তাওবা করলে, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে জীবন নতুনভাবে নবায়িত হয়। তাওবা শব্দটিই যেন একটি মহান শব্দ। যার অর্থ ফিরে আসা। তাওবার দহনেই পাপে কলুষিত আত্মা মনিবের সাথে নবরূপে মিলিত হয়। মহান আল্লাহ চান তাঁর বান্দারাও যেন গুনাহ করার সাথে সাথে তাওবা করে নেয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। সুন্দর অবয়বে সৃষ্টি করে মানুষকে দিয়েছেন শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির মর্যাদা। দিয়েছেন মহামূল্যবান বিবেক। আসমান-জমিনের সমস্ত মাখলুকাতের ওপর দিয়েছেন শ্রেষ্ঠত্ব। যদিও ফেরেশতারা সর্বদা আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন রয়েছেন। তাদের যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে তারা প্রতিনিয়ত সে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ফেরেশতাদের আল্লাহ তায়ালা অবাধ্য হওয়ার ক্ষমতাই দেননি। আর আল্লাহ মানুষকে বিবেক দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাদের প্রতি ওহি নাজিল করে সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন। ভালো-মন্দ দু’টি পথের মধ্যে যেকোনো একটি পথ বেছে নেয়ার এখতিয়ার দিয়েছেন। এখানেই ফেরেশতাসহ সব মাখলুকাতের ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। মানুষকে ভুল করার এখতিয়ার দিয়ে আবার তাওবা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে।
বান্দার তাওবা আল্লাহর কাছে অনেক প্রিয়। কেননা তাওবা শব্দের অর্থ হলো- ফিরে আসা। কখনো কখনো আমরা হেদায়াতের আলোর পথ থেকে দূরে সরে গিয়ে পাপাচারের অন্ধকারে নিজেদের নিমজ্জিত করি। কোনো কোনো পাপে সাময়িক সুখ অনুভূত হলেও পাপের পীড়া কামড় দেয় বারবার। ফলে মানসিক বিষাদ অনুভব হতে থাকে। অতঃপর আমরা তাওবা করে আল্লাহর কাছে ফিরে আসতে চাই। কিন্তু আমাদের জীবনে এমন কিছু পাপ থাকে, যে কারণে আমরা ভীষণ লজ্জিত, অনুতপ্ত। অনেক পাপ এমনও রয়েছে যা আমাদের জীবনচর্চায় পরিণত হয়েছে।
সব কিছু সত্ত্বেও আমরা যদি আল্লাহর দিকে এক বিঘত অগ্রসর হই, তবে আল্লাহ আমাদের দিকে এক হাত অগ্রসর হবেন। আর আমরা যদি আল্লাহর দিকে এক হাত অগ্রসর হই, তবে আল্লাহ আপনার দিকে দুই হাত অগ্রসর হবেন। অর্থাৎ বান্দা আল্লাহর দিকে ফিরে এলে আল্লাহ বান্দার দিকে ফিরে আসেন।
রাসূল সা: বলেন, ‘ইয়া আইয়্যুহান নাসু তুবু ইলাল্লাহ’ অর্থাৎ- হে মানবজাতি! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবা করো। এর অর্থ হলো- আল্লাহর নিকট ফিরে আসো, প্রত্যাবর্তন করো’ (মুসলিম-৭০৩৪)।
রব্বে কারিম ইরশাদ করছেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই সেই সব লোকের তাওবা কবুল করেন যারা অজ্ঞতাবশত কোনো গুনাহ করে ফেলে, তারপর জলদি তাওবা করে নেয়। সুতরাং আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে জ্ঞাত, প্রজ্ঞাময়’ (সূরা নিসা-১৭)। ওই আয়াতে ‘সু’ দিয়ে অত্যন্ত কুৎসিত ঘৃণ্য জঘন্য মন্দকাজকে বোঝানো হয়েছে।
