পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়তে যাচ্ছে। এই সরকারের আমলে ১২ বার বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের নতুন দাম ঘোষণা হবে আজ বৃহস্পতিবার (১৩ অক্টোবর)। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য (গ্যাস) মো. মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী বিদ্যুতের দাম বাড়ার সিদ্ধান্তের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তবে বিদ্যুতের দাম কেমন বাড়ছে তিনি জানাননি। তিনি বলেন, আগামী বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১১টায় বিদ্যুতের পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
জানা গেছে, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির লক্ষে গত ১৮ মে গণশুনানি হয়। নিয়ম অনুযায়ী গণশুনানির পর ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিয়ম রয়েছে। গণশুনানির ৯০ কার্যদিবসের সময়সীমা শেষ হবে আগামী ১৪ অক্টোবর। এর আগে, যেকোনও দিন বিদ্যুতের দাম বাড়ার ঘোষণা আসতে পারে বলে গত রোববার জানিয়েছিলেন বিইআরসি চেয়ারম্যান আবদুল জলিল। এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে সেদিন বিইআরসি চেয়ারম্যান বলেন, আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই দাম ঘোষণা করব। ৫০-৬০ পৃষ্ঠার একটি রায়, প্রতিটি শব্দ দেখে দিতে হয়। এজন্য একটু সময় লাগছে। রায় ঘোষণার কাজটি ফাইনাল স্টেজে আছে।
বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানো হয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) জন্য। পিডিবি গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। কারিগরি কমিটি তাদের সুপারিশে বলেছে, ভোক্তা পর্যায়ে দাম না বাড়ালে পাইকারি মূল্যহার কার্যকর করা সম্ভব হবে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই দাম বৃদ্ধির প্রভাব গ্রাহকদের ওপরও পড়বে। তবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) এক সদস্য জানান, বৃহস্পতিবার বিইআরসির পক্ষ থেকে অনুষ্ঠিতব্য সংবাদ সম্মেলনে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হবে। ভোক্তা পর্যায়ে এখনই দাম বৃদ্ধি করা হবে না।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এবার বিদ্যুতের দাম বাড়ছে ১২ দফায়। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে দলটি সরকার গঠন করার পর গত এক যুগে দেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ১১ বার। এ সময়ে পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে ৯০ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দাম বাড়ানো হয়। ওই সময় সরকারি ভর্তুকি ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ধরে পাইকারি পর্যায়ে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। একই সময়ে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। গত ৩ অক্টোবর বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) চলতি সপ্তাহে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে ঘোষণা দিয়েছে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির লক্ষ্যে গত ১৮ মে গণশুনানি হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী গণশুনানির পর ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়ার নিয়ম রয়েছে। গণশুনানির ৯০ কার্যদিবসের সময়সীমা শেষ হবে আগামী ১৪ অক্টোবর। এ সময়ের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে সাড়া পেলে দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়া হবে। এক সংবাদ সম্মেলনে বিইআরসির সদস্য মকবুল ই ইলাহী চৌধুরী বলেন, আগামী ১৩-১৪ অক্টোবরের মধ্যে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বেশি দামে যারা কিনছেন, তারা রশিদ নিয়ে আমাদের জানালে দাম সমন্বয় করা হবে। দাম কার্যকরের ক্ষেত্রে ভোক্তাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। কোনো কোম্পানি মানি না মানব না, এমনটি বলার সুযোগ নেই। কেউ বললে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৫-২০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। কমিশনের প্রস্তাব এরই মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে