সামগ্রিকভাবে অব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণেই সারাদেশে বিদ্যুৎ বিপর্যয় হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম। গত মঙ্গলবার রাতে তিনি ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে লোড সাইড (বিদ্যুতের চাহিদা) ও জেনারেশন সাইডের (বিদ্যুৎ উৎপাদন) ভোল্টেজ কন্ট্রোল বা ডিস্ট্রিবিউশন (বিতরণ) সাইডের ক্ষেত্রে সে সব টেকনিক্যাল নির্দেশনা অনুসরণ করা দরকার বাংলাদেশে সেগুলো সাধারণত মেনে চলা হয় না। এসব কারণে অনেক ক্ষেত্রে ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টার বা এনএলডিসি অসহায়। মানে এখানে সমন্বয়ের বড় ধরনের অভাব আছে।’ ‘যেমন ভোল্টেজ কন্ট্রোল করতে না পারলে, ফ্রিকোয়েন্সি কন্ট্রোল করা যাবে না। ফ্রিকোয়েন্সির ক্ষেত্রে অল্প ভ্যারিয়েশন অ্যালাউ করা যায়। বেশি তারতম্য হয়ে গেলে সিনক্রোনাইজেশনে সমস্যা তৈরি হয়। একের পর এক জেনারেশন ট্রিপ করতে থাকে,’ বলেন তিনি। ‘বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হলে ফ্রিকোয়েন্সি স্ট্যাবল রাখতে হবে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয়ভাবে লোড ডিস্ট্রিবিউশনে কন্ট্রোল রাখতে হলে অনেক সময় লোড ডিসকানেক্ট করা হয়, অনেক সময় জেনারেশন ডিসকানেক্ট করা হয়। যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি হলে যেখানে কম উৎপাদন হচ্ছে, সেগুলোকে আগে উৎপাদনে আনা হয়, পর্যায়ক্রমে লোড বাড়ানো হয়। আবার উৎপাদন কমে গেলে শাটডাউন বা ডিসকানেক্ট করা হয়। এসব কাজগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হওয়ার কথা।’
‘এর সঙ্গে বিদ্যুৎ জেনারেশনের প্ল্যান্টগুলোর সঙ্গে লোড সাইডের কো-অর্ডিনেশন যদি সঠিকভাবে না হয়, টেকনিক্যাল এবং ম্যানেজমেন্ট কো-অর্ডিনেশন দুটোই যখন সঠিকভাবে না হয় তখন গ্রিড বিপর্যয়ের ঝুঁকি থাকে,’ যোগ করেন তিনি। অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ‘ট্রান্সমিশন লাইন বা ডিস্ট্রিবিউশন লাইনের ত্রুটির কারণেও গ্রিড বিপর্যয় ঘটে। তবে আমার মনে হয় না এ কারণে আজকের এ বিপর্যয় ঘটেছে। তারপরও এটা জানার অপেক্ষায় আছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের যে ফর্মুলা ছিল, সেখানে লোড সাইডে বিভিন্ন সময়ে তাদের লোড ভ্যারিয়েশন কী ধরনের ছিল সেটার সব তথ্য তারা দেয়নি। আবার জেনারেশন সাইডে তারা কখন কতটা জেনারেট করতে পারছে, সেই তথ্যও তারা দেয়নি।’ ‘অনেক ক্ষেত্রেই মনগড়া তথ্য দিয়ে এনএলডিসিকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে’ উল্লেখ করে এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘অনেক সময় দেখা গেছে যে লোড বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু শাটডাউন করা হচ্ছে না বা ডিসকানেক্ট করছে না। তখন বাধ্য হয়ে এনএলডিসি নিজেই এই কাজটা ম্যানুয়ালি করে।’
ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টার বা এনএলডিসি হলো দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন, স ালন ও বিতরণের মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বয়কারী সংস্থা। চুয়েটের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, ‘জেনারেশন সাইডে যত মেগাওয়াট উৎপাদন করার কথা বলছে, তারা হয়তো তত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিতে পারেনি। কিন্তু এর ওপর পরিকল্পনা করেই তো ডিস্ট্রিবিউশন করা হয়। এসব বিষয় ছাড়াও দেশে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৩০ শতাংশ এখনো এনএলডিসির সরাসরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। তাদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে লোড কন্ট্রোল করা হয়।’ ‘তাদের আইনের আওতায় এনে তথ্য দিতে বাধ্য করা এনএলডিসির এখতিয়ারেও পড়ে না, ক্ষমতাও নেই। এটা মন্ত্রণালয় থেকেই করতে হবে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের এসব বিষয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই, তারা এগুলো বোঝেও না,’ যোগ করেন তিনি। রুটিন লোডশেডিং প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘লোডশেডিংয়ের ফরমান জারি করা হলো পরিপত্র আকারে, কিন্তু সেটা প্রতিপালিত হচ্ছে না কেন, তার অগ্রগতি কী, তার খোঁজখবর রাখেনি। তখন যদি এগুলো ঠিকভাবে মনিটরিং করা হতো তাহলে লোড ও ফ্রিকোয়েন্সি স্ট্যাবিলাইজেশনের একটা প্র্যাকটিসে আমরা অভ্যস্ত হতে পারতাম। এটা একটা সুযোগ ছিল।’
