সরকারবিরোধী আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে’ নিতে বিভাগীয় গণসমাবেশ করলেও এর মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণাও শুরু করেছে বিএনপি। দলটি ক্ষমতায় গেলে কী করবে চট্টগ্রামের গণসমাবেশে এরই মধ্যে এক দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা। সামনে অন্যান্য বিভাগে যে গণসমাবেশ আছে, সেখানেও আরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারা। এর মাধ্যমে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট বা পক্ষবলয়কে ক্ষমতায় আনার জন্য জনগণের মধ্যে একটি স্বপ্ন তৈরির পরিকল্পনা আছে বলে জানিয়েছে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতাবলয়ের বাইরে থাকা দলটি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত বুধবার দুপুরে চট্টগ্রামে ও ময়মনসিংহে দলটির বিভাগীয় সমাবেশে বক্তৃতার শেষপর্যায়ে নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি চট্টগ্রামের সমাবেশে দেশের সব রকম অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য, বিদ্যুতের মূল্য কমিয়ে আনার কথা বলেন। বেকারদের চাকরির সুযোগের ব্যবস্থা এবং কর্মসংস্থান তৈরির প্রতিশ্রুতিও দেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমি এই কথা বলতে পারি এবং জনগণ যদি এই সরকার মেনে নেয়, তাহলে যত রকম সমস্যা আছে, আমরা সেগুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে সে সমস্ত অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করব।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চাল, ডাল, তেলের দাম কমিয়ে আনার চেষ্টা করব। বিদ্যুতের দাম কমিয়ে আনার চেষ্টা করব। আমরা লেখাপড়ার সুযোগের ব্যবস্থা করে দেব।’
ফখরুল বলেন, ‘আমাদের ছেলেরা এখন বিএ, এমএ, এসএসসি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি পাস করে চাকরি পায় না। তাদের চাকরির ব্যবস্থা করে দেব। আমরা কর্মসংস্থান করব।’
ময়মনসিংহের সমাবেশে তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যদি এই সরকারকে পরিবর্তন করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তাহলে বিএনপি অবশ্যই সবার আগে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করবে, গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করবে। আমাদের ছেলেদের চাকরির ব্যবস্থা করা হবে। জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। দেশে গণতন্ত্র-শান্তি প্রতিষ্ঠা করা হবে।’ মির্জা ফখরুল দেশে বর্তমানে যেসব জ্বলন্ত সমস্যায় জনগণ ভুগছে, সেসব সমস্যা সমাধানে তার দলের প্রতিশ্রুতির কথাই তুলে আনছেন তার বক্তব্যে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে নির্বাচনী ইশতেহারে ঘরে ঘরে চাকরি, ১০ টাকা কেজি চাউল দেওয়ার প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করেছিল আওয়ামী লীগ।
বিএনপি মনে করে, এসব প্রতিশ্রুতির কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। তবে এ প্রতিশ্রুতিগুলো জনগণের মধ্যে বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে স্বপ্ন তৈরি করতে পেরেছিল, ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জয়লাভ করতে সহায়তা করে।
দেশে বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম বেড়েছে ব্যাপক। কোভিড-উত্তর পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও বেড়েছে বেকারত্বের সমস্যা। বিশ্বব্যাংক চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত- এ তিন মাসের আন্তর্জাতিক ও এশিয়ার দেশগুলোর বাজারদর বিশ্লেষণ করে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশসহ প্রায় সব দেশেই। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ ও ভুটানের চেয়ে বাংলাদেশে পণ্যের দাম বেশি হারে বেড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে ৩২ শতাংশ, কোমল পানীয়ের ২৮ শতাংশ, গণপরিবহনের ভাড়া ২২ শতাংশ, বিবিধ খাদ্যপণ্যের দাম ১২ শতাংশ, সবজির ১৬ শতাংশ, ডিম ও মাংসের ১২ শতাংশ, শস্যজাতীয় পণ্যের দাম ৮ শতাংশ, জ্বালানি তেলের ২০ শতাংশ ও কেরোসিনের দাম বেড়েছে ৫ শতাংশ। এদিকে গত জুনের পর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৪৮ থেকে ৫২ শতাংশ, যা গত ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর হয়েছে। গত মে থেকে ডলারের দামও বেড়েছে।