অনুমোদন দেয়া হলে চলতি সপ্তাহে যেকোনো দিন বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা এমন সময় আসতে যাচ্ছে, যখন সাধারণ মানুষ নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে প্রাত্যহিক ব্যয় নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছে। নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে তার প্রভাব পড়বে ব্যয়ের অন্য খাতগুলোতেও। ফলে এক দফা বাড়তি ব্যয়ের চাপে পড়বে দেশের সাধারণ মানুষ। বিদ্যুতের দাম বাড়ার ঘোষণা সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকলেও ইতোমধ্যে ডিপিডিসিসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি গ্রাহকের টাকা কেটে নেয়া শুরু করেছে বলে রাজধানীর মিরপুরের এবং মোহাম্মদপুর ও শ্যামলী এলাকার গ্রাহকরা অভিযোগ করেছেন। আগামী বিজয় দিবসে দু’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের পরিকল্পনা রয়েছে। বাগেরহাটে ‘রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র’, আরেকটি ভারতের ঝাড়খ-ে নির্মাণাধীন ‘আদানি পাওয়ার প্ল্যান্ট’। এই দুই বিদ্যুৎকেন্দ্রই বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগে নির্মাণ করা হচ্ছে। এই দুই বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন হলে এর থেকে ২ হাজার ২৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। আগামী ডিসেম্বর বিজয় দিবসে দু’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের চিন্তা করা হচ্ছে। আর এর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এখন কীভাবে উদ্বোধন করা হবে এ নিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এদিকে রান্নার কাজে বহুল ব্যবহৃত এলপি গ্যাসের ১২ কেজির সিলিন্ডার প্রতি ১২০০ টাকা। যা পূর্বের মাসের তুলনায় ৩৫ টাকা, আগস্টে এই দর ছিল ১২৩৫ টাকা। অটোগ্যাস লিটার প্রতি ৫৫ দশমিক ৯২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন দর গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকে কার্যকর হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। গত ৩ অক্টোবররোববার ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন দর ঘোষণা করে বিইআরসির চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল। এ সময় উপস্থিত কমিশনের সদস্য মোহাম্মদ আবু ফারুক, মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী, মোহাম্মদ বজলুর রহমান, কামরুজ্জামান, বিইআরসির সচিব খলিলুর রহমান খান। টানা কয়েকমাস ঊর্ধ্বমুখী থাকার পর মে মাসে থেকে কমতে থাকে এলপি গ্যাসের দাম। চলতি মাসেও এলপি গ্যাসের দর কমলেও ডলারের দর ঊর্ধ্বমুখিতার কারণে সেই সুবিধা থেকে বি ত বাংলাদেশের ভোক্তারা। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বাড়ন্ত এলপি গ্যাসের দর এপ্রিলে (১২ কেজি) গিয়ে দাঁড়ায় ১৪৩৯ টাকায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোর এলপিজির সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায় এ বছর। এপ্রিল মাসে (সউদী আরামকো) সর্বোচ্চ দর ওঠে প্রোপেন ৯৪০ বিউটেন ৯৬০ ডলার। ২০১৪ সালের পর আর কখনও এতো বেশি দরে বেচাকেনা হয়নি বাংলাদেশে রান্নার কাজে বহুল ব্যবহৃত জ্বালানি পণ্যটি। চলতি মাসে প্রোপেন ও বিউটেনের দাম কমে যথাক্রমে ৫৯০ ও ৫৬০ ডলার হয়েছে। প্রোপেন বিউটেনের অনুপাত ৩৫ ও ৬৫ যার গড় দর দাঁড়িয়েছে প্রতিটন ৫৭০.৫০ ডলার। দর কার্যকর হচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে বিইআরসি চেয়ারম্যান বলেন, কোনো ভোক্তা যদি বেশি দাম দিতে বাধ্য হন, তিনি যদি সেই কোম্পানির বিরুদ্ধে কমিশনে লিখিত অভিযোগ দেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
২০২১ সালের ১২ এপ্রিলের আগে পর্যন্ত এলপিজির দর ছিল কোম্পানিগুলোর ইচ্ছাধীন। ১২ এপ্রিল প্রথমবারের মতো দর ঘোষণা করে বিইআরসি। তখন বলা হয়েছিল আমদানিনির্ভর এ জ্বালানির সউদী রাষ্ট্রীয় কোম্পানি আরামকো ঘোষিত দরকে ভিত্তি মূল্য ধরা হবে। সউদীর দর উঠানামা করলে ভিত্তিমূল্য উঠানামা করবে। অন্যান্য কমিশন অরপরিবর্তিত থাকবে। ঘোষণার পর থেকে প্রতিমাসে এলপিজির দর ঘোষণা করে আসছে বিইআরসি। সাধারণত মাসের ৩ থেকে ৪ তারিখের মধ্যে দর ঘোষণা করা হয়ে থাকে। কিন্তু চলতি মাসে এ ডলারের দর নিয়ে মতবিরোধ থাকায় জটিলতা দেখা দেয়। এলপিজি ব্যবসায়ীদের দাবি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত দরে তারা ডলার কিনতে পারছে না।
