সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৩ অপরাহ্ন

দেনমোহরের গুরুত্ব

ড. মো: গোলাম কিবরিয়া
  • আপডেট সময় সোমবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২২

ইসলামই আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ পাক ও তার রাসূল সা:-এর আদেশ-নিষেধগুলোকে যথাযথ মূল্যায়ন ও বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। আল্লাহ তায়ালার প্রতিটি আদেশ একেকটি ফরজ ইবাদত বা অবশ্যপালনীয়, অলঙ্ঘনীয়। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত যেমন ফরজ, স্ত্রীর দেনমোহর প্রদান করাও তেমন ফরজ। মানব ইতিহাসের মতো দেনমোহরের ইতিহাসও পুরনো। বাবা আদম ও মা হাওয়া আ:-কে সৃষ্টি করে বেহেশতের মধ্যে তাদের বিয়ে পড়ানোর পর আল্লাহ পাক বলেন, ‘হে আদম! তুমি যতক্ষণ হাওয়ার দেনমোহর পরিশোধ না করবে ততক্ষণ তার কাছে যেতে পারবে না।’ হজরত নূহ আ:, হজরত শিশ আ:, হজরত ইবরাহিম আ:, হজরত ইসমাইল আ:, হজরত মুসা আ: থেকে শুরু করে সব নবী ও রাসূলের জামানায় দেনমোহরের প্রচলন ছিল।
শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা:-এর মাধ্যমে তার উম্মতের জন্য দেনমোহর আল্লাহ পাক ফরজ করেছেন। কুরআনে পাকে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদেরকে খুশিমনে দেনমোহর পরিশোধ করো।’ (সূরা আন নিসা-৪) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘তাদের মধ্যে (স্ত্রীদের) যাদের তোমরা সম্ভোগ করেছ তাদের দেনমোহর অর্পণ করো।’ (সূরা নিসা-২৪) ‘তোমরা ন্যায়সঙ্গতভাবে তাদের দেনমোহর পরিশোধ করো।’ (সূরা নিসা-২৫)
দেনমোহরের গুরুত্ব দিতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের জন্য হালাল সতীসাধ্বী মুসলমান নারী ও তাদের সতীসাধ্বী নারী, যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে (ইসায়ি) তোমাদের আগে, যখন তোমরা তাদেরকে দেনমোহর প্রদান করো তাদেরকে স্ত্রী করার জন্য, কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য কিংবা গুপ্তপ্রেমে (পরকীয়া) লিপ্ত হওয়ার জন্য নয়। যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সাথে অবিশ্বাস করে তার শ্রম (আমল) বিফল হবে। পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ (সূরা আল মায়িদা-৫) পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক নবী সা:-কে লক্ষ্য করে বলেন, ‘হে নবী! যেসব স্ত্রীদেরকে আপনি দেনমোহর প্রদান করেছেন তারাই কেবল আপনার জন্য হালাল, অন্যরা নয়।’ (সূরা আহজাব-৫০)
দেনমোহর সম্পর্কে নবী করিম সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো নারীকে কম বা বেশি দেনমোহরে বিয়ে করল আর সে অন্তরে স্ত্রীকে দেনমোহর আদায় না করার ইচ্ছা পোষণ করল, কিয়ামতের দিন সে আল্লাহর দরবারে ব্যভিচারী হিসেবে উপস্থিত হবে।’ হুজুর সা: বলেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি দেনমোহর নির্ধারণের মাধ্যমে কোনো নারীকে বিয়ে করে অথচ আল্লাহ তায়ালা ওই ব্যক্তি সম্পর্কে জানেন যে, তার অন্তরে স্ত্রীকে দেনমোহর আদায়ের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই, তাহলে সে আল্লাহর নামে ওই মহিলার সাথে প্রতারণা করল এবং অবৈধভাবে তার লজ্জাস্থানের মালিক হলো, এ কারণে সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে ব্যভিচারীরূপে উপস্থিত হবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, সুনানে কুবরা, বায়হাকি)