‘দ্য গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্ট ট্রেন্ডস ফর ইয়ুথ’ বা ‘বিশ্বজুড়ে তরুণদের কর্মসংস্থানের প্রবণতা ২০২২’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলও বলেছে, কোভিড-১৯ মহামারির সময় তরুণদের বেকারত্ব উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশি তরুণদের বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, যদিও জাতীয় পর্যায়ের বেকারত্বের হার মাত্র ৪ দশমিক ২ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, দেশের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা ৩ কোটি ১৫ লাখ ৬১ হাজার ৮১১, মোট জনসংখ্যার ১৯ দশমিক ১১ শতাংশ। সম্প্রতি অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে যুবগোষ্ঠীর বড় অংশ আর্থসামাজিক ঝুঁকির মধ্যে আছে। বৈষম্য আর গুণগত শিক্ষার অভাবে ৭৮ শতাংশ তরুণ মনে করেন, পড়াশোনা করে তারা চাকরি পাবেন না, গরিব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৯০ শতাংশ। চাকরি, পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণে নেই ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণ।
বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের সাধারণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ও বিদ্যুতের মূল্য কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেবে তারা। একই সঙ্গে নতুন ভোটার হওয়া তরুণ-যুবাদের আকৃষ্ট করতে বেকারদের চাকরির ব্যবস্থাসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তবে এসব সমস্যার সমাধান কীভাবে করা হবে, তার বিস্তারিত কিছু বলেননি মির্জা ফখরুল। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শুক্রবার ঠাকুরগাঁও থেকে তিনি বিশেষ প্রতিনিধি দৈনিক খবরপত্র কে বলেন, ‘আমরা এ নিয়ে কাজ করছি। সময় হলে সবকিছু আপনাদের সামনে বিস্তারিত তুলে ধরব।’ তবে বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে যে নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিল, তাতে এসব বিষয়ের কয়েকটি তুলে ধরা হয়েছিল। সেখানে অর্থনীতির অংশে বলা হয়েছিল- জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ১১ শতাংশে উন্নীত করা হবে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হার ৩ গুণ বাড়ানো হবে। রপ্তানি পণ্যের বহুমূখীকরণ করা হবে। বর্তমানে চলমান কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ করা হবে না। তবে মেগা প্রকল্পে ব্যয়ের আড়ালে সংঘটিত দুর্নীতি নিরীক্ষা করে দেখা হবে এবং এজন্য দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে। বর্তমান সরকারের শেষ দুই বছরে তড়িঘড়ি করে নেওয়া প্রকল্পগুলো পুনর্বিবেচনা করার জন্য কমিটি গঠন করা হবে।
চাকরি দেওয়ার ব্যাপারে বলা হয়েছিল- প্রথম ৩ (তিন) বছরে দুর্নীতিমুক্তব্যবস্থায় মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে ২ (দুই) লাখ মানুষকে চাকরি দেওয়া হবে। তরুণ দম্পতি ও উদ্যোক্তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য ২০ বছর মেয়াদি ঋণ চালু করা হবে। আগামী পাঁচ বছরে এক (০১) কোটি নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এক বছরব্যাপী অথবা কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত, যেটাই আগে হবে, শিক্ষিত বেকারদের বেকার ভাতা দেওয়া হবে। এদের যৌক্তিক অর্থনৈতিক উদ্যোগে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। জ্বালানি খাত নিয়ে বলা হয়েছিল- ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম বছরে বিদ্যুৎ ও আবাসিক গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা হবে না। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যে সকল প্রকার অসঙ্গতি দূর করা হবে।
