটবাজার পরিকল্পনার জন্য এ সমীক্ষা এবং গাইডলাইন তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
৮০’র দশকে ১৪০০, ৯০’র দশকে ২১০০ গ্রোথ সেন্টার ছিল। ২০৪১ সালের উন্নত দেশ বাস্তবায়নে গ্রোথ সেন্টারের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা তা যাচাই, অগ্রাধিকার নির্ধারণ এবং গ্রোথ সেন্টারের অবকাঠামো পরিকল্পনা নিয়ে সমীক্ষা রয়েছে।
কম্যুনিটি স্পেস: গ্রামে খেলার মাঠ এবং কম্যুনিটি স্পেসের তীব্র অভাব রয়েছে। স্কুলের মাঠ ছাড়া খেলার মাঠ নেই বললেই চলে। অধিকাংশ জমিতে তিন ফসল হওয়ায় জমিতেও এখন খেলা যাচ্ছে না। স্কুলের মাঠসমূহের পরিকল্পিত ডিজাইন-উন্নয়ন করলে গ্রামে শিশুদের খেলার মাঠের সংস্থান সম্ভব। অনেক গ্রামে স্থানীয় জনগণ খেলার মাঠ, কম্যুনিটি স্পেসের জন্য জমি দিতে আগ্রহী। এসব ক্ষেত্রে অধিকতর উন্নয়নে সরকারি বিনিয়োগ করার জন্য একটি ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা প্রয়োজন। উপজেলাগুলোতে জমির তীব্র সংকট রয়েছে। নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে উপজেলায় মিনি স্টেডিয়াম, ইনডোর স্টেডিয়াম, পাবলিক লাইব্রেরি, কমিউনিটি সেন্টার, থিয়েটার, ইয়ুথ রিক্রিয়েশন সেন্টার ইত্যাদি স্থাপনা তৈরিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ এবং সমন্বিত ডিজাইন প্রণয়ন জরুরি। এর পাশাপাশি, উপজেলায় পার্ক, পাবলিক স্পেস উন্নয়নের বিভিন্ন সুযোগ রয়েছে। এসব স্থাপনা ব্যবহার করে পাবলিক স্পেস উন্নয়নের ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির সমীক্ষা রয়েছে।
উপজেলা মাস্টার প্ল্যান: দেশে উপজেলা মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নে সক্ষমতার অভাব থাকায় প্রতিবছর ৮-১০টির বেশি মাস্টারপ্ল্যান করা সম্ভব হচ্ছে না। এভাবে দেশের সব উপজেলার মাস্টারপ্ল্যান সমাপ্ত করতে ৩০-৪০ বছর সময় লাগতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে, মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের বর্তমান পদ্ধতি কিছুটা কাস্টমাইজ করে বছরে ৫০-১০০টি উপজেলা মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের সুযোগ আছে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য সমীক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে।
গ্রামীণ গৃহায়ণ: পল্লী উন্নযন একাডেমি, বগুড়া দেশের তিনটি জেলায় (বগুড়া, রংপুর, গোপালগঞ্জ) গ্রামীণ গৃহায়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। অন্যদিকে, ন্যাশনাল হাউজিং অথরিটি দেশের ১১টি উপজেলা সদরে পরিকল্পিত আবাসন তৈরির জন্য প্লট বরাদ্দের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। গ্রামে কম্প্যাক্ট হাউজিং উন্নয়ন নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা রয়েছে। এর বাস্তব প্রয়োগ, অর্থায়ন, জমির সংস্থান নিয়ে বিভিন্ন অস্পষ্টতা রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ/গবেষণা বিশ্লেষণ এবং গ্রাম পর্যায়ে বাস্তবানুগ পরিকল্পিত আবাসন তৈরির সুযোগ সৃষ্টির বিষয়ে ২টি গাইডলাইন এবং একটি সমীক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে।
গ্রামীণ পানি সরবরাহ: দেশে উপকূলীয় অ লে লবণাক্ততা, প্রায় দুইশ উপজেলায় আর্সেনিক এবং বরেন্দ্র এলাকায় পানির স্তর নিয়ে সমস্যা রয়েছে। হাওর, পার্বত্য অ লে স্যানিটেশন, পানি সরবরাহের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে ২টি গাইডলাইন তৈরি এবং ৮টি সমীক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে।
গ্রামীণ বর্জ্য: দেশের কিছু ইউনিয়নে পরিষদের ব্যবস্থাপনায় জরুরি ভিত্তিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা দরকার। এর পাশাপাশি দেশের সব ইউনিয়নেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফ্রেমওয়ার্ক উন্নয়ন করা প্রয়োজন। এসব নিয়ে একটি গাইডলাইন তৈরি এবং ৫টি সমীক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে।
উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের সক্ষমতা বৃদ্ধি: ‘আমার গ্রাম- আমার শহর’ বাস্তবায়নের জন্য সারাদেশে উপজেলা-ইউনিয়ন পরিষদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ যথাযথভাবে কার্যকর না হলে, মাঠ পর্যায়ে নাগরিক সেবা সম্প্রসারণ সহজ হবে না। এজন্য উপজেলা-ইউনিয়ন পরিষদের সক্ষমতা এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য একটি সমীক্ষা পরিচালনা করা হচ্ছে।
এসব নিয়ে ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের পরিচালক আবুল মনজুর মো. সাদেক বলেন, ‘আমার গ্রাম-আমার শহর বাস্তবায়নে ২৬টি সংস্থা কাজ করছে। সেসব সংস্থার ২৪৫টি প্রকল্প এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমার গ্রাম-আমার শহর ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশের একটি ভিশন। ২০৪১ সালের ভিশন অনুযায়ী উন্নত বাংলাদেশ কেমন হবে, বর্তমান গ্রামীণ অবস্থার উন্নতি কীভাবে করতে পারি সেটির একটি বিশাল স্টাডি করছি। ‘আমরা আটটি এরিয়া টার্গেট করে স্টাডি করেছি। সেই স্টাডিগুলো প্রায় শেষ। আমরা অংশীজনদের কাছ থেকে মতামত নিয়েছি, সেগুলো সমন্বয় করে স্টাডি রিপোর্ট দিয়ে দেবো। এর মাধ্যমে ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হবে।’
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমার গ্রাম, আমার শহর, প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার। এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নের মাধ্যমে গ্রামগুলোতে বিদ্যুৎ যাবে, সুপেয় পানির ব্যবস্থা থাকবে, আধুনিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা হবে, শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত হবে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নত হবে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে। কৃষি ব্যবস্থাপনা আধুনিক এবং লাভজনক হবে। কর্মসংস্থান তৈরি হবে, ব্যাংকিং সিস্টেম সম্প্রসারণ হবে। বাজার ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন করা হবে। সামগ্রিকভাবে একটি উন্নত জীবনযাত্রার জন্য যে ব্যবস্থাপনা মানুষের জন্য প্রয়োজন, সেগুলোর সবকিছুই সেখানে করা হবে। এটা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প, দীর্ঘ সময় ধরে প্রকল্পটি চলবে।-জাগোনিউজ২৪,কম