‘আমি বলতে চাই অব্যবস্থাপনার কারণে সিস্টেমের ওপর কন্ট্রোল নেই। তার মানে হচ্ছে আপনি সবসময় ফ্রিকোয়েন্সি স্ট্যাবল রাখতে পারবেন এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। এখন আজকের ঘটনায় কী ঘটেছে, সেটা বলা মুশকিল। কিন্তু এরকম একটা ঝুঁকির মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ স ালন হচ্ছিল। সেটা একটা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে,’ তিনি বলেন। অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ‘কিছুদিন আগে পরিকল্পিত লোডশেডিং বিভিন্ন জায়গায় কার্যকর না হওয়ায় যখন পরিদর্শনে গিয়েছি, তখন এগুলো আমার কাছে পরিষ্কার হলো। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কাছে পরিষ্কার না কেন, আর মন্ত্রণালয় কেন কড়াকড়ি করবে না? কড়াকড়ি করলেই তো সিস্টেমটা একটা স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিসের মধ্যে চলে আসে। তারপরও ট্রিপ করত কি না সেটা বলা মুশকিল, কিন্তু আমি মনে করি এত বড় একটা বিষয় এভাবে অরক্ষিত রেখে আপনি যত যা-ই করেন, এতে কোনো ফল পাবেন বলে আমার মনে হয় না।’
‘পুরো বিদ্যুৎ স ালন ব্যবস্থা বা লোডের ক্ষেত্রে যে ধরনের ম্যানেজমেন্ট করা দরকার, লোড সাইডে এবং জেনারেশন সাইডে কখন কতটুকু জেনারেট করতে হবে, জেনারেট করতে না পারলে কতটুকু লোড কন্ট্রোল করতে হবে এবং এগুলো কন্ট্রোলের মধ্য দিয়ে সিস্টেমের ফ্রিকোয়েন্সি ঠিক রাখার মতো বিষয়গুলো হুমকির মধ্যে ছিল, ঝুঁকির মধ্যে ছিল।’ ‘লোড সাইডকে টেকনিক্যাল ইনস্ট্রাকশনের আওতায় আনা যায়নি, জেনারেশন সাইডকেও আনা যায়নি। ভোল্টেজ কন্ট্রোলের ব্যবস্থা এনএলডিসিতে থাকতেই পারত। কিন্তু, প্রতিষ্ঠানটিকে সেভাবে উন্নীত করা হয়নি,’ যোগ করেন তিনি। ‘জেনারেশনের ক্ষেত্রে এনএলডিসিতে বসে যদি প্রতি মুহূর্তের ভোল্টেজ-ফ্রিকোয়েন্সি দেখা যেত, কমবেশি হলে নিয়ন্ত্রণ করা যেত, কিন্তু সেটা করা হয়নি।’ ‘যেমন লোড সাইডে কোথাও স্যাংশন আছে ৩০ মেগাওয়াট, আপনি সেখানে ৪০ মেগাওয়াট নিয়ে বসে আছেন, আপনাকে বাধ্য করা যাচ্ছে না লোড কাটডাউন করতে। তখন দেখা যায় এনএলডিসি বাধ্য হয়ে লোড ডিসকানেক্ট করে দেয়।’তিনি বলেন, ‘কো-অপারেট না করার যে বিষয়গুলো, টেকনিক্যাল স্ট্যান্ডার্ড না মেনে চলার মতো অপেশাদার আচরণ তো সিস্টেমের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিদ্যুতের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা ইউটিলিটির ক্ষেত্রে যদি নন-প্রফেশনাল আচরণ থাকে, সেটা তো সিস্টেমের জন্য খুবই ক্ষতিকারক।’ ‘প্রফেশনাল এথিকস ও স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলার জন্য ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এথিকস পড়ানো হয়। কিন্তু এগুলো মেনে চলার ক্ষেত্রে সিরিয়াসনেস না থাকলে তখন কী হবে?’ ‘এরকম একটা অবস্থার মধ্যে যদি বিদ্যুৎ বিভাগ চলে, তাহলে কী কারণে এ বিপর্যয় ঘটেছে, সেটা বলার আগে এটা বলতে হবে যে এ ধরনের ঝুঁকির মধ্যে থাকলে যে কোনো সময় এমন বিপর্যয় ঘটতে পারে এবং ঘটবেই,’ বলেন তিনি। গত মঙ্গলবার দুপুর থেকে দেশের প্রায় সব অ লে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের পর রাতে ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ ফিরতে শুরু করে। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে যে ঘোড়াশাল পাওয়ার প্ল্যান্টে ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে গিয়েছিল। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ‘ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে যাওয়া মানে লোড ফল করেছিল বা কমে গিয়েছিল। লোড ফল করা মানে জেনারেশনের গতি বেড়ে যাওয়া। অর্থাৎ লোড বাড়া-কমার সঙ্গে ফ্রিকোয়েন্সি বাড়া-কমা নির্ভর করে। একটার ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে, অপরটা স্ট্যাবল থাকে না।’ এটাকে বিপর্যয়ের একটা কারণ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এনএলডিসির যদি এই কো-অর্ডিনেশন ঠিকভাবে থাকত, তাহলে তারা সেখানকার ফ্রিকোয়েন্সি বাড়তে দিত না, হয় লোড বাড়িয়ে দিত, না হয় ৪ ইউনিটের মধ্যে ১ ইউনিটের লোড কেটে দিত।’
বিদ্যুৎ বিপযর্য়ের কারণ জীর্ণশীর্ণ বিতরণ ব্যবস্থা : অন্যান্য সূত্রে প্রকাশ,একসময় পাকিস্তানের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল চাহিদার তুলনায় অনেক কম। দীর্ঘদিন এ বিষয়টিকেই দেশটির বিদ্যুৎ খাতের প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন নীতিনির্ধারকরা। এ সমস্যা সমাধানের জন্য দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তাসহ দাতা সংস্থাগুলোর কাছে রীতিমতো ধরনা দিয়েছেন তারা। নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারি (আইপিপি) ও বিদেশী উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দেয়া হয়েছে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে। বিষয়টি আরো গতি পায় বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের (সিপিইসি) অধীনে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা শুরু হলে। একসময় দেখা যায় পাকিস্তানের বিদ্যুৎ খাতের উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে দেশটির চাহিদার দেড় গুণেরও বেশিতে। সে তুলনায় দেশটির বিদ্যুৎ স ালন খাতে তেমন কোনো বিনিয়োগই হয়নি। বিতরণ ব্যবস্থা থেকে গিয়েছে জীর্ণশীর্ণ। জাতীয় গ্রিডের অনির্ভরযোগ্য স ালন ব্যবস্থার পাশাপাশি জ্বালানিতে আমদানিনির্ভরতার কারণে পাকিস্তানের বিদ্যুৎ খাত দিনে দিনে আর্থিকভাবে নাজুক অবস্থানে চলে গিয়েছে। স ালন ব্যবস্থার দুর্বলতা ও জ্বালানির অভাবে অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্রকেই অলস বসিয়ে রাখতে হয়েছে। যদিও চুক্তি অনুযায়ী অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ডলারে নির্ধারিত মূল্যে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে পাকিস্তান সরকারকে। বিদ্যুৎ খাতের অনুৎপাদনশীল এ বিপুল পরিমাণ ব্যয় পরিশোধ করতে করতে একসময় এ অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতাই দেশটির জাতীয় অর্থনীতির সবচেয়ে বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে সার্কুলার ডেবট বা ক্রমপুঞ্জীভূত দেনার দায় বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে প্রায় দেউলিয়াত্বের দিকে চলে যায় পাকিস্তান। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বেইলআউট সুবিধায় ভর করে মহাবিপর্যয় এড়াতে সক্ষম হলেও এখনো দেশটির দায়দেনা পরিস্থিতি বিপজ্জনক পর্যায়েই রয়ে গিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। একসময় বাংলাদেশেও সক্ষমতার ঘাটতিকে বিদ্যুৎ খাতের বড় সমস্যা হিসেবে দেখা হয়েছে। সরকারি সুযোগ-সুবিধায় নির্মাণ করা হয়েছে একের পর এক আইপিপি। স্থানীয় ও বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিয়ে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। যদিও সে অনুযায়ী বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানো যায়নি। অবহেলিত থেকে গিয়েছে স ালন ব্যবস্থায় বিনিয়োগও। এ নিয়ে গৃহীত প্রকল্পগুলোর অগ্রগতিও এখন পর্যন্ত খুব একটা সন্তোষজনক নয়। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার দুপুরে দেশব্যাপী জাতীয় গ্রিডের বিপর্যয় এ সংকটকেই আবারো সামনে তুলে এনেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের ভাষ্যমতে, জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের প্রধান কারণ হতে পারে দুটি। প্রথমত, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদনের সঙ্গে স ালন ব্যবস্থা সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। দ্বিতীয় কারণ হতে পারে অব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ দুটি বিষয়ের যেকোনোটি গতকালের বড় এ বিভ্রাটের পেছনে প্রধান প্রভাবকের ভূমিকা রাখতে পারে।
দেশে বিদ্যুতের স ালন লাইন নির্মাণ, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি করে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। গতকালের বিভ্রাট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গ্রিড লাইনের এক সেকেন্ডের জটিলতা দীর্ঘ সময়ের বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। এটি যেকোনো সময় ঘটতে পারে। তবে ভোল্টেজ ওঠানামা বা ওভারলোডের মতো জটিলতা দেখা দিলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। এ নিয়ে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়ার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এর আগে ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর জাতীয় গ্রিডে এমন বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। ওই সময় ভেড়ামারায় ভারত ও বাংলাদেশের স ালন লাইনের সংযোগস্থলের ত্রুটি থেকে এ বিপর্যয়ের সূত্রপাত ঘটেছিল।
পাওয়ার সেলের তথ্য অনুযায়ী, ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ দেশে এখন বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় পৌনে ২৬ হাজার মেগাওয়াট। যদিও এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে চলতি ২০২২ পঞ্জিকাবর্ষের ১৬ এপ্রিল। ওই দিন দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট।
উৎপাদন সক্ষমতা সর্বোচ্চে পৌঁছলেও এখনো স ালন ব্যবস্থার দুর্বলতা রয়েই গিয়েছে। যদিও গত এক দশকে এ দুর্বলতা কাটাতে অর্ধশতাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে পিজিসিবি। যদিও সংস্থাটির প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। পিজিসিবি-সংশ্লিষ্টরাও বিভিন্ন সময়ে দেশের স ালন ব্যবস্থার দুর্বলতার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে এ দুর্বলতার জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ, গ্রামেগঞ্জে ছড়ানো-ছিটানো লাইন, সিস্টেম দুর্বলতা, পুরনো প্রযুক্তিসহ নানা বিষয়কে দায়ী করেছেন তারা।
এর সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিদ্যুৎ খাতের জন্য এখন বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারের মূল্য পরিস্থিতি। দেশে বিদ্যুৎ খাতের নির্মাণাধীন বড় প্রকল্পগুলোর মধ্যে রূপপুর বাদে বাকি সবই কয়লাভিত্তিক। এগুলোয় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার্য কয়লার সংস্থান করা হচ্ছে আমদানির মাধ্যমে। সম্ভাব্য উৎস ধরা হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে। ইউরোপীয় দেশগুলোও এখন এ তিন দেশ থেকে কয়লা আমদানি বাড়িয়েছে। বাজারে আগ্রহী ক্রেতার সংখ্যা বেশি হয়ে যাওয়ায় দেশ তিনটি থেকে সরবরাহকৃত কয়লার দামও এখন অনেক বেশি।
অন্যদিকে মূল্যে অস্থিতিশীলতার কারণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রাখতে হচ্ছে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এছাড়া দেশে রিলায়েন্স ও ইউনিক গ্রুপের দুটি এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের (প্রতিটি ৭৫০ মেগাওয়াটের) নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ থাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির সময়মতো উৎপাদনে আসা নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে।
