সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৯ অপরাহ্ন

ইসলামে আমানতের গুরুত্ব

ডক্টর মো: আরিফ হোসেন লেখন
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২২

স্বামী-স্ত্রীর আমনত : স্ত্রীর রূপ-সৌন্দর্য, ভালোবাসা স্বামীর জন্য আমানত। অনুরূপ স্বামীর সৌন্দর্য, আদর ভালোবাসা স্ত্রীর জন্য আমানত। যেমন- মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা তোমাদের ভূষণ এবং তোমরাও তাদের ভূষণ (সূরা বাকারা-১৮৭)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘সতী-সাধ্বী রমণীরা স্বামীদের অনুগত হয়ে চলে এবং স্বামীদের অনুপস্থিতিতে আল্লাহ যা হিফাজত করতে বলেছেন তাই হিফাজত করে চলে (সূরা নিসা-৩৪)। মহনবী সা: বলেন, ‘যদি স্বামী স্ত্রীর দিকে তাকায় স্ত্রী তাকে খুশি করে দেয়’ (তিরমিজি-১১৬১)। এমন ভোলোবাসা শুধু স্বামীর জন্যই। সুতরাং এদের কেউ যদি পরকীয়ায় আক্রান্ত হয় তাহলে পরকালে আমানত খিয়ানতের মামলায় কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।
সন্তান আমানত : দাম্পত্য জীবনে আদৌ সন্তান হবে কি না? আর হলে পুত্র হবে না কন্যা হবে? এ ব্যাপারে স্বামী-স্ত্রীর কোনো হাত নেই। সুতরাং এ সন্তান হলো স্বামী-স্ত্রীর কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানত।
সন্তানের মানুষ গঠনে বাবা-মায়ের যে প্রভাব থাকে পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর কারোর নেই। এ জন্য মহানবী সা: বলেছেন, ‘প্রত্যেক নবজাতক ফিতরাতের (ইসলামের) ওপর জন্মগ্রহণ করে। এরপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদি বা খ্রিষ্টান অথবা অগ্নি উপাসকে পরিণত করে’ (বুখারি-১৩১৯)।
সুতরাং সন্তানকে সুশিক্ষা দেয়া, দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা মা-বাবার একান্ত কর্তব্য। এ হলো সে আমানতের হক আদায়।
সমাজ জীবনে দেখা যায় অনেক বিএ, এমএ পাস শিক্ষিতজন, এমনকি অনেক এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রিধারীর মতো উচ্চ শিক্ষিতজন, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত স্যাররা সূরা ফাতিহা শুদ্ধ করে পড়তে পারেন না। কেউ বা আদৌ কুরআন শরিফ পড়তে জানেন না, গোসলের ফরজ, তায়াম্মুমের ফরজ জানেন না, জাকাত ব্যয়ের খাত জানেন না। একজন মুসলমান ভাইকে দেখলে সালাম দেয়া, খাবার গ্রহণের সময় বিসমিল্লাহ বলতে শেখেননি, ইসলামের এমন ছোট ছোট অসংখ্য মৌলিক বিষয়ে যাদের ধারণা খুবই ক্ষীণ। এ জন্য প্রকৃতপক্ষে দায়ী কে? ভাবুন তো। সন্তান দ্বীনের ব্যাপারে গোমরাহ থাকলে মা-বাবাকে এর জন্য হাশর ময়দানে জবাবদিহি করতে হবে।
উল্টো অনেক মুসলমান সন্তানের ছোটকালে গানের মাস্টার দিয়ে নাচ-গান, অভিনয় শিখিয়ে, নামকরা মিশনারি স্কুলে বিদেশী সংস্কৃতির দীক্ষা দিয়ে গর্ববোধ করে থাকেন। অথচ তার নামাজে জানাজা পড়ানোর ক্ষেত্রে এ সন্তানের হক সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সে তাকে কোথায় রেখে যাচ্ছে? ভাবুন তো এর কী জবাব সে পরকালে দেবে?
হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে আমানত : পৃথিবীতে যত জাল হাদিসের জন্ম হয়েছে এ আমানতের অবহেলা কিংবা বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। দ্বীনি অসংখ্য ফিতনা এসব হাদিসের পথ বেয়েই মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। কুরআন নকল করা সম্ভব নয়; কিন্তু হাদিসের ব্যাপকতার কারণে তা নকল করা সম্ভব। এ জন্য মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় আমার ওপর মিথ্যা আরোপ করবে সে যেন দোজখে তার ঠিকানা প্রস্তুত করে নেয়’ (বুখারি)।
এ জন্য প্রত্যেক মুসলিমকে বিশেষ করে দ্বীনি আলেমদেরকে হাদিস বর্ণনার সময় অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। যাতে কোনো মানবের কথা কিংবা তার মনগড়া কথা হাদিস হিসেবে বর্ণনায় চলে না আসে। তাহলে তাকে মারাত্মক গুনাহগার হতে হবে।
সাক্ষীর ক্ষেত্রে আমানত : সাক্ষীর সাক্ষ্য একটি আমানত। বিচার-সালিসি, আইন-আদালতে সাক্ষীকে সঠিক সাক্ষ্য দিতে হবে। পার্থিব স্বার্থের কারণে বা হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সত্যকে মিথ্যা আবার মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করে সাক্ষ্য দেয়া সব চেয়ে বড় কবিরা গুনাহর একটি। এটি হাদিস থেকে প্রমাণিত। বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশে রাজনৈতিক হিংসা চরিতার্থ করার জন্য অনেক নিরপরাধ ইসলামী ব্যক্তিত্বকে পর্যন্ত মিথ্যা সাক্ষ্য হাজির করে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের সাথে কানেকশন দিয়ে অমানবিক নির্যাতন করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে বিভিন্ন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব যাদের অনেকে হলুদ সাংবাদিক হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। মানুষকে ঘায়েল করার এটি এখন বড় অস্ত্র।
মহান আল্লাহ এমন সাক্ষীর পার্থিব শাস্তি সম্পর্কে বলেন, ‘যারা সতী-সাধ্বী নারীদের ওপর (ব্যভিচারের) অপবাদ আরোপ করবে এবং এর সপক্ষে চারজন সাক্ষী হাজির করতে পারবে না, তাদের ৮০টি বেত্রাঘাত করবে এবং (ভবিষ্যতে) আর কখনো তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না, কারণ এরা হলো (নিকৃষ্ট) গুনাহগার। তবে এর পরে যারা তওবা করে এবং (নিজেদের) শুধরে নেয়, (তাদের কথা আলাদা) নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও বড় দয়ালু’ (সূরা আন-নূর-৫)।
আর তাদের পরকালীন শাস্তি কী নির্ধারিত? তা একমাত্র মাওলাই জানেন। আয়েশা সিদ্দিকা রা:-এর সতিত্ব নিয়ে মুনাফিকরা মিথ্যা অপবাদ রটনা করলে সূরা নূরের এ আয়াতগুলো নাজিল হয়েছিল।
সম্পদের ক্ষেত্রে আমানত : মহান আল্লাহ মানুষকে যে সম্পদ দান করেছেন তাও আমানত। এ জন্য কোনো সম্পদ যথেচ্ছা ব্যবহার করা, অপচয় করা, ইচ্ছে মতো নষ্ট করা, ধ্বংস করা, সম্পদ থেকে কারোর হক নষ্ট করা যাবে না। এমন করলে মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। যেমন অপচয় সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘কখনো অপব্যয় করো না। নিশ্চয় অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই। আর শয়তান হচ্ছে তার মালিকের বড়ই অকৃতজ্ঞ’ (সূরা বনি ইসরাইল : ২৬-২৭)।
অনুরূপভাবে কেউ যদি স্বীয় সম্পদ থেকে ছেলেমেয়েদের কারো কম-বেশি করে লিখে দেয় তাহলেও সে আমানতের খেয়ানত করবে এবং চরম গুনাহগার হবে।