তবে তার আগে বিএনপি একটি অবাধ নির্বাচন চায়। এজন্য দলটি বর্তমান সরকারের পদত্যাগসহ সংসদ বিলুপ্ত করে একটি নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করেছে। এ নির্বাচনে যারা জয়লাভ করবে তারাই পরবর্তীতে সরকার গঠন করবে। বিএনপি বলেছে, এ সরকার হবে জাতীয় সরকার। নির্বাচনে যেসব দল অংশ নেবে, তাদের সকলের প্রতিনিধি নিয়ে এ জাতীয় সরকার গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এজন্য বিএনপি একটি অভিন্ন দাবিনামা নিয়ে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তুলতে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপ করছে। এর আগে প্রথম পর্যায়ের সংলাপে প্রায় ২৩টি দলের সঙ্গে বসেছিল বিএনপি। তারা বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলন করতে সম্মতি দেয় বলে জানিয়েছিল বিএনপি। এ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চট্টগ্রামের সমাবেশে বলেছেন, ‘আজকে চট্টগ্রাম থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। আন্দোলনে পতন হবে সরকারের। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে নির্বাচন। আজকে চট্টগ্রামের সমাবেশে উপস্থিত লাখ লাখ মানুষের স্লোগান একটাই- সরকারের পতন।’ সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন কত দফার ভিত্তিতে হবে, সেই বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো কিছু জানাচ্ছে না বিএনপি। তবে দলটির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মাওলানা আবদুর রকিব জানিয়েছেন, ‘বিএনপি ১০ দফা কর্মসূচি তৈরি করেছে। এর সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণভাবে একমত পোষণ করেছি।’ তিনি বলেন, এদেশের নিরীহ আলেম-ওলামা যারা জেলখানায় বন্দী রয়েছেন, তাদের মুক্তির দাবিটি যুক্ত করার প্রস্তাব রেখেছি।’ তবে এ ব্যাপারে ভিন্নমত দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আমাদের রকীব সাহেব কিন্তু ১০ দফার কথা বলেছেন। আসলে ১০ দফা বলতে কিন্তু কিছু নেই। আমরা সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে এগ্রিড (সম্মত) দফাগুলোর কথা আমরা পরে জানাব।’ নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠন করা হলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে আমূল পরিবর্তন আনাসহ স্থায়ীভাবে গণতন্ত্র সুসংহত করার জন্য রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাবও তৈরি করছে বিএনপি। এজন্য দলটির পক্ষ থেকে শিগগির জনগণের সামনে রাষ্ট্রব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার প্রস্তাব পেশ করা হবে। যার খসড়া ইতোমধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে।
সংস্কার প্রস্তাবের উল্লেখযোগ্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে- ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন এবং সংবিধানে আনা হবে ব্যাপক সংশোধন। খসড়ায় নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভাসহ সংবিধান সংস্কার কমিশন, ইসি নিয়োগে আইন সংশোধন, বিচারব্যবস্থা সংস্কারে জুডিশিয়াল কমিশন, প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন গঠন, ন্যায়পাল নিয়োগ, অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন, রংধনু জাতি প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি রয়েছে।
এদিকে এই সংস্কার ফুর্মলা নিয়ে বিশিষ্ট নাগরিক ও সরকারবিরোধী দলগুলোর মতামতও নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে দলের নবগঠিত মিডিয়া সেল এরই মধ্যে তাদের সাংগঠনিক ১০ বিভাগের মধ্যে সিলেট, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে মতবিনিময় সভা করেছে। বাকি বিভাগগুলোতেও মতবিনিময় সভা করা হবে শিগগির বলে জানিয়েছেন মিডিয়া সেলপ্রধান বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন। এ সভার বিষয় হচ্ছে- জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রগঠনে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনোত্তর একটি জাতীয় সরকার ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ অপরিহার্য।’