এলপিজি আমদানিকারকরা অপরেশনাল কমিশন বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে আসছে। ১১টি কোম্পানি বিইআরসিতে লিখিত আবেদন দেয়। তাদের দাবি হচ্ছে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি হওয়ায় জাহাজ ভাড়া বেড়েছে, অভ্যন্তরীণ রুটেও ভাড়া বেড়েছে। সম্প্রতি কমিশনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছে। সেখানে গণশুনানির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। কোম্পানিগুলো আবেদন জমা দিলেই গণশুনানি গ্রহণ করা হবে।
বিইআরসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, কমিশন ১৫-২০ শতাংশের মধ্যে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব চূড়ান্ত করে রেখেছে। এরই মধ্যে তা বিদ্যুৎ বিভাগে জমাও দেয়া হয়েছে। সরকার চাইলে এটি বাড়াতে কিংবা কমাতে পারে। এর আগে ১৮ মে বিদ্যুতের পাইকারি (বাল্ক) মূল্যহার বৃদ্ধি নিয়ে বিইআরসির সর্বশেষ গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তিন মাসের বেশি সময় পেরোলেও এ-সংক্রান্ত কোনো ঘোষণা দেয়া হয়নি। যদিও আইন অনুযায়ী গণশুনানি সম্পন্নের ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে মূল্যসংক্রান্ত বিষয়ে ঘোষণা দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আইনি এ বাধ্যবাধকতার কারণে বিদ্যুতের মূল্য পর্যালোচনায় সংস্থাটির হাতে আর খুব বেশি সময় নেই।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, জ্বালানি তেলের রেকর্ড পরিমাণ দাম বাড়ানোর পর ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। এ কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে কিছুটা সময় নিচ্ছে সরকার। সরকারি ভর্তুকির পরিমাণ জানা গেলে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিইআরসির এক কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, শুনানির পর ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে দামের বিষয়ে আদেশ ঘোষণার আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। এরই মধ্যে তিন মাস পেরিয়ে গেছে। তাই ভর্তুকির পরিমাণ জানতে তাগাদা দিয়ে গত দ্বিতীয় দফায় চিঠি দেয়া হয়েছে। আগামী ১৩-১৪ অক্টোবরের মধ্যে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
গত ১৮ মে গণশুনানির পর ৯০ কার্যদিবসের সময়সীমা শেষ হবে আগামী ১৪ অক্টোবর। এ সময়ের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে সাড়া পেলে দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়া হবে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম ৬৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ টাকা ৫৮ পয়সা করার আবেদন করে। বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৫ টাকা ১৭ পয়সা। গ্যাসের আগের দর ইউনিটপ্রতি ৪ টাকা ৪৫ পয়সা বিবেচনায় বিপিডিবি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির এ প্রস্তাব করেছে। যদিও এরপর ইউনিটপ্রতি গ্যাসের দাম ৫৭ পয়সা বাড়ানো হয়েছে। বিপিডিবির প্রস্তাবের বিপরীতে বিইআরসির টেকনিক্যাল কমিটি প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য ভর্তুকি ছাড়া ৮ টাকা ১৬ পয়সা নির্ধারণের সুপারিশ করে। এর আগে কখনো এত উচ্চ হারে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়ার নজির নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুতের পাইকারি দর ইউনিটপ্রতি ৫ টাকা ১৭ পয়সা নির্ধারণ করা হয়।
বিদ্যুতের নতুন মূল্যহার ঘোষণার বিষয়ে জানতে চাইলে বিইআরসি সদস্য (বিদ্যুৎ) মোহাম্মদ বজলুর রহমান বলেন, এটি নিয়ে আমরা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে কাজ শেষ করেছি। ভর্তুকির বিষয়টিও সমাধান হয়েছে। যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নতুন মূল্যহার ঘোষণার বিষয়টির জন্য সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সাড়া পাওয়ার অপেক্ষা। বিদ্যুতের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার ওপরই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
