সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ নেতা মিখাইল গর্বাচেভকে গত মাসে রাশিয়ার নভোডেভিচি সিমেট্রিতে তার স্ত্রী রাইসা ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মী নিকিতা ক্রুশ্চেভের কবরের পাশে সমাধিস্থ করা হয়েছে। এটা কারো জন্যই বিস্ময়কর ছিল না যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন শেষকৃত্যে অংশ নেননি। সব মিলিয়ে নভোডেভিচি এমন এক স্থানে উপনীত হলো, যেখানে ব্যর্থ সোভিয়েত নেতারা তাদের চূড়ান্ত বিশ্রামের জন্য প্রেরিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পুতিনের ভূমিকা আমাকে দুই দশক আগে রেড স্কয়ারে মধ্যরাতে পায়চারি করা অবস্থায় হওয়া একটি কথোপকথনের কথা মনে করিয়ে দেয়। ঝোঁকের বশে আমি সেখানে নিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাকে লেনিনের স্তম্ভের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, যিনি সোভিয়েত নেক্রোপলিশে সমাহিত হয়েছিলেন, এটির পেছনেই সেটা অবস্থিত। তিনি আমাকে সে জায়গাটি দেখানোর প্রস্তাব করলেন, সেখানে আমি সোভিয়েত নেতাদের কবরের সারি এবং স্তম্ভমূল দেখতে পেলাম। স্ট্যালিন থেকে শুরু করে লিওনেড ব্রেজনেভ, অ্যালেক্সেই কোসিজিন এবং জুরি অ্যান্ড্রোপভ। শেষ স্তম্ভমূলটি খালি অবস্থায় ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, অনুমান করছি এটা কি গর্বাচেভের জন্য? সেনা কর্মকর্তা উত্তর দিলেন, না, তার স্থান হচ্ছে ওয়াশিংটনে। বিদ্রূপাত্মকভাবে বলা যায়, গর্বাচেভ পশ্চিমের ওপর নির্ভর করেছিলেন এমন কিছু সম্পন্ন করার জন্য যা তিনি কখনই করতে পারতেন না, যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নকে শেষ পর্যায়ে নিয়ে আসা। তিনি ১৯৯০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন, যদিও রাশিয়ানরা ব্যাপকভাবে তাকে এখনো বিশ্বাসঘাতক হিসেবেই গণ্য করে। এটা তার দুর্ভাগ্য, ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিকভাবে ফিরে আসার চেষ্টায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি শুধু শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। গর্বাচেভ রাশিয়ায় সমালোচিত মুখ ছিলেন। ২০১২ সালে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ভিটিএসআইওএমের এক জরিপে দেখা যায়, গর্বাচেভ রাশিয়ার নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে অজনপ্রিয় ছিলেন। ৭০ শতাংশেরও বেশি রাশিয়ান বিশ্বাস করে যে তাদের দেশ গর্বাচেভের শাসনামলে ভুল পথে পরিচালিত হয়েছে। কট্টরপন্থীরা তাকে সোভিয়েত শক্তি ভেঙে দেয়ার জন্য ঘৃণা করে, এবং উদারপন্থীরা তাকে কমিউনিস্ট শাসন সংস্কারের ক্ষেত্রে অসম্ভব আদর্শ আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য অবজ্ঞা করে।
