সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২৮ অপরাহ্ন

গুলিস্তানে রহস্যজনক বিস্ফোরণ

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৯ মার্চ, ২০২৩

রাজধানীর গুলিস্তানের বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত ভবনে গতকাল বুধবার দ্বিতীয় দিনের মতো উদ্ধারকাজ শুরু হলে আরো দুই জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ও উদ্ধার করা লাশের সংখ্যা দাঁড়ালো ২০। গত মঙ্গলবার রাতে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটির উদ্ধারকাজ স্থগিত করা হয়েছিল। এদিকে বিস্ফোরণে নিহত ১৮ জনের পরিচয় জানা গেছে। বিস্ফোরণে আহত হয়েছে আরো শতাধিক লোক। ভবনের ভেতর কেউ চাপা পড়ে আছে কিনা তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। বিস্ফোরণের কারণ সম্পর্কেও এখনো কিছু জানা যায়নি। ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগীয় উপ-পরিচালক দিনমনি শর্মা মঙ্গলবার রাতে সংবাদমাধ্যমকে জনান, উদ্ধারকাজ আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। বুধবার পুনরায় উদ্ধার অভিযান শুরু করা হবে।
তিনি জানান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি, বিস্ফোরণের ফলে ভবনটির বেজমেন্ট মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ও যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে। এ অবস্থায় ভবনটিতে উদ্ধার অভিযান চালানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এসব বিবেচনায় রেখে রাত ১১টা থেকে ভবনটিতে উদ্ধার অভিযান সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, তাদের ৩০ সদস্যবিশিষ্ট একটি দল ভবনটির সামনে সারারাত থাকবেন। তারা প্রয়োজনে যেকোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। গত মঙ্গলবার (৭ মার্চ) বিকেল পৌনে ৫টার দিকে রাজধানীর গুলিস্তানে সিদ্দিক বাজারে একটি ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় অন্তত ১৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে ১৫ জন পুরুষ ও ২ জন নারী। ইতোমধ্যে আহত অবস্থায় শতাধিক ব্যক্তিকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরমধ্যে অনেকের অবস্থা গুরুতর।
বিস্ফোরণে নিহতরা হলেন মো. সুমন (২১), ইসহাক মৃধা (৩৫), মুনসুর হোসেন (৪০), মো. ইসমাইল (৪২), আল আমিন (২৩), রাহাত (১৮), মমিনুল ইসলাম (৩৮), নদী বেগম (৩৬), মাঈন উদ্দিন (৫০), নাজমুল হোসেন (২৫), ওবায়দুল হাসান বাবুল (৫৫), আবু জাফর সিদ্দিক (৩৪), আকুতি বেগম (৭০), মো. ইদ্রিস (৬০), নুরুল ইসলাম ভূইয়া (৫৫), হৃদয় (২০), সম্রাট (১৮) ও সিয়াম (১৮)। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, বিস্ফোরণের ভয়াবহতা এত বেশি ছিল যে মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো এলাকা। দেয়াল ভেঙে এসে পড়ে রাস্তায়। বহু মানুষ উড়ে এসে রাস্তায় পড়েছেন। সড়কে থাকা বহু গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পার্শবর্তী ভবনগুলোও। ভেঙে পড়েছে অনেক ভবনের কাঁচ। বাসযাত্রী থেকে শুরু করে পথচারী পর্যন্ত আশেপাশে থাকা সবাই হতাহত হয়েছেন। ঘটনার পর রিক্সা, ঠেলাগাড়ি, ট্রাক ও অ্যাম্বুলেন্সসহ যে যেভাবে পেরেছেন আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়েছেন। ‘বাঁচাও বাঁচাও’ আর্তনাদ: সন্ধ্যা ছয়টা। ঘটনাস্থল ঘিরে শত শত উৎসুক জনতা। বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত দুটি বহুতল ভবনের নিচের দিকটা যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ভবনের নিচতলার কলাপসিবল গেট বিচ্ছিন্ন হয়ে সড়কে পড়ে আছে। তার সঙ্গে রয়েছে বিধ্বস্ত একাধিক মোটরসাইকেল, রিকশা-ভ্যান। ভবনের কাচ, ইট, বালুসহ নানা কিছু ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিল সড়কে। ভবনগুলোর সামনের সড়কে ‘সাভার পরিবহন লিমিটেড’ নামের একটি বাস তখনো দাঁড়িয়ে ছিল। তবে সেটিও নিয়েছিল ধ্বংসস্তূপের চেহারা।