গত এক যুগে দেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছেÑ ৯ বার থেকে ১১ দফায়। এ সময়ে পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে ৯০ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ গত ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দাম বাড়ানো হয়। ওই সময় সরকারি ভর্তুকি ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ধরে পাইকারি পর্যায়ে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। একই সময়ে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।
প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা ১০ থেকে ১৪ হাজারের ঘরে উঠানামা করছে। শীতের সময় এই চাহিদা ৮ থেকে ১০ হাজারে ওঠা-নামা করে। শিল্পায়নের কথা চিন্তা করে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট ও ২০৪০ সালে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। শতভাগ বিদ্যুতায়ন হয়েছে এখন বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধির একটি মাত্র পথ খোলা রয়েছে শিল্প। শিল্পায়ন হচ্ছেও; কিন্তু প্রকৃত অর্থে বিদ্যুতের চাহিদায় তারতম্য দেখা যাচ্ছে না। শিল্পে বিদ্যুতের ব্যবহার আশানুরূপ না হওয়ায় অনেকদিন ধরেই শঙ্কার কথা বলা হচ্ছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছেÑ গণহারে ক্যাপটিভ বসানো। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে মূলত বিইআরসির কাছে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয় বিপিডিবি। আমদানিকৃত স্পট এলএনজি আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম। গত জুন থেকে দেশে স্পট এলএনজি আমদানি বন্ধ রয়েছে। যদিও বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও এলএনজির দাম গত দেড় মাসে যথাক্রমে ২৫ ও ৩৫ ডলার পর্যন্ত কমেছে। সব ধরনের জ্বালানি পণ্যের দামই এখন নি¤œমুখী। রাজধানীর মিরপুরের এলাকার গ্রাহকরা অভিযোগ করেছে ফয়সাল হাকিম ফোনে বলেন, সরকার এখনো বিদ্যুতের দাম বাড়ায়নি। তার আগেই ডিপিডিসি টাকা কেটে নিচ্ছেন। তার বিল আসতো ১১ শত টাকা, সেখানে বিল দিতে হচ্ছে-২২০০ টাকা। মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা সালমা বেগম বলেন, তার টাকা কেটে নিচ্ছে। কীভাবে যাচ্ছে তা বলতে পারছে না।
সরকারের অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পগুলোর একটি রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করতে ব্যয় হচ্ছে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার সাপমারি-কাটাখালী ও কৈর্গদাশকাঠী এলাকায় ১৮৩৪ একর জমির ওপরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ভারত সরকারের কনসেশনাল ফাইন্যান্সিং স্কিমের অধীনে নির্মিত হচ্ছে। এটি বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড, ভারতের এনটিপিসি লিমিটেড এবং বাংলাদেশের পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের-পিডিবি মধ্যে একটি ফিফটি ফিফটি জয়েন্ট ভে ার কোম্পানি।
জার্মান ভিত্তিক একটি বার্তা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ) এখন দেশের অর্থনীতির গলার কাঁটা হয়ে দাড়িয়েছে। সংসদীয় কমিটির কাছে দেয়া প্রতিবেদনে ৯ মাসে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা চার্জ দেয়ার কথা জানিয়েছে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৯০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ১৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা ভাড়া দেয়া হয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে দেয়া হয়েছে এক হাজার ৬৮৫ কেটি টাকা।
পদ্মা সেতুর চেয়ে খরচ বেশি: এর আগে ২০২০-২১ অর্থ বছরে ১৮ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থ বছরে ১৮ হাজার ১২৩ কোটি টাকা। প্রায় তিন বছরে মোট ভাড়া দেয়া হয়েছে ৫৩ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। আর পদ্মা সেতু তৈরি করকে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর এই ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় ২১ হাজার ৩৯৬ মেগাওয়ট হিসবে। কিন্তু গত এপ্রিলে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদ হয়েছিলো ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। এর এখন উৎপাদিত হচ্ছে কম বেশি ১৩ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জ সমানই আছে। এই ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র- রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল, আমাদানি করা বিদ্যুৎ এবং ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারদের(আইপিপি)।