আর, ‘বি জাহালাতিন’ অর্থাৎ- অপ্রতিরোধ্য আবেগের বশবর্তী হয়ে যে পাপকাজ করা হয়। যেমন- কুকর্মে প্ররোচনায়, রাগের বশবর্তী হয়ে, হতাশার আগুনে পুড়ে অথবা এমন কোনো মানবিক অনুভূতি ওই মুহূর্তে আপনার ওপর বিজয় হয়েছিল, তারপর আপনি ওই কাজে লিপ্ত হয়েছিলেন এটি হচ্ছে ‘জাহালাত’। আমাদের অলসতাও এক ধরনের ‘জাহালাত’ যখন আমরা ফজর সালাত ছেড়ে দিচ্ছি, শুধু অলসতার কারণে। আমাদের ক্রোধ এক ধরনের জাহালাত যখন আমরা অকারণে কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করি অথবা ক্রোধের বশবর্তী হয়ে অযথাই কারো ওপর জুলুম করি। মোবাইলের স্ক্রিনে কোনো খারাপ ছবি আসার পরও আমরা যদি তা অ্যাভয়েড করতে না পারি সেটাই ‘জাহালাত’। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বান্দা যখন নফসের কুমন্ত্রণায় পড়ে কোনো কুৎসিত পাপকাজ করে, ‘ছুম্মা ইয়া তুবুনা মিন করিব’ অর্থাৎ- তাৎক্ষণিক আবার তাওবা করে নেয় তখন আল্লাহ তায়ালা বান্দার পাপসমূহ ক্ষমা করে দেন। তাওবা করার অর্থ এই নয় যে, আমরা পাপ করার পর হতাশার ঘোরে হারিয়ে যাব, মনে মনে কল্পনা করব, আল্লাহ হয়তো আমাকে ক্ষমা করবেন না এবং নিরাশ হয়ে পড়ব- এটি তাওবা নয়; বরং তাওবা হচ্ছে- আমরা পাপ করার সাথে সাথেই আল্লাহর কাছে ফিরে আসব এবং বলব, হে প্রিয় প্রভু! আমি সজ্ঞানে আর কখনো আপনার বিধান লঙ্ঘন করব না এবং নিয়মিত অনিয়মগুলোকে শুধরে নেবো। তবে আমরা যেহেতু মানুষ, ভুল করাটা আমাদের মানবীয় গুণ, কিন্তু মুমিন হিসেবে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে ভুল করার সাথে সাথেই আমরা আবার রবের নৈকট্যে ফিরে আসব এবং তাওবা করে নেবো।
রব্বে কারিম ইরশাদ করছেন, ‘আল্লাহ ছাড়া কে আছে গুনাসমূহ ক্ষমা করবে’ (সূরা আল-ইমরান-১৩৫)! অর্থাৎ- সঠিকভাবে তাওবা করলে আল্লাহ অবশ্যই বান্দার গুনাহ ক্ষমা করবেন। তাওবা জান্নাত প্রাপ্তি ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও ভালোবাসা লাভের একটি বড় সুযোগ ও উপায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ বেশি বেশি তাওবাকারীকে ভালোবাসেন’ (সূরা বাকারা-২২২)।
হজরত আলী রা:-কে এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো- যে গুনাহ করে এবং তাওবা করে, আবার পুনরায় গুনাহ করে। আবার তাওবা করে আবার গুনাহ করে। আবার গুনাহের কাজে মশগুল হয় এবং আবার তাওবা-ইস্তিগফার করে (জানতে চাওয়া হয়)। এ রূপ করতে থাকা ব্যক্তির কী অবস্থা হবে?
হজরত আলী রা: বলেছেন, তার কর্তব্য হলো সর্বদা তাওবা-ইস্তিগফার করতে থাকা। কেননা, তাওবা-ইস্তিগফার অব্যাহত থাকলে শয়তান ব্যর্থ হয়ে যায়। শয়তান বলে, এ ব্যক্তিকে গুনাহের কাজে সর্বদা মশগুল রাখতে আমি অক্ষম।
সুতরাং বোঝা যায়, বান্দার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওবা-ইস্তিগফারের সুযোগ দান এক মহা নিয়ামতস্বরূপ। তাঁর এ নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা বিশ্ব মুসলিমের জন্য একান্ত অপরিহার্য বিষয়।
পাপ করার পর ক্ষমা প্রার্থনাকারী বান্দাকে আল্লাহ কতটা ভালোবাসেন তার বর্ণনা করতে গিয়ে নবী সা: বলেছেন, ‘সেই মহান সত্তার কসম, যার হাতে আমার জীবন! যদি তোমরা পাপ না করো, আল্লাহ তোমাদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে (তোমাদের পরিবর্তে) এমন এক জাতি আনয়ন করবেন, যারা পাপ করবে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনাও করবে। আর আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন’ (মুসলিম)। লেখক : ছাত্র, জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া, আরজাবাদ