২০০০ সালের শুরুর দিকে ওয়ার্ল্ড পলিটিক্যাল ফোরামের বৈঠকে অংশ নেয়ার সময় আমি গর্বাচেভের সঙ্গে পরিচিত হই, এ থিংক ট্যাংকটি তিনি তুরিনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সংগঠনটি গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রচারের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে সংগঠনটির অনুষ্ঠানগুলোয় অতীতের স্মৃতিচারণা করা হতো। যেখানে গর্বাচেভ আগামীতে কী করা যেতে পারে এটির ওপরই আলোকপাত করতেন। তিনি তার সময়ের অন্যদের সাহচর্যে থাকতেন। এর মধ্যে সাবেক পোলিশ নেতা ওজকিয়েক জেরুসেলস্কি এবং লেক ওয়ালেসা, হাঙ্গেরির সাবেক প্রধানমন্ত্রী জিউলা হর্ন, রাশিয়ার কূটনীতিক আলেক্সান্ডার বেসমার্টনিক এবং গুটিকয়েক বাম ঘরানার শিক্ষাবিদরা ছিলেন।
গর্বাচেভের সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মধ্যবর্তী ‘তৃতীয় চোখ’ সংক্ষেপে পশ্চিমের জন্য কেতাদুরস্ত হলেও এটি শিগগিরই নব্য উদারনীতিবাদের জোয়ারে প্লাবিত হয়ে যায়। তবু আমি এটাকে পছন্দ করেছিলাম এবং মৃত সোভিয়েত রাশিয়ার এ স্বপ্নদর্শী নেতাকে আশ্চর্যজনকভাবে সমর্থন করতাম। যিনি জোর করে পরিবর্তন প্রতিহত করাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। আজ অধিকাংশ রাশিয়ান গর্বাচেভ এবং বরিস ইয়েলিসনকে রাশিয়ার দুর্ভাগ্যের অগ্রদূত গণ্য করে ঘৃণা করেন। অন্যদিকে পুতিন ব্যাপকভাবে আদেশ এবং উৎকর্ষের আদর্শ হিসেবে সমাদৃত হয়েছেন, যিনি কিনা বিশ্বমঞ্চে রাশিয়াকে নেতৃত্বের ভূমিকায় পুনরুদ্ধার করেছেন। যদিও কোনো দ্বিধা নেই, অধিকাংশ জনগণের তথ্য পাওয়ার মূল উৎস হিসেবে টেলিভিশন সংবাদে পুতিনের কঠিন নিয়ন্ত্রণ আংশিকভাবে ফুটে ওঠে। অধিকাংশ রাশিয়ানের চোখে গর্বাচেভের উত্তরাধিকার নিষ্পাপ এবং অদক্ষতায় ভরপুর, যদি এটা সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতার দৃষ্টিতে দেখা হয়। প্রচলিত বর্ণনা অনুযায়ী গর্বাচেভ ন্যাটোকে পূর্ব জার্মানিতে ১৯৯০ সালে মৌখিক প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে বিস্তৃত করার অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে তখন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্র সচিব জেমস বেকার বলেন, ন্যাটো পূর্বের রাজ্যগুলোয় ১ ইঞ্চিও আগাবে না। এটি বলার সময় গর্বাচেভ কেন্দ্রীয় ও পূর্ব ইউরোপে লিখিত প্রতিশ্রুতি ছাড়াই সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণ পরিত্যাগ করেন।
বান্তবতা হচ্ছে বেকার লিখিত প্রতিশ্রুতি দেয়ার মতো অবস্থানে ছিলেন না, এটা গর্বাচেভ জানতেন। তারও অধিক ক্ষেত্রে গর্বাচেভ গত কয়েক বছরে ন্যাটোকে পূর্বের রাজ্যগুলোয় বিস্তৃত না করার গুরুতর প্রতিশ্রুতি বারবার নিশ্চিত করলেও সেটি আর বাস্তবায়ন হয়নি। যেকোনো ক্ষেত্রে সত্যটি হচ্ছে ১৯৭৫ সালে হেলসিংকি ফাইনাল অ্যাক্টে স্বাক্ষরের পর ইউরোপের উপগ্রহগুলোয় সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণ অচল হয়ে পড়ে। এ চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ইউরোপের অধিকাংশ দেশ স্বাক্ষর করেছিল, এর মধ্যে মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি, তথ্য এবং আন্দোলনের স্বাধীনতা অন্তর্ভুক্ত ছিল। কমিউনিস্ট সরকারগুলোর তাদের জনগণের ধারাবাহিকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা, সর্বাপেক্ষা শান্তিপূর্ণ উত্থানের শৃঙ্খলের বিষয়টি চূড়ান্তভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলীন হয়ে যাওয়াকে চূড়ান্ত করে।
