মোহম্মদপুর টাউন হল বাজারে গত পাঁচ বছর ধরে নিত্যপণ্য কিনছেন রায়হানুল হক। পুরো মাসের চাল-ডাল-তেলের মতো পণ্যের বাজার একবারেই করে রাখেন। আগে মাসের শুরুতে ১৫ হাজার টাকার মুদি সামগ্রী কিনলে মাস পার হয়ে যেতো তার। গতবছরও মাসের প্রয়োজনীয় পণ্য ১৮ হাজার টাকায় কিনতে পেরেছেন। তবে এখন সেটা ২৩ থেকে ২৭ হাজার টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। পণ্যের পরিমাণ একই, দাম বেড়েছে। এই একবছরে এক টাকাও আয় বাড়েনি রায়হান সাহেবের। এখন এই বাড়তি টাকা কোথা থেকে আসবে- সেই চিন্তায় মাস চালাতে কাটছাঁট করছেন তিন বেলা খাবারের মেন্যুতে। কমাতে হচ্ছে পরিবার নিয়ে বাইরে ঘোরাঘুরি কিংবা রেস্তোরাঁয় খাওয়া। একেবারেই প্রয়োজন ছাড়া ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার না করা, প্রসাধনীর ব্যবহার কমানো, এমনকি সন্তানদের হাত খরচ থেকেও টান দিয়ে তবেই পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন তিনি।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, আর্থসামাজিক কোনোরকম বৈষম্য সৃষ্টি হলে মধ্যবিত্তরাই বেশি চাপে পড়েন। কারণ সামাজিক সিস্টেম তাদের পক্ষে কাজ করে না। মনোচিকিৎসকরা বলছেন, যেকোনও ধরনের পরিবর্তনে মানসিক অসঙ্গতি দেখা দেয়। এর প্রভাব পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর পড়ে। তাই সৃষ্ট পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে এখন থেকেই সামনের দিনগুলোর চাপ সহ্য ক্ষমতা রাখার মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া দরকার।
দরকার গবেষণা: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, ২০১৭ থেকে ২০২১— এই চার বছরে মূল্যস্ফীতির হার ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৭ সালে ১০০ টাকা দিয়ে যে পণ্য কেনা যেতো, ২০২১ সালে এসে সেটি কিনতে খরচ করতে হচ্ছে প্রায় ১৩১ টাকা। কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মনিটরিং সেলের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে জীবন ধারনের অত্যাবশ্যকীয় সব পণ্যের দাম ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
করপোরেট অফিসার রায়হানুল হক নিজের কথা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘গত পাঁচ বছরের মধ্যে করোনা খেয়ে দিয়েছে দুই বছর। এর পরে বেতন বাড়েনি, কখনও কখনও অনিয়মিতও। এরমধ্যে ৫০ শতাংশ দাম বাড়ার সঙ্গে দৌড়ে কিছুতেই পেরে উঠছি না। ফলে আগে পরিবার নিয়ে বাসার সময়টা যে স্বস্তিতে কাটতো, এখন আর সেটা হয় না। সবার মনমেজাজ খারাপ থাকে।’ অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ মনে করেন, এই সময়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনমান, পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা দরকার। তাহলে করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে।
