শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৪ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::

বন্দি ও স্বজনদের অভিযোগ: স্বাস্থ্যঝুঁকিতে দেশের কারাবন্দিরা

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২২

কারা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশের ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগারসহ ৬৮টি কারাগারে বর্তমানে বন্দি রয়েছেন ৮৪ হাজারেরও বেশি বলে কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে। কারাগারের কম পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের বিষয়ে বন্দিদের পাশাপশি অভিযোগ রয়েছে তাদের স্বজনদেরও। কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে এমনই এক স্বজনের দেখা মেলে। তার নাম রমজান আলী। তিনি কারাগারে এসেছেন ছোট ভাইয়ের ছেলেকে দেখতে। রমজান আলী জানান, কারাগারের খাবারে কিছুই হয় না তার ভাইয়ের ছেলের। কারাগারের ভেতরে ক্যান্টিন রয়েছে। সেখান থেকেই মূলত খাবার কিনে খেতে হচ্ছে তাকে। এজন্য প্রতি সপ্তাহে ৩-৫ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে স্বজনদের। তবে রমজান আলী তার ভাইয়ের ছেলের জন্য ক্যান্টিনে খাবার খরচের টাকা নিয়মিত দিতে পারলেও অধিকাংশ বন্দির ক্ষেত্রেই তা সম্ভব হয় না। স্বাভাবিক খাবার খেয়েই তাদের জীবন ধারণ করতে হয়। কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএসএম আনিসুল হক বলেন, ‘কারাবন্দিদের খাবারের মেনুতে অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশেষ দিনের খাবারের ভাতাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। সকালের নাশতায়ও পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে পুষ্টিকর খাবারের ক্ষেত্রে কিছুটা কমতি রয়েছে। বিশেষ করে মাছ-মাংসের পরিমাণের যে বিষয়টি, এটি নিয়ে আমরাও কাজ করছি। আবার বন্দিদের যে পরিমাণ ডাল দেয়া হয়, সেটা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি। এ ধরনের বিষয়গুলো সমন্বয় করে কারাবন্দিদের জন্য পরিমাণমতো পুষ্টিকর খাবার সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে। এরই মধ্যে একজন ডিআইজিকে বন্দিদের খাবারের মেনুতে পুষ্টিকর খাবারের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য একটি প্রস্তাব তৈরি করতে বলেছি। পাশাপশি পুষ্টিবিদদের সঙ্গে কথা বলে কারাবন্দিদের খাবারের মেনু সমন্বয় করার কাজও চলমান রয়েছে।’
একজন কারাবন্দি দুপুর ও রাতে খাবার পেয়ে থাকেন। প্রতি বেলায় তাদের ভাত, ডাল ও সবজি পরিবেশন করা হয়। সঙ্গে এক বেলা মাছ বা মাংস দেয়া হয়। খাবারের ক্ষেত্রে কয়েদি ও হাজতি বন্দিদের জন্য আলাদা বরাদ্দ থাকে। একজন কয়েদি দুপুর ও রাতে ২৯১ গ্রাম চাল, ১৪৫ গ্রাম ডাল, ২৯১ গ্রাম সবজি ও ৩৬ দশমিক ৪৫ গ্রাম মাছ বা মাংস পেয়ে থাকেন। আর একজন হাজতি পান ২৪৭ গ্রাম চাল, ১৪৫ গ্রাম ডাল, ২৯১ গ্রাম সবজি ও ৩৬ দশমিক ৪৫ গ্রাম মাছ বা মাংস। খাবার তৈরিতে ৩২ দশমিক ৮০ গ্রাম লবণ, ২০ দশমিক ৫০ গ্রাম ভোজ্যতেল, ৪ দশমিক ৬১ গ্রাম পেঁয়াজ, ২ দশমিক শূন্য ৫ গ্রাম শুকনো মরিচ, ১ দশমিক শূন্য ২ গ্রাম শুকনো হলুদ, দশমিক শূন্য ৫ গ্রাম ধনিয়া ব্যবহার করা হয়। পুষ্টিগুণসম্পন্ন ও পরিমিত খাবার গুরুত্বপূর্ণ হলেও কারাজীবনে তা পাচ্ছেন না বন্দিরা। একজন প্রাপ্তবয়স্ক সীমিত আয়ের ব্যক্তির আহারের চেয়েও কম পাচ্ছেন কারাবন্দিরা। তাদের সকালের নাশতায় বৈচিত্র্যের পাশাপাশি বিশেষ দিনের খাবারের মান উন্নয়ন হলেও কমতি থেকে গেছে দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় পুষ্টিকর খাবারের। কারাবন্দিদের দুপুর ও রাতের খাবারে সবজি ও মাছ-মাংসের মতো পুষ্টিকর খাবারের উপস্থিতি জাতীয় মানদ-ের চেয়ে অনেক কম। আবার তাদের খাদ্যতালিকায় ডালের প্রয়োগ প্রয়োজনের কয়েক গুণ বেশি। এ ধরনের অপরিমিত খাবার পরিবেশন কারাবন্দিদের খাদ্যাভ্যাসজনিত রোগের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
