মানবজাতিকে সঠিকপথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। তাঁরা ছিলেন জগতবাসীর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় করুণা ও রহমত। আল্লাহর রহমতের সেই নবুয়তি ধারা হজরত আদম আ: থেকে শুরু হয়ে সমাপ্ত হয়েছে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর মাধ্যমে। তিনি শেষ নবী। তাঁর পর আর কোনো নবী এই দুনিয়ায় আগমন করবেন না। তবে তিনি রেখে গিয়েছেন একদল সোনালি মানুষ। যাদের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন- ‘রাদ্বিয়ালাহু আনহুম ওয়ারাদ্বু আনহু’ (তারা আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট)। তাদের বলা হয় ‘সাহাবা’। তারা সরাসরি রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞান লাভ করেছেন। তারা রাসূলুলল্লাহ সা:-এর প্রথম উত্তরাধিকারী। সাহাবায়ে কেরামের পর এই আসমানি সম্পদের উত্তরাধিকারী হয়েছেন সাহাবিদের পরবর্তী প্রজন্ম তাবেয়িরা। এরপর তাবেতাবেয়িরা। এভাবেই চলমান রয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আসমানি আমানত রক্ষার পবিত্র ধারা। আল্লাহ যত দিন চাইবেন এ ধারা বহমান থাকবে।
যুগে যুগে যারা এই আসমানি আমানত রক্ষা করে আসছেন, তারাই যুগের হক্কানি উলামায়ে কেরাম। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আজ আমাদের হাত পর্যন্ত পৌঁছেছে তাফসির, হাদিস, ফিকহ ও অন্যান্য ইসলামী শাস্ত্রগুলোর সুবিন্যস্ত বিশাল বিশাল গ্রন্থাবলি।
তারা আম্বিয়ায়ে কেরাম থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানকে মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তাদের কাছেই মানুষ লাভ করে কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞান। চিনতে পারে নিজের প্রভুকে। শিখতে পারে আল্লাহর বিধিবিধান। বুঝতে পারে শরিয়তকে। তারা মানুষের আসল সফলতা আখিরাতের মুক্তির চিন্তায় সর্বাধিক চিন্তাশীল। তারা দ্বীনের অতন্দ্র প্রহরী। ইসলামের বিরুদ্ধে সব ধরনের ষড়ষন্ত্রের মোকাবেলায় তারা সর্বদা সচেষ্ট।
আল্লাহ তায়ালা তাদের বানিয়েছেন নিজ একত্ববাদের অন্যতম সাক্ষ্য। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। ফেরেশতারা এবং ন্যায়নিষ্ঠ আলেমরাও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই’ (সূরা আলে ইমরান-১৮)।
আল-কুরআনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের সাথেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাদের আনুগত্যের। ইরশাদ হয়েছে- ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা আল্লাহর নির্দেশ মান্য করো, অনুসরণ করো রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা কর্তৃত্বসম্পন্ন (ন্যায়পরায়ণ শাসক ও আলেম) তাদের’ (সূরা নিসা-৫৯)।
যেকোনো শরয়ি সমস্যা নিরসনে তাদের দ্বারস্থ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মহান আল্লাহ তায়ালা। ইরশাদ করেছেন- ‘অতএব আলেম-জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করো, যদি তোমাদের জানা না থাকে’ (সূরা নাহল-৪৩)।
উবাদা ইবনে সামেত রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘ওই ব্যক্তি আমার আদর্শের ওপর নেই, যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না, ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের আলেমদের প্রাপ্য মর্যাদা দেয় না’ (মুসনাদে আহমদ-২২১৪৩, মুস্তাদরাকে হাকেম-৩৮৪)।
আবু মূসা আশআরি রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘বৃদ্ধ মুসলমান, কুরআনের আদব রক্ষাকারী ও কুরআন অনুযায়ী আমলকারী হাফেজ ও ন্যায়পরায়ণ বাদশার সম্মান করা মহান আল্লাহকে সম্মান করার অন্তর্ভুক্ত’ (আবু দাউদ-৪০৫৩)।
আবু দারদা রা: বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে বলতে শুনেছি, ‘আবিদের ওপর আলেমের ফজিলত এরূপ, যেরূপ পূর্ণিমার রাতে চাঁদের ফজিলত সব তারকারাজির ওপর। আর আলেমরা হলেন নবীদের ওয়ারিশ এবং নবীরা দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) ও দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) মিরাস হিসেবে রেখে যান না; বরং তারা রেখে যান ইলম। কাজেই যে ব্যক্তি ইলম হাসিল করল, সে প্রচুর সম্পদের মালিক হলো’ (আবু দাউদ-৩৬৪২, জামে তিরমিজি-২৬৪৬)।
হাদিসে কুদসিতে আছে, আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যে ব্যক্তি আমার কোনো ওলির সাথে দুশমনি করবে আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম’ (বুখারি-৬৫০২)।
পূর্বসূরি মনীষীদের অভিমত : ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ: বলেন, যে ব্যক্তি উলামায়ে কেরামকে অবজ্ঞা করবে তার আখিরাত ধ্বংস হবে। যে ব্যক্তি রাজা-বাদশাহদের অবজ্ঞা করবে তার দুনিয়া ধ্বংস হবে। যে ব্যক্তি নিজের ভাইকে অবজ্ঞা করবে তার মানবিকতা ধ্বংস হবে (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৮/৪০৮)।