এক কাতারে নিন্ম ও মধ্যবিত্ত: নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে বেকায়দায় পড়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় খোলাবাজারে খাদ্যপণ্য বিক্রি বা ওএমএস কার্যক্রমের ট্রাক সেলের লাইনে কিছুদিন আগেও ভিড় ছিল নিন্মআয়ের মানুষের। সেই চিত্র এখন বদলেছে। এখন কেবল নিন্ম আয়ের মানুষই নয়, এই সারিতে দাঁড়াচ্ছেন মধ্যম আয়ের মানুষেরাও। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে নিন্ম ও মধ্য আয়ের মানুষদের দাঁড় করিয়েছে একই লাইনে। সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরের বিভিন্ন ট্রাক সেল পয়েন্ট ঘুরে দেখা যায়, টিসিবির লাইনগুলোতে বিভিন্ন নিন্মআয়ের মানুষের ভিড় লক্ষণীয়। এসব লাইনে বিশেষত পরিবারে কর্মহীন বয়স্ক মানুষের সংখ্যাই বেশি। সম্প্রতি কথা হয় মিরপুর ১৩ নম্বরে ডেসকো অফিসের পাশে ওএমএসের ট্রাকের লাইনে অপেক্ষমাণ ষাটোর্ধ্ব নারী আমেনা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সকাল ১০টা থেকে এইখানে দাঁড়িয়ে। দুপুর ১টা বেজে গেছে। এখনও ট্রাকের কাছেই যাইতে পারি নাই। দুই নাতি-নাতনি নিয়া থাকি। ওগো বাপে আরেক জায়গায় বিয়া কইরা গ্যাছে গা। আর ওগো মায়ে ২০২০ সালে বিদেশ গেছে, আর আহে নাই। মাঝে মাঝে কিছু টাকা পাঠায়। সেই টাকায় মিলা-ঝিলায়া চলি। এহন এই টাকায় বাজার থেকে সদাই কিনলে পুরা মাস আর চলা যাইবো না। এই জায়গায় আইলে কমে চাইল-আটা কেনা যাইতাছে। তাই কষ্ট হইলেও এই লাইনেই আইসা দাঁড়াই।’ স্বামী, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি ও এক মেয়ে বাচ্চা নিয়ে পাঁচ জনের সংসার রেশমা আক্তারের। স্বামী পেশায় রিকশাচালক এবং পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম লোক। সকাল ৬টা থেকে মিরপুর গার্লস আইডিয়াল স্কুলের ওএমএসের ট্রাকের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। ১০টা বাজলেও এখনও পণ্য কিনতে পারেননি। স্বামীর আয়ে টেনেটুনে সংসার চলে জানিয়ে রেশমা আক্তার বলেন, ‘স্বামী যা আয় করে তা দিয়ে বাসাভাড়া, বাচ্চার পড়াশোনার খরচসহ সংসারের অনান্য খরচ চালাতে শেষ হয়ে যায়। খাবারের বাজার খরচ কমবেশি করে চলে। এখন চাল-ডাল-আটার যে দাম বাড়ছে, আগের এক কেজির দামে এখন আধা কেজি পাওয়া যায়। অর্ধেক দিয়া আর কয় দিন চলে? এইখানে আসলে অন্তত কিছুটা কমে পাঁচ-ছয় দিন চলার মতো চাল- আটা পাওয়া যায়। এই ট্রাকের মাল না থাকলে দিনের এক বেলার খাওনের চিন্তা বাদই দিতে হবে।’
সামাজিক মর্যাদা হারানোর ভয় মধ্যবিত্তের: বাজার পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, নিন্মবিত্ত আর মধ্যবিত্তের মধ্যে জীবন টেকানোর লড়াইয়ে পার্থক্য নেই বললেই চলে। তবে মধ্যবিত্তের সংকট ‘সামাজিক মর্যাদা হারানোর ভয়’। মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা বলছেন, দৈনন্দিন বাজার খরচ কিছুটা সাশ্রয়ী করতে লোকলজ্জার ভয় ও অস্বস্তি নিয়েই টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। আর নিন্ম আয়ের মানুষেরা বলছেন, ওএমএসের লাইনই এখন তাদের ভরসা। মাস চালাতে টালমাটাল, কিন্তু ঠিক নি¤œবিত্তের কাতারে নিজেকে ভাবতে চান না— এমন মানুষ সহজে লাইনে দাঁড়াতে পারেন না বলে জানান এক পণ্যপ্রত্যাশী। রাজধানীর একটি এলাকায় দোকান রয়েছে তার। তিনি বলেন, ‘আমার বাসা এই এলাকায় না। এতদূর আসছি, ট্রাক থেকে মাল নিবো বলে।’