খাদ্যাভ্যাসকে পুষ্টিকর করার লক্ষ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা রয়েছে। সেখানে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক বিভিন্ন ধরনের খাদ্য গ্রহণের মান ও পরিমাণ উল্লেখ রয়েছে। এ নির্দেশিকা অনুযায়ী, একজন প্রাপ্তবয়স্কের জন্য দুপুরে ও রাতে ২৭০ গ্রাম চাল, ৩০ গ্রাম ডাল, ৪৫০ গ্রাম সবজি ও ৫০ গ্রাম মাছ বা মাংস পরিবেশনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেখানে দুপুরে ও রাতে একজন কয়েদিকে ২৯১ গ্রাম চাল, ১৪৫ গ্রাম ডাল, ২৯১ গ্রাম সবজি ও ৩৬ দশমিক ৪৫ গ্রাম মাছ বা মাংস দেয়া হয়। আর হাজতিদের ক্ষেত্রে চাল ২৪৭ গ্রাম, ডাল ১৪৫ গ্রাম, সবজি ২৯১ গ্রাম ও মাছ বা মাংস ৩৬ দশমিক ৪৫ গ্রাম দেয়া হয়। পুষ্টিবিদদের মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির খাবার পুষ্টিকর করার জন্য মোট ক্যালরির ৬০-৭০ শতাংশ বিভিন্ন প্রকার কার্বোহাইড্রেট থেকে গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া ২৫-৩০ শতাংশ স্নেহ পদার্থ থেকে এবং ১৫-২০ শতাংশ প্রোটিন থেকে গ্রহণ করা উচিত। মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, বিচি ও বাদাম হলো প্রোটিনের প্রধান উৎস যা দেহের বৃদ্ধি, কার্যক্ষমতা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজন। রোগ প্রতিরোধ এবং খাদ্যশক্তির জন্য প্রোটিন গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণ না হলে অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগার শঙ্কা থাকে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন। তিনি বলেন, ‘একজন মানুষের দৈনিক যে ধরনের পুষ্টি দরকার, তার থেকে কম দেয়া হলে পুষ্টির চাহিদা পূরণ হবে না। আর এ পুষ্টির চাহিদা পূরণ না হলে অপুষ্টিজনিত সমস্যা হতে পারে। এজন্য প্রত্যেকের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় পরিমাণমতো পুষ্টিকর খাবার রাখতে হবে।’ জাতীয় খাদ্যগ্রহণ নির্দেশিকায় বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত পুষ্টিকর খাবারের প্লেটের মানও রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না কারাবন্দিদের ক্ষেত্রে। একজন কয়েদি দুপুর ও রাতে খাবার গ্রহণ করেন ৭৬৩ দশমিক ৪৫ গ্রাম। এ খাবারের ৬ শতাংশ হিসেবে ৪৫ দশমিক ৮০ গ্রাম মাছ বা মাংস থাকা উচিত। সেখানে একজন কয়েদি বন্দিকে মাছ-মাংসের মতো খাবার পরিবেশন করা হয় ৩৬ দশমিক ৪৫ গ্রাম। আর যেদিন গরুর মাংস পরিবেশন করা হয় সেদিন দেয়া হয় ৩৮ দশমিক ৭৮ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্কের প্লেটে খাবারের বাকি অংশে ৪ শতাংশ হিসেবে ৩০ দশমিক ৫৩ গ্রাম ডাল পরিবেশনের নির্দেশনা থাকলেও কারাবন্দিদের দেয়া হয় ১৪৫ গ্রাম ডাল। এছাড়া প্লেটে ১৫ শতাংশ শাক এবং ১৫ শতাংশ সবজি পরিবেশন করা উচিত। সে হিসেবে একজন বন্দি ১১৪ দশমিক ৫১ গ্রাম করে শাক ও সবজি পেয়ে থাকেন।
অপর্যাপ্ত খাদ্যাভ্যাস থেকে পুষ্টিহীনতার পাশাপাশি নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হয় বলে মনে করেন ডায়াবেটিস নিউট্রিশনিস্ট সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি আখতারুন্নাহার আলো। তিনি বলেন, ‘কারাবন্দিদের খাবারে ৩৬ দশমিক ৪৫ গ্রাম ওজনের যে মাছ বা মাংস দেয়া হচ্ছে, সেটা খুবই কম। একজন প্রাপ্তবয়স্কের দৈনিক অন্তত ৫০ গ্রাম মাছ বা মাংস গ্রহণ করা উচিত। এ রকম হলে কারাবন্দিদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি পেশি ক্ষয় হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া পুষ্টিহীনতা থেকে নানা ধরনের রোগাক্রান্ত হতে পারে।’ পুষ্টিবিদদের পরামর্শ নিয়ে কারাবন্দিদের খাবার তালিকা সমন্বয় করারও তাগিদ দেন তিনি।
যদিও সারা দেশের ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগারসহ ৬৮টি কারাগারে বন্দিদের নাশতায় এসেছে বৈচিত্র্য। উন্নত হয়েছে নাশতার মান। ব্রিটিশ আমল থেকে কারাবন্দি কয়েদিরা সকালের নাশতায় পেতেন ১১৬ দশমিক ৬৪ গ্রাম আটায় তৈরি একটি রুটি এবং সামান্য গুড়। হাজতিরা একই পরিমাণ গুড় পেলেও আটা পেতেন আরো কম। এ খাবারের বদলে কারাবন্দিরা এখন খিচুড়ি, রুটি-সবজি ও রুটি-হালুয়া খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এছাড়া বিশেষ দিনেও তাদের জন্য বেড়েছে বরাদ্দ। আগে দুই ঈদ, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে বন্দিদের বিশেষ খাবারের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ৩০ টাকা। এখন সেটা পাঁচ গুণ বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৫০ টাকা। তাছাড়া আদালতে নেয়া বন্দিদের জন্য আগে কোনো বরাদ্দ ছিল না। তাই অনেক ক্ষেত্রে কারাগার থেকে আদালত এবং আদালতে হাজিরা শেষে কারাগারে নেয়া পর্যন্ত দীর্ঘ সময় বন্দিদের না খেয়ে থাকতে হতো। এখন তাদের জন্য বরাদ্দ ২৬ টাকা। এত কিছু পরিবর্তনের পরও কারাবন্দিদের দুপুর ও রাতের খাবারের মেনু রয়েছে আগের মতোই।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com