স ালন ব্যবস্থায় দুর্বলতা থেকে গেলেও বিদেশী ঋণে বিদ্যুৎ খাতের মনোযোগ এখনো একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনেই নিবদ্ধ। দেশে বিদ্যুৎ খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা স ালন ব্যবস্থার ঘাটতিতে উৎপাদন সক্ষমতা সময়মতো কাজে লাগাতে না পারার বড় উদাহরণ হতে যাচ্ছে প্রকল্পটি। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সিংহভাগ অর্থায়ন করেছে রাশিয়া। প্রকল্পে দেশটির দেয়া ঋণের পরিমাণ ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের শেষ নাগাদ প্রকল্পটির প্রথম ইউনিট উৎপাদনক্ষম হয়ে ওঠার কথা রয়েছে। কিন্তু সাত প্যাকেজের আওতায় বাস্তবায়নাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির স ালন লাইন নির্মাণের কাজে এখন পর্যন্ত সার্বিক অগ্রগতি ৪০-৪৫ শতাংশ। এর মধ্যে যমুনা ও পদ্মা নদীর এপার-ওপার স ালন লাইন নির্মাণে গৃহীত প্যাকেজটির অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। কাজ এগিয়ে নিতে এরই মধ্যে প্যাকেজটিকে ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে পিজিসিবি। এ কাজ কবে নাগাদ শেষ হবে সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে কোনো তথ্য দিতে পারছে না কেউই। প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে ২০২৭ সাল নাগাদ। স ালন ব্যবস্থার উন্নয়ন না করে বা সার্বিকভাবে বিদ্যুৎ খাতের অব্যবস্থাপনাগুলো নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে এলে তা সার্বিকভাবে গোটা খাতকেই আর্থিকভাবে আরো নাজুক অবস্থানে ঠেলে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যাংকের কাছ থেকে নেয়া ঋণের ভিত্তিতে এখনো অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশী বিভিন্ন ব্যাংক ও সংস্থার কাছ থেকে নেয়া ঋণের ভিত্তিতে বর্তমানে দেশে ১৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ চলছে। এর মধ্যে পটুয়াখালীর পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হয়েছে চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতার ভিত্তিতে। মোট ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে এ প্রকল্পে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ দিয়েছে ১৫ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দুটি ইউনিট এরই মধ্যে উৎপাদনে এসেছে। যদিও এখনই পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদনে যেতে পারছে না বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
সমান সক্ষমতার আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে বাগেরহাটের রামপালে। এজন্য ভারতের এক্সিম ব্যাংক ঋণ দিয়েছে ১০ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা। বিদেশী ঋণে পটুয়াখালীতে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড ও নরিনকো। এ প্রকল্পে চীনা ঋণ ৭ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) শাহজীবাজার, শ্রীপুর, বিবিয়ানা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। এসব প্রকল্পে সংস্থাটির দেনা তৈরি রয়েছে ৩ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা। এছাড়া আশুগঞ্জ পাওয়ারে দুই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ২ হাজার ১০৮ কোটি টাকা, ঘোড়াশালে দুই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ২ হাজার ৯১৭ কোটি ও নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (এনডব্লিউপিজিসিএল) দুই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ২ হাজার ৩৩১ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের তৃতীয় ইউনিট, কড্ডা, সৈয়দপুর, খুলনা ও ময়মনসিংহে পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বিদেশী ঋণ রয়েছে ৪ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো এসব ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সে দায়দেনা মেটাতে হবে সরকারকেই।
বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করছে সরকার। এগুলোর আর্থিক সুফল পাওয়া না গেলে সার্বিক অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তারা মনে করছেন, বিদ্যুৎ খাতের আর্থিক ভারসাম্য আনা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। খাতটিতে এখন চাহিদার তুলনায় সক্ষমতায় বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ছে না। এতে করে সরকারও খাতটিতে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম বলেন, বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ হলো বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, স ালন ও বিতরণ অবকাঠামোর আধুনিকায়ন। আমাদের বিদ্যুৎ খাতে বেশি গুরুত্ব পায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ। স ালন ও বিতরণ অবকাঠামোয় বিনিয়োগ, নির্মাণ অগ্রগতিতে বরাবরই ধীরগতি দেখা গিয়েছে। যে কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো গেলেও স ালন অবকাঠামোর অভাবে তা পরিপূর্ণভাবে পরিচালন করা যায়নি। এর আর্থিক ক্ষতিও এখন আমরা দেখছি।
তথ্যমতে, বর্তমানে রূপপুর বাদে অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সরকারের নেয়া ঋণের মোট স্থিতি ৪৯ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা। প্রকল্পগুলোর অর্থায়নকালে গ্যারান্টার হিসেবে মুনাফার নিশ্চয়তা দিয়েছে সরকার। যদিও প্রকল্পগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আর্থিক সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। আবার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ইউনিটপ্রতি টাকায় পরিশোধ করা হলেও তা নির্ধারণ করা হচ্ছে ডলারে। সেক্ষেত্রে মুদ্রাবাজারে ডলারের বর্তমান ঊর্ধ্বগতি খাতটিকে আর্থিকভাবে আরো নাজুক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
গোটা বিশ্বে বাংলাদেশ ছাড়া এভাবে বিদ্যুতের মূল্যায়ন হয় শুধু পাকিস্তানে। বর্তমান বিপর্যয়কর মুহূর্তেও দেশটির বিদ্যুৎ খাতের সার্কুলার ডেবট নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না পাকিস্তান। দেশটির সরকার কোনো একটি পক্ষকে বিদ্যুতের জ্বালানি ব্যয়, মূল্য বা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধে ব্যর্থ হলে গোটা খাতজুড়ে ঋণের যে দুষ্টচক্র তৈরি হয় সেটিকেই অভিহিত করা হয় সার্কুলার ডেবট হিসেবে।
পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটির সরকার বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রকে মোট ৫৬ হাজার ৪০০ কোটি বিলিয়ন রুপি পরিশোধ করেছে। এর পরেও দেশটিতে সার্কুলার ডেবটের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩০০ কোটি ডলারে। আইএমএফসহ দাতা সংস্থাগুলো সার্কুলার ডেবট নিয়ন্ত্রণের শর্ত দিলেও এখনো তা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
দেশটির ন্যাশনাল ইলেকট্রিক পাওয়ার রেগুলেটরি অথরিটির (এনইপিআরএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছর (জুলাই-জুন) শেষে পাকিস্তানের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৪ হাজার মেগাওয়াটে। বিপর্যয়ের মধ্যেও দেশটি ক্রমাগত বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়ে গিয়েছে। এর দুই মাস আগেও গত অর্থবছরের এপ্রিল শেষে দেশটির বিদ্যুৎ খাতের সক্ষমতা ছিল সাড়ে ৪১ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। ২০৩০ সালের মধ্যেই এ সক্ষমতা ৫৭ হাজার মেগাওয়াট ছাড়ানোর প্রাক্কলন রয়েছে। যদিও দেশটিতে গ্রীষ্মকালে পিক আওয়ারেই বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা কখনো ২৬ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে ওঠেনি।