ওএমএসের ট্রাকের রেশন কিনতে সবচেয়ে বিপাকে থাকেন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা। অনেক দোটানার মধ্য দিয়ে তাদের লাইনে দাঁড়াতে হয় বলে জানান তারা। কেউ দেখে ফেললে কী ধরনের আচরণ করবে সেই চিন্তাও কাজ করতে থাকে মাথার মধ্যে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গৃহিনী বলেন, ‘সব সময় আসি না। আজ আটা নিতে এসেছি, তার সঙ্গে চালও নিতে হচ্ছে। বাচ্চাদের সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে নাস্তার জন্য রুটি বানিয়ে দেই। সেই আটাই এখন ৭০-৭৫ টাকা কেজি। বাসার লোকের তো আর আয় বাড়ে নাই। কিন্তু বাচ্চাদের নাস্তায় রুটি দিতে পারবো না, এইটা ভাবলেও কষ্ট লাগে। তাই এখানে ভিড় কম থাকলে দাঁড়াই, নাহলে চলে যাই।’
সরেজমিনে কৌশল জেনে নেওয়া: শেরেবাংলা নগর থানার মোল্লাপাড়া বাজারে গত বুধবার সন্ধ্যায় বাজার করতে আসা ১০ জনের মধ্যে সাত জন জানান, আগে মাছ-মাংস একসঙ্গে হলেও এখন গেস্ট না হলে তেমন রান্না এড়িয়ে যান। খাবারের মেন্যু আগের তুলনায় কমিয়ে দিয়েছেন। বিকালের নাস্তায় বাইরে থেকে কিছু না এনে ঘরেই বানানোর চেষ্টা করেন। আগারগাঁও এলাকা থেকে ব্যক্তিগত গাড়িতে অফিসে যাওয়া ছেড়েছেন বলে জানিয়েছেন এই ১০ জনের আট জনই। বাচ্চাদের দূরের স্কুল থেকে কাছের স্কুলে এনেছেন স্কুলের বেতন ও গাড়ির তেল বাঁচানোর জন্য। সন্তানদের নিয়মিত জীবনে কোনও পরিবর্তন আনতে হয়েছে কিনা প্রশ্নে তিন জন জানান, হুটহাট ফুডপান্ডায় অর্ডার করতে নিষেধ করা হয়েছে। দশম শ্রেণিতে পড়া সন্তানদের হাত খরচ এক হাজার টাকা কমিয়ে ৫শ’ টাকা দেওয়ার কথা জানান তারা। আত্মীয় বাড়ি যেতে হলে কিছু না কিছু নিয়ে যেতে হয়, ‘সেই ঝামেলা’ এড়াতে নানা অজুহাতে যাওয়া কমিয়েছেন ৬০ শতাংশ মানুষ।
কতভাবে টিকে থাকা যায়: একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন মাহফুজুর রহমান। তার মাসিক ৪০ হাজার টাকা বেতন। জিনিসপত্রের দাম, বাড়ি ভাড়া, ইউটিলিটি বিল এতই বেড়েছে যে, তার একার আয়ে তিন জনের সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হয় তাকে। গত জুলাই মাসে স্ত্রী-সন্তানকে গ্রামের বাড়িতে রেখে এসে নিজে উঠেছেন একটা মেসে। ভাড়া চার হাজার টাকা। বাড়িভাড়া বাঁচিয়ে কোনোমতে কিছু টাকা গ্রামে পাঠিয়ে চলতে পারছেন। সমাজে চলতে, অফিসে প্রতিদিনের সামাজিকতাসহ কিছু খরচ চালিয়ে কোনোভাবেই সৎ উপায়ে জীবনযাপন সম্ভব না। তিনি বলেন, ‘অফিস থেকে ফেরার পরে প্রায় প্রতিদিনই ঝগড়া লেগে যায়। এটা নাই সেটা নাই করে জীবন চালাতে গিয়ে আমরা পরস্পরের সঙ্গে ভালোবাসার কথা বলতে ভুলে গেছি।’