ইমাম আহমদ ইবনে আজরায়ি রহ: বলেন, উলামায়ে কেরামের কুৎসা রটনা করা, বিশেষ করে পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামের, এটি কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। যে ব্যক্তি উলামায়ে কেরামের প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব রাখবে, এর দ্বারা তার নিজেরই ক্ষতি হবে (আরোদ্দুল ওয়াফের-১৯৭)।
এ জন্যই সালাফে সালেহিন যখন কাউকে কোনো আলেমের রব্বানির সমালোচনা করতে দেখতেন, তখন তাদের তার ধর্মের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতেন। যেমন- ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল বলেন, যদি কাউকে হাম্মাদ বিন সালামাকে কটাক্ষ করতে দেখো, তাহলে তার ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতে পারো, কেননা, তিনি বিদয়াতিদের কঠোর ছিলেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৭/৪৫০)।
ইমাম তাহাবি রহ: বলেন, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকিদা হলো- পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরাম, তাবেয়িন ও তাদের পরে আগত মুহাদ্দিসিনে কেরামের যথাযথ মর্যাদা বজায় রাখা। যে তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করবে এবং সমালোচনা করবে সে ভ্রষ্টতার মধ্যে রয়েছে (আকিদাতুত তাহাবি-৩০)।
উলামায়ে কেরামের সমালোচনার পরিণতি : উলামায়ে কেরামের প্রতি অবজ্ঞা করা ও তাদের সাথে উপহাস এবং তাদের শানে বেয়াদবি করার প্রথম ফলাফল হলো অন্তর মরে যাওয়া এবং এর সর্বশেষ পরিণাম অনেক ভয়াবহ। ইমাম হাফেজ আবুল কাসেম ইবনে আসাকির রহ: বলেন, হে ভাই জেনে রাখো, উলামায়ে কেরামের মাংস (দোষ চর্চা করা) বিষাক্ত জিনিস। আল্লাহ তায়ালার অভ্যাস হলো উলামায়ে কেরামের কুৎসা রটনাকারীকে তিনি লজ্জিত করেন (এটি কারো অজানা নয়)। যে ব্যক্তি উলামায়ে কেরামের সমালোচনা করবে আল্লাহ তার মৃত্যুর আগে তার অন্তরকে মৃত বানিয়ে দেবেন (আত-তিবয়ান ফি আদাবি হামালাতিল কুরআন : ২৭-২৯)।
কুরআন-সুন্নাহর ধারক-বাহকদের নিয়ে হাসিঠাট্টা ও অবজ্ঞা করতে করতে অন্তর থেকে মূল কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামের প্রতি প্রকৃত মূল্যবোধ দূর হয়ে যায়। ধীরে ধীরে মানুষ সিরাতে মুস্তাকিম ও আবার কেউ একেবারে ইসলাম থেকেই সটকে পড়ে।
উলামায়ে কেরামকে গালি দেয়ার শরয়ি দৃষ্টিভঙ্গি : হাল জামানায় হক্কানি উলামায়ে কেরামকে গালি দেয়া ও তাদের সাথে বিদ্বেষ রাখার মতো বিষাক্ত মানসিকতা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ যেকোনো মুসলমানকে গালি দেয়া, বিদ্বেষী মনোভাব ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করা নাজায়েজ ও ফাসেকি কাজ।
কোনো আলেমকে আলেম হওয়ার কারণে গালি দেয়া, তার সাথে শত্রুতা বা বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করা একটি কুফরি কাজ। এটি খুবই ভয়াবহ মানসিকতা। এমন মানসিকতা লালনকারী ব্যক্তি তওবা না করলে ঈমানের সাথে তার মৃত্যু হবে কি না ঘোর সন্দেহ আছে।
আল্লামা জাইনুদ্দিন ইবনে নুজাইম মিসরি রহ: (৯৭০ হি.) বলেন, ‘যদি কেউ কোনো আলেম বা ফকিহকে ব্যক্তিগত কোনো কারণ ছাড়া (আলেম হওয়ার কারণে) গালি দেয়, তাহলে সে কাফির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে’ (আল-বাহরুর রায়েক : ৫/১৩২)।
শাইখ জাদাহ আল্লামা আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ কালয়ুবি রহ: (১০৭৮ হি.) বলেন, ‘যদি কেউ ইসলামী শরিয়ত বা তা শরিয়তের সুস্পষ্ট কোনো মাসয়ালা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে, তাহলে সে কুফরি কাজ করল। যদি কেউ কোনো আলেমের সাথে ব্যক্তিগত কোনো কারণ ছাড়া (আলেম হওয়ার কারণে) শত্রুতা বা বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করে, তাহলে তার কাফির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি কেউ কোনো ফকিহ আলেমকে বা হজরত আলী রা:-এর বংশধরকে গালি দেয়, তাহলে (্একদল ফুকাহয়ে কেরামের মতে) সে কাফির হয়ে যাবে, তার স্ত্রী তিন তালাকপ্রাপ্তা হয়ে যাবে।’ (মাজমাউল আনহুর : ১/৬৯৫, ফতোওয়ায়ে হিন্দিয়া : ২/২৭০, ফতোওয়ায়ে তাতারখানিয়া : ৫/৫০৮)।
সমাজে এক শ্রেণীর নীচু প্রকৃতির মানুষকে দেখা যায়, তারা আলেমদের সাথে বেয়াদবিমূলক আচরণ করে থাকে। এটি নিঃসন্দেহে ঘোরতর অন্যায় ও অকৃতজ্ঞতার পরিচায়ক। এটি ব্যক্তি, সমাজ ও দেশের জন্য খুবই লজ্জাজনক ও দুর্ভাগ্যের বার্তাবহ।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া গাফুরিয়া মাখযানুল উলুম টঙ্গী, গাজীপুর। খতিব- আউচপাড়া জামে মসজিদ, টঙ্গী, গাজীপুর