দুনিয়াবি বিপদগুলোর মধ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অন্যতম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আয় অনুপাতে ব্যয়ের পরিমাণ বেশি হলে হতাশা আর পেরেশানি ব্যতীত অন্য কিছু করার থাকে না। যার কারণে শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি মানসিক অসুস্থতা তীব্র আকার ধারণ করে। শুরু হতে থাকে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইসহ বড় অপরাধপ্রবণতা। পরিবার, সমাজ ও দেশের মানুষ হুমকির সম্মুখীন হয়। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে থাকে ঘরে ঘরে ও গ্রামেগঞ্জে। তা থেকে বাঁচতে বা কাটিয়ে উঠতে ইসলামী অনুশাসনের বিকল্প নেই। যার নমুনা প্রাক-ইসলাম থেকেও পেয়ে থাকি। সায়্যিদিনা হজরত ইউসুফ আ: আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা:ও পূর্ণাঙ্গভাবে হাতে-কলমে শিখিয়েছেন। তন্মধ্যে কয়েকটি পদ্ধতি হলো-
১. অপচয় রোধ করা : বর্তমান বিশ্বে প্রয়োজন অতিরিক্ত ব্যয় একটি মহামারীর মতো ধারণ করেছে। খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানসহ সর্বক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে অপচয় আমরা করছি যা দিয়ে চাহিদাসম্পন্ন মানুষের চাহিদা পূরণ করা হয়তো সম্ভব হয়ে যেত। সে সম্পর্কে পবিত্র কুরআনুল কারিমে সতর্কতাপূর্বক ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে আদম সন্তান! প্রত্যেক সালাতের সময় সুন্দর পোশাক পরিচ্ছদ গ্রহণ করো। আর খাও ও পান করো। তবে অপচয় ও অসংযমতা করবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না।’ (সূরা আরাফ-৩১) অপর আয়াতে অভাবগ্রস্তকে সহযোগিতার পাশাপাশি অপচয় রোধের মাধ্যমে সুন্দর সমাজ গঠনের ইঙ্গিত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আত্মীয় স্বজনকে তার হক দান করো এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও এবং কিছুতেই অপচয় করো না। নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ। তুমি যদি তাদেরকে (অর্থাৎ অভাবী আত্মীয়, মিসকিন ও মুসাফিরদের) পাশ কাটাতে চাও এ জন্য যে, তুমি এখনো নিজের জন্য তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ লাভের সন্ধানে নিযুক্ত যা তুমি প্রত্যাশা করো, এমতাবস্থায় তাদের সাথে নম্রভাবে কথা বলো। তোমার হাতকে তোমার গলার সাথে বেঁধে (সহযোগিতা থেকে একেবারে বিরত) দিও না, আর তা একেবারে প্রসারিত (নিজের প্রয়োজন থাকার পরও) করেও দিও না, তা করলে তুমি নিন্দিত ও নিঃস্ব হয়ে বসে পড়বে। নিশ্চয়ই তোমার পালকর্তা যাকে ইচ্ছা অধিক জীবনোপকরণ দান করেন এবং তিনিই তা সঙ্কুচিতও করে দেন। তিনি তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন এবং সব কিছুই দেখেন।’ (সূরা ইসরা, আয়াত : ২৬-৩০)
ওই আয়াতগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে কবির একটি কবিতা উল্লেখ না করলেই নয়। কবি বলেন- ‘যেজন দিবসে, মনের হরষে, জ্বালায় মোমের বাতি / আশুগৃহে তার, দেখিবে না আর, নিশিতে প্রদীপ বাতি।’
২. কালোবাজারি ও মজুতদারি রোধ করা : কালোবাজারিরা বেশি লাভের আশায় দ্রবমূল্য মজুদদারি করায় সঙ্কট সৃষ্টি হয়। হঠাৎ দ্রব্যাদির সরবরাহ বন্ধ হওয়াতে দ্রব্যসঙ্কট সৃষ্টি হয়। এতে কখনো কখনো দেখা দেয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি। হতেও পারে নাশকতা চালিয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে! কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে উচ্চ থেকে নি¤œবিত্ত আয়ের মানুষের তো আয় বৃদ্ধি সম্ভব হয় না। এতে কালোবাজারিদের আয় বহুগুণে বেড়ে যায়, আর সর্বসাধারণের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তাই এসব কালোবাজারি দেশের আইনানুযায়ী যেমন শাস্তি পাওয়ার যোগ্য, তেমনি ইসলামী আইনানুযায়ীও সে অভিশপ্ত। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর যারা মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের তাদের কৃত কোনো অন্যায় ছাড়াই কষ্ট দেয়, নিশ্চয়ই তারা বহন করবে অপবাদ ও সুস্পষ্ট পাপ।’ (সূরা আহজাব-৫৮) মজুদদারি ও তাদের সাথে একাত্মতা করে যারা দ্রব্য সঙ্কট সৃষ্টি করে তাদের জন্য ভয়ানক শাস্তি রয়েছে পরকালে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই প-িত ও সংসার বিরাগীদের অনেকেই মানুষের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে। আর তারা আল্লাহর পথে বাধা দেয় এবং যারা সোনা ও রুপা জমা করে রাখে, আর তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তুমি তাদের বেদনাদায়ক আজাবের সুসংবাদ দাও। সেদিন জাহান্নামের আগুনে ওইগুলোকে উত্তপ্ত করা হবে। অতঃপর ওইগুলো দিয়ে তাদের ললাটে, পার্শ্বদেশ এবং পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে, আর বলা হবে- এটি হচ্ছে ওটাই যা তোমরা নিজেদের জন্য স য় করে রেখেছিলে। সুতরাং এখন নিজেদের স য়ের স্বাদ গ্রহণ করো।’ (সূরা তাওবা : ৩৪-৩৫) হাদিসে এসেছে, ‘হজরত সাওবান রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘নেককাজ ব্যতীত অন্য কিছু আয়ুষ্কাল বাড়াতে পারে না এবং দোয়া ব্যতীত অন্য কিছুতে তাকদির পরিবর্তন হয় না। মানুষ তার গোনাহের কারণে তার প্রাপ্য রিজিক থেকে বি ত হয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ-৪০২২)
৩. বেশি বেশি তওবা (ইস্তিগফার) করা : পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের কারণে জলে ও স্থলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। তিনি তাদেরকে তাদের কোনো কোনো কাজের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা (অসৎ পথ থেকে) ফিরে আসে।’ (সূরা রুম-৪১) সুতরাং এই বিপর্যয় থেকে কাটিয়ে উঠতে তওবার বিকল্প নেই। তওবার ফলে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে পাঁচটি মহান নিয়ামত দেবেন। তন্মধ্যে তিনটি দুনিয়ায় ও দু’টি পরকালে। তা হলো- উপকারী বৃষ্টি, নেক সন্তান, হালাল সম্পত্তি, অশেষ নিয়ামত জান্নাত ও জান্নাতি নহর। ইরশাদ হচ্ছে, ‘(আমি) বলেছি! তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। তিনি তো মহা ক্ষমাশীল। (তোমরা তা করলে) তিনি অজস্র ধারায় তোমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, তিনি তোমাদের সমৃদ্ধ করবেন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দিয়ে এবং তোমাদের জন্য স্থাপন করবেন জান্নাত ও প্রবাহিত করবেন নদী-নালা।’ (সূরা নুহ, আয়াত : ১০-১২) এখন প্রশ্ন হলো- কতবার তওবা (ইস্তিগফার) করতে হবে? তার সংখ্যা নিয়ে বহু সহিহ হাদিস বর্ণিত রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বনি¤œ ৭০ বার উল্লেখ করা যায়। হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহর শপথ! আমি প্রতিদিন আল্লাহর কাছে ৭০ বারেরও অধিক ইস্তিগফার ও তওবা করে থাকি।’ (বোখারি-৫৭৫৪)
৪. সর্বসাধারণ (অভাবীরা) আমল করা : আয়ের তুলনায় ব্যয়ভার বেশি হলে মহান প্রভুর কাছে প্রার্থনা করে তা বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য নিষ্কৃৃতির পথ করে দেবেন এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দেবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট।’ (সূরা তালাক, আয়াত : ২-৩) ওই আয়াতের ব্যাখ্যায় রয়েছে- ‘হজরত মালেক আশজায়ি রা:-এর পুত্র হজরত আউফ রা: যখন কাফিরদের হাতে বন্দী ছিলেন। তখন তার পিতা রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে আসেন এবং তাঁকে এটি অবহিত করেন। রাসূলুল্লাহ সা: তাকে আদেশ করলেন, ‘তুমি আল্লাহকে ভয় করো, ধৈর্যধারণ করো ও খুব বেশি বেশি লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ পাঠ করতে থাকো।’ একদা হঠাৎ করে হজরত আউফ রা:-এর বাঁধন খুলে যায় এবং তিনি সেখান থেকে পলায়ন করে বাইরে এসে বন্দিকারীদের একটি ছাগলের পাল দেখে সবগুলো হাঁকিয়ে নিয়ে আসেন। কাফেররা তার পেছন ধরে। কিন্তু তখন তিনি তাদের নাগালের বাইরে চলে এসে তার বাড়ির দরজায় এসে ডাক দেন। ডাক শুনে তার পিতা বলেন, কাবার প্রতিপালকের শপথ! এটি তো আউফের কণ্ঠ। এ কথা শুনে তার মা বলেন, হায় কপাল! এটি আউফের কণ্ঠ কী করে হতে পারে? সে তো কাফিরদের হাতে বন্দী! অতঃপর পিতা-মাতা ও খাদেম বাইরে এসে দেখেন, সত্যিই তিনি আউফ রা:। গোটা প্রাঙ্গণ ছাগলে ভর্তি। পিতা তাকে জিজ্ঞেস করেন, এ ছাগলগুলো কেমন করে আনলে? উত্তরে আউফ রা: পূর্ণ ঘটনাটি বর্ণনা করেন। পিতা বলেন- আচ্ছা, থামো। আমি এটি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা:-কে জিজ্ঞেস করে আসি। রাসূলুল্লাহ সা: এ কথা শুনে বললেন, ‘এগুলো সবই তোমার মাল। তোমার মনে যা চায় তাই করতে পারো।’ ওই সময়ই ওই আয়াত অবতীর্ণ হয়। (তাফসির ইবনে কাসির, আরবি, অষ্টম খ-, পৃষ্ঠা-১৪৭)
সর্বশেষ বলা যায়, অন্তত দুনিয়াবি শাস্তির অন্যতম শাস্তি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। তা থেকে বেঁচে থাকতে হলে উল্লিখিত রাষ্ট্রীয় কাজে সরকারের সাথে সবাই সহযোগিতার পাশাপাশি নিজেকে অপচয় থেকে বিরত রাখতে হবে। তওবার মাধ্যমে নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের সুন্দর সমাজ গড়ার তৌফিক দিন। আমিন। লেখক : আলেম ও ইসলামী গবেষক