গত বুধবার (৩০ নভেম্বর) অফিস থেকে ফেরার পথে মোল্লাপাড়া বাজারে মুরগি কিনতে নামেন সামিয়া। বাজারের হালচাল নিয়ে তিনি বলেন, ‘যারাই নিজেদের সীমিত আয়ে সম্মান বাঁচিয়ে চলতে চান, তাদের অবস্থা ভালো বলার কোনও সুযোগ নেই। বাসায় দুটো বাচ্চা আছে। তাদের তো পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। নদীর মাছ আগে কেনার কথা ভাবলেও এখন একদমই ছেড়ে দিয়েছি। চাষের রুই আর ব্রয়লার মুরগি কিনি। এই হচ্ছে ভালো মেন্যু। কিন্তু সেই সস্তা ব্রয়লার মুরগির দামও কেজিতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে।’ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যবিত্ত সবার আগে খাওয়া কমিয়ে দেয় উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘থিওরি বলে, কোনোরকম বৈষম্য সৃষ্টি হলে মধ্যবিত্তরাই বেশি চাপে পড়ে। মধ্যবিত্ত খাওয়া কমানোর পাশাপাশি নিয়মিত জীবন-যাপনের সব বিষয়ে খরচ কমানোর কৌশল অবলম্বন করে টিকে থাকতে চেষ্টা করে। কেননা তার সামাজিক পজিশনের কারণে সে ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। ঝুঁকি নিয়ে মধ্যবিত্তের এক অংশ পরাজিত হয়ে ফেরত আসে। আরেক অংশই কিন্তু তার অবস্থান পরিবর্তন করে বিত্তশালী হওয়ার সম্ভাবনায় যায়। ফলে এই পরিস্থিতিতে তাদের ভালো উদ্যোক্তা হওয়ার সম্ভাবনাটাকে জিইয়ে রাখার জন্য, যা করণীয় সেটায় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার বিষয়টি ভাবতে হবে।’
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক নেহাল করিম মনে করেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্তদের সব সমস্যা। না পারে জীবনমান টিকিয়ে রাখতে, না পারে নামতে। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন তারা নিয়মিত প্রোটিন খেতে পারছে না। যারা হয়তো দেশি মুরগি খেতো, তারা ব্রয়লারে নামছে। কিন্তু এরচেয়ে নামবে কী করে? তাদের কাছে ব্যাংক ব্যালেন্স নেই। ফলে সীমিত অর্থে চালানোর জন্য সন্তানের হাত খরচ কমাচ্ছে। লেখাপড়ার জন্য বাড়তি কিছু করতে চেয়েও পারছে না। সার্বিকভাবে সে বিপদের মধ্যে আছে। ফলে একধরনের হীনমন্যতা জন্মাচ্ছে। সেটা সন্তানের সামনে, সমাজের সামনে। এই পরিস্থিতিতে তার মানসিকতা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
হীনমন্যতা ও পারস্পরিক সম্পর্কের ওপরে প্রভাব পড়ার বিষয়ে মনোচিকিৎসক মেখলা সরকার বলেন, ‘যেকোনও ধরনের পরিবর্তন, সেটা দৈনন্দিন জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করলে একধরনের চাপ হয়। সেটা সামলাতে না পারলে ব্যবহারে অসঙ্গতি দেখা যায়। তখন সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর। যেকোনও না পাওয়া নিয়ে পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকে। দ্রব্যমূল্যের কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা থেকে এই দোষারোপ শুরু হয়। এখন মূলত দরকার পরিস্থিতি স্বীকার করে নিয়ে মানসিক প্রস্তুতি। পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে— সেটা খেয়াল করে সামনে আরও কিসের মুখোমুখি হতে হবে, সেই ধারণা নিয়ে পরিকল্পনা করে পারিস্পরিক পথ চলার পদ্ধতি নির্ধারণ জরুরি।’-বাংলাট্রিবিউন