এখনো গর্বাচেভের আত্মসমর্পণের মিথের ক্ষেত্রে সত্যের লেশমাত্র রয়েছে। সর্বোপরি সোভিয়েত রাশিয়া যুদ্ধে পরাজিত হয়নি, যেমনটি ১৯৪৫ সালে জার্মানি ও জাপানে সংঘটিত হয়েছিল। এমনকি ১৯৯০ সালেও সোভিয়েত সেনাবাহিনীর যুদ্ধাস্ত্র অব্যবহূত অবস্থায় ছিল। এ তত্ত্বে গর্বাচেভ পূর্ব ইউরোপে জনপ্রিয় উত্থানের সময় ট্যাংকগুলোকে ব্যবহার করতে পারতেন, যেমনটি তার পূর্বসূরিরা ১৯৫৩ সালে পূর্ব জার্মানিতে, ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে এবং ১৯৬৮ সালে চেকস্লোভাকিয়ায় ব্যবহার করেছিল।
গর্বাচেভের সোভিয়েত রাজ্যকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সহিংসতাকে অবলম্বন প্রত্যাখ্যান করার ফল রক্তপাতহীন পরাজয় বয়ে আনে এবং রাশিয়ানদের মধ্যে অপমানের অনুভূতি নিয়ে আসে। এ অভিযোগের বোধ ব্যাপকভাবে ন্যাটোর প্রতি অবিশ্বাস নিয়ে আসে, যা পরবর্তী সময়ে পুতিন তার ইউক্রেনের আক্রমণে সমর্থন জোগাতে ব্যবহার করেছে। আরেকটি প্রচলিত ভুল ধারণা হচ্ছে গর্বাচেভ কার্যকর অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে ফেলেছেন। কার্যত ক্রুশ্চেভের পশ্চিমকে অর্থনৈতিকভাবে সমাধিস্থ করার প্রতিশ্রুতি পূরণ থেকে দূরে থেকে সোভিয়েত অর্থনীতি কয়েক দশক ধরেই নি¤œগামী ছিল।
গর্বাচেভ বুঝেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সঙ্গে আস্থার জায়গাটি রাখবে না, যখন বেসামরিক লোকজনের উচ্চতর জীবনযাপনের চাহিদা পূরণ করে সন্তুষ্টির বিষয়টি সামনে এসে দাঁড়াবে। কিন্তু যখন তিনি ব্রেজনেভের যুগে স্থবিরতা প্রবৃত্ত করার নীতিকে সমর্থন করলেন, তার কাছে তাদের স্থানে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো কিছুই ছিল না। বাজার অর্থনীতি কার্যকর করা সহজীকরণের পরিবর্তে তিনি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কাঠামোকে পরিত্যাগ করার দিকে ধাবিত হয়েছিলেন, যা সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থাপনাকে সমৃদ্ধ করেছিল এবং যা জাতিগত দেশাত্মবোধের পুনরুত্থানে ভূমিকা রেখেছিল।
আমার মতে, গর্বাচেভ একজন বিয়োগান্ত পরিণতির সম্মুখীন ব্যক্তি। যখন তিনি সোভিয়েত কমিউনিজমকে পুরোপুরি আঁকড়ে ধরার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছিলেন, তার ওপর বাহিনীগুলোকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ ছিল না। রাশিয়া আশির দশকে বুদ্ধিবৃত্তিক, আধ্যাত্মিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমস্যা অতিক্রম করার সংকটে ছিল। কিন্তু সোভিয়েত সাম্রাজ্য ভেঙেছে ৩০ বছর হলো, অনেক অকার্যকারিতা এটির বিনাশে ভূমিকা রেখেছে এবং যা পুরো পৃথিবীকে গ্রাস করার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। (দৈনিক বণিকবার্তা এর সৌজন্য) [স্বত্ব:প্রজেক্টসিন্ডিকেট] রবার্ট স্কিলেডেস্কি: ব্রিটিশ হাউজ অব লর্ডসের সদস্য এবং ওয়ারইউক ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক অর্থনীতি বিভাগের ইমেরিটাস প্রফেসর। তিনি রাশিয়ার বেসরকারি তেল কোম্পানি পিজেএসসি রোজনেফটে নন-এক্সিকিউটিভ পরিচালক হিসেবে ২০১৬-২১ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ভাষান্তর: তৌফিকুল ইসলাম