রাসূল সা: দেনমোহর অনাদায়ীকে ব্যভিচারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অথচ আমাদের দেশে দেনমোহরের তেমন গুরুত্ব দিতে দেখা যায় না। অনেক মহিলা জানেনও না যে, দেনমোহর তার পাওনা। বিপরীতে যৌতুক নামের অভিশাপ সমাজ দখল করে নিয়েছে অনায়াসে। আমাদের প্রত্যেককেই মনে রাখতে হবে- দেনমোহর ফরজ ইবাদত, বান্দার হক, যা আল্লাহ মাফ করেন না। তাই অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। তবে দেনমোহর এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যেন স্বামীর পক্ষে তা আদায় করা সম্ভব হয়। স্বামী-স্ত্রীর সার্বিক অবস্থার দিকে লক্ষ রেখে তা নির্ধারণ করতে হবে। দেনমোহরের সর্বনি¤œ সীমা হচ্ছে ১০ দিরহাম; কিন্তু সর্বোচ্চ কোনো সীমা নেই। মনে রাখতে হবে! দেনমোহর বান্দার হক, যা অনাদায়ে বান্দা জান্নাতে যেতে পারবে না। তাই দেনমোহর পরিশোধ করা জরুরি।
হালাল সব বস্তু দিয়ে দেনমোহর পরিশোধ করা যায়। নগদ অর্থ, বৃক্ষ, কাপড়, স্বর্ণ, রুপা, দেনমোহরের সমপরিমাণ মূল্যের জমি ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে, দেনমোহর কেবল স্ত্রীর হক, তার পিতা-মাতা, ভাইবোনের কোনো অংশ এর মধ্যে নেই। অভিভাবকরা এই মোহরানা তছরুপ করা সম্পূর্ণ হারাম। বাসররাতে দেনমোহর ক্ষমা চাওয়ার বিধান ইসলামে নেই। বাকিতে পরিশোধ করার বিধান রয়েছে। সম্পূর্ণ পরিশোধ করা ভালো, অসুবিধা হলে বিয়ের সময় আংশিক পরিশোধ করবে, অবশিষ্ট আস্তে আস্তে পরিশোধ করবে। সম্পূর্ণ মোহর সময় নিয়ে পরিশোধ করা যায়। সম্পূর্ণ মোহর পরিশোধ করার আগে স্ত্রীর গায়ে হাত দেয়া যাবে না এ কথার ভিত্তি নেই। ভবিষ্যতে স্বামীর অর্থনৈতিক অবস্থা যদি খারাপ হয়ে যায় তবে স্ত্রী ইচ্ছে করলে আংশিক বা সম্পূর্ণ মোহরানা ক্ষমা করে দিতে পারেন। হারাম বস্তু দিয়ে দেনমোহর পরিশোধ করা যায় না।
হুজুর সা:-এর আদরের দুলালী হজরত ফাতেমা রা:-কে হজরত আলী রা:-এর সাথে বিয়ে দেয়ার সময় যে দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়েছিল তাই ইসলামের ইতিহাসে মোহরে ফাতেমি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। হজরত ফাতেমা রা:-এর মোহর সম্পর্কে আইনুল আখবার গ্রন্থকার বলেন, হজরত আবু নাজিহ রা: থেকে বর্ণিত- তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন- হজরত আলী রা: বলেন, ‘আমি হুজুর সা:-এর কাছে আমার বর্ম নিয়ে এলাম, অতঃপর তিনি তা ৪৮০ দিরহামে বিক্রি করলেন এবং এর বিনিময়ে আমাকে বিয়ে করিয়ে দিলেন।’এটি হচ্ছে ফাতেমা রা:-এর বিয়ের দেনমোহর। বাস্তবতা হচ্ছে- যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী দেনমোহর নির্ধারণ করবেন। বরের জন্য দেনমোহর যেন বোঝা না হয়ে যায় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com