প্রত্যেকটি পেশা আমানত : আমরা যে যে পেশার যে যে বিভাগে দায়িত্বে আছি সে ওই বিভাগের আমানতদার। মহান আল্ল‍াহ কিয়ামতের ময়দানে তাকে তার ওই বিভাগের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। সুতরাং শিক্ষকতার পেশায় প্রতিষ্ঠাপ্রধান, শিক্ষক, প্রদর্শক যে যে বিভাগে দায়িত্বে আছেন, মন্ত্রণালয়-সচিবালয় থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বিভাগের বিভিন্ন দফতরে যে যেখানে কর্মরত আছেন তাদের প্রত্যেকের আপন আপন দফতরের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। এ ক্ষেত্রে কেবল তারাই মুক্তি পাবে যারা দায়িত্বকে আমানতদারির সাথে পালন করেছে। আর যারা অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিয়েছে তাদের কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে এবং আজাবের স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। যেমন মহানবী সা: বলেন, ‘সাবধান তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল ও তোমাদের প্রত্যেকের আপন দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে (মুসলিম : ৪৮২৮)।
অনুরূপ কেউ যদি কারোর ওপর তার সম্পদ, সন্তান তথা পরিবারকে দেখাশোনার দায়িত্ব দেয় তাহলে এরাও সবাই তার কাছে আমানত।
পরিবেশ সংরক্ষণে আমানত : পৃথিবীকে বসবাসোপযোগী করার জন্য মহান আল্লাহ যে নির্মল বায়ুমণ্ডল, স্বচ্ছ জলরাশি, ঝলমলে আলো, নিয়ন্ত্রিত শব্দ দান করেছেন তা সবই এ বনি আদমের কাছে আমানত। সুতরাং বায়ুতে অতিরিক্ত কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গমন করে, পানিতে বর্জ্য বা দূষিত দ্রব্য ফেলে, কৃত্রিমভাবে শব্দদূষণ তৈরি করে যদি আমরা পৃথিবীকে বসবাসের অনুপযোগী করে ফেলি তাহলে স্র্রষ্টার কাছে সৃষ্টির প্রতি আমানতের বিশ্বাসঘাতকতার (অবিচারের) অপরাধে অপরাধী হতে হবে।
যেমন হাদিসে এসেছে- রাসূল সা: (আমাদেরকে) বদ্ধ পানিতে প্রস্রাব করতে নিষেধ করেছেন (মুসলিম-৬৮১)। মহানবী সা: পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য গাছ লাগানোর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ‘যেকোনো মুসলমান গাছ লাগায় কিংবা ফসল ফলায়, আর তা থেকে পাখি কিংবা মানুষ অথবা চতুষ্পদ জন্তু খায় তা তার জন্য সাদকা হিসেবে গণ্য হয় (বুখারি-২১৯৫, মুসলিম-৪০৫৫)।
এ হাদিসে ইঙ্গিত করে পরিবেশ সংরক্ষণে আমাদের দায়িত্ব কত! উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়- ইসলামে আমানতদারির গুরুত্ব কত! আমানতের বিপরীত হলো খেয়ানত বা বিশ্বাসঘাতকতা। মহানবী সা: বলেছেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি- যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে ও আমানতের খেয়ানত করে (বুখারি, মুসলিম)। মহানবী সা: আরো বলেন, ‘সর্বপ্রথম তোমাদের দ্বীন থেকে যে বিষয়টি হারিয়ে যাবে তা হলো আমানত (সুনানে কুবরা)। মহানবী সা: আরো বলেন, ‘কিয়ামতের একটি আলামত হলো মানুষ (কিয়ামতের আগে) আমানত বা গচ্ছিত সম্পদকে গণিমতের মাল হিসেবে মনে করবে (তিরমিজি)।
তবে আল্লাহর হক সম্পর্কিত আমানতের খিয়ানত প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি খাস দিলে তওবা করে আমল শুরু করে এবং স্বেচ্ছায় তার আর পুনরাবৃত্তি না ঘটায় তাহলে আশা করা যায় মহান আল্লাহ তাকে মাফ করে দেবেন। যেমন- এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ তোমরা (নিজেদের পাপের জন্য) আল্লাহর কাছে তওবা করো- একান্ত খাঁটি তওবা। আশা করা যায় (এর ফলে) তোমাদের রব তোমাদের গুনাহসমূহ মোচন করে দেবেন এবং এর বিনিময়ে তোমাদের প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতে যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত, সে দিন আল্লাহ নবী এবং তাঁর সাথী ঈমানদারদের অপমাণিত করবেন না’ (সূরা তাহরিম-৮)।
আর মানুষের হককেন্দ্রিক আমানতের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘বান্দা যতক্ষণ মাফ না করবে আল্লাহ ততক্ষণ মাফ করবেন না।’ লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com