বসিয়ে রেখে ভাড়া দেয়া: ভারতের আদানি গ্রুপ এখনো বিদ্যুৎ উৎপাদনে যায়নি। ২০১৭ সালে পিডিবি তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করে। ওই চুক্তির কারণে এপর্যন্ত বাংলাদেশের কাছে তাদের পাওনা হয়েছে এক হাজার ২১৯ কোটি টাকা।
কেরানীগঞ্জের পানগাঁওয়ের এপিআর এনার্জি বিদুৎ কেন্দ্রটির ক্ষমতা ৩০০ মেগাওয়াট। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে কেন্দ্রটি থেকে মাত্র ৩৪ লাখ ৪৮ হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। যা সক্ষমতার এক শতাংশেরও কম। কিন্তু কেন্দ্রটিকে ৫৩২ কোটি ৯১ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়। ফলে আইপিপি কেন্দ্রটির প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে এক হাজার ৫৭৯ টাকা ৫৭ পয়সা। যা দেশে সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়ে। ২০২০-২১ অর্থ বছরে একই বিদ্যুৎ কেন্দ্র সাত কোটি ৭২ লাখ ইউনিট উৎপাদন করায় প্রতি ইউনিটের খরচ পড়েছে ৮৯ টাকা। এই অর্থ বছরে সবচেয়ে বেশি দাম পড়েছে ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার সিরাজগঞ্জের প্যারামাউন্ট বিট্যাক এনার্জি লিমিটেডের উৎপাদিত বিদ্যুতের। প্রতি ইউনিটের দাম পড়েছে ১৮০ টাকা। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার ৪০ থেকে ৪৮ ভাগ গড়ে অব্যবহৃত থাকে। কিন্তু তাদের ভাড়া দিতে হয়। ফলে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের অনেক দাম পড়ে যায়।
বিশ্লেষকেরা যা বলছেন: জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম বলেন,”বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ক্যাপাসিটি চার্জ একটা স্বীকৃত পদ্ধতি। কিন্তু বাংলাদেশে যা হয়েছে তা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে লাভবান করার জন্য করা হয়েছে। প্রথমত, ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি ধরা হয়েছে। দ্বিতীয়ত অপ্রয়োজনে চুক্তি করা হয়েছে। বিশেষ করে কুইক রেন্টালের ক্ষেত্রে রীতিমত লুটপাট করা হয়েছে।” তিনি বলেন,”বিদ্যুতের চাহিদাই সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে চাহিদার তুলনায় অকে বেশি পাওয়ার প্ল্যান্টের সাথে চুক্তি করা হয়েছে। এগুলো বিদ্যুতের জন্য করা হয়নি। ব্যবসা দেয়ার জন্য করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে সরকারের টাকা নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।”
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন,” ২০০৯-১০ সালের বিদ্যুৎখাত এবং এখনকার বিদ্যুৎ খাত এক নয়। তখন জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভাড়াভিত্তিক বিদুৎ কেন্দ্র গুলির সাথে চুক্তি করা হয়েছিলো। চুক্তিগুলো ছিলো তিন থেকে পাঁচ বছরের। কিন্তু এরপর এগুলোর সঙ্গে একই শর্তে কেন চুক্তি নবায়ন করা হলো আমি বুঝতে পারছি না। সম্প্রতি আরো পাঁচটির সাথে চুক্তি করা হয়েছে। এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সুবিধা দিতে করা হয়েছে।”
যখন দেখা গেলো চাহিদার চেয়ে ৪০ থেকে ৪৮ ভাগ ক্যাপাসিটি বেশি তখনই তো সিদ্ধান্ত নেয়ার দরকার ছিল। দেশ এখন একটি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন এইগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে ভাড়া দেয়া অর্থনীতির বড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন,”যদিও আমরা বলে থাকি প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমাদের গড়ে সাড়ে সাত থেকে আট টাকা যায়। কিন্তু বাস্তবে কেন্দ্র ভিত্তিক হিসাবের সাথে কুইক রেন্টাল যুক্ত করা হয় তাহলে কোনো কোনো কেন্দ্র থেকে সরকারকে প্রতি কিলোওয়াট আওয়ার বিদুৎ কিনতে হয় ৬০০ টাকায়। এটা বসিয়ে রেখে ভাড়া দেয়ার কারণে হচ্ছে। আর এর চাপ কিন্তু দেশের মানুষকে নিতে হচ্ছে।” তাই সরকারকে এখন চুক্তি বাতিল করতে হবে বা চুক্তি নবায়ন বন্ধ রাখতে হবে বলে তিনি মনে করেন।