এ অবস্থা তৈরি হয় ঘণ্টাখানেক আগে (মঙ্গলবার বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে) সিদ্দিকবাজারের নর্থ সাউথ সড়কের সাততলা ভবনে বিস্ফোরণ থেকে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, হঠাৎ করে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। তখন নর্থ সাউথ সড়কের দুই পাশেই যান চলাচল করছিল। সদরঘাট থেকে গুলিস্তানগামী এই সড়ক ঢাকা মহানগরীর অন্যতম ব্যস্ত সড়ক। বিস্ফোরণের পর সড়কের বিভিন্ন অংশে রক্তাক্ত অবস্থায় অনেক মানুষ পড়ে ছিলেন। তাঁদের অধিকাংশই তখন সড়ক দিয়ে চলাচল করছিলেন। তাঁদের কেউ বাসের যাত্রী ছিলেন, কেউ রিকশা-ভ্যানে চড়ে ছিলেন। আবার কেউ কেউ ছিলেন পথচারী। কেউ কেউ দোকানে এসেছিলেন কেনাকাটা করতে।
ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ২০০ গজ দূরে একটি ভাসমান চায়ের দোকান চালান সোহরাব হোসেন। বিস্ফোরণের সময় তিনি দোকানে ছিলেন। তিনি মুঠোফোনে ঘটনাস্থলের সামনের কিছু দৃশ্যের ভিডিও করেছেন। সোহরাব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিস্ফোরণের পর তাঁর মনে হয়েছিল বোমা ফুটেছে। তিনি দৌড়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন, বহু মানুষ রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছেন। তাঁদের কেউ কেউ বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিলেন। এসব মানুষকে রিকশা-ভ্যানে করে তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালে পাঠানো হয়। বিস্ফোরণের পর ধারণ করা কয়েকটি ভিডিও সরবরাহ করেছেন সোহরাব হাসান। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সড়কে একটি নিথর দেহ পড়ে আছে। একটি ভিডিওতে ষাটোর্ধ্ব একজনের ছিন্নভিন্ন লাশ ভ্যানে করে তুলে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। অন্য একটি ভিডিও দেখা গেছে, স্থানীয়রা আহত কয়েকজনকে রক্তাক্ত অবস্থায় ভ্যানে করে হাসপাতালে পাঠাচ্ছেন।
বিস্ফোরণের এ ঘটনায় মোট ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন বাদে বাকি সবাই ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। তাঁদের বেশির ভাগকেই বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত ভবন থেকে মৃত বের করে আনা হয়েছে। বিধ্বস্ত ওই সাততলা ভবনের বেজমেন্টে এখনো ঢুকতে পারেননি উদ্ধারকর্মীরা। সেখানে আরও মানুষ আটক থাকতে পারেন বলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন। চা দোকানদার সোহরাব হাসানের ভাষ্য, ঘটনার সময় সড়কে যানজট ছিল না। সদরঘাটের দিক থেকে গুলিস্তানগামী যানবাহনগুলো স্বাভাবিক গতিতে চলছিল। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই দুটি বাসের যাত্রী ছিলেন। আহত ব্যক্তিরা তখন শুধু বাঁচার জন্য সহায়তা চেয়ে আর্তনাদ করছিলেন। বিস্ফোরণের পর থেকে ঘটনাস্থলে বিপুলসংখ্যক উৎসুক জনতা ভিড় করছিলেন। তাঁদের সরাতে হিমশিম খেতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশকে। সরিয়ে দেওয়া হলেও তাঁরা আবার ঘটনাস্থলের আশপাশে এসে ভিড় করছিলেন। উৎসুক জনতার কারণে আহত কাউকে উদ্ধার করার পর তাঁদের হাসপাতালে পাঠাতেও বেগ পেতে হচ্ছিল।
ফায়ার সার্ভিসের ধারণা, বিস্ফোরণ হয়েছে নর্থ সাউথ রোডের ১৮৪ নম্বর ভবনে। ভবনটি সাততলা। ভবনের বেজমেন্ট, নিচতলা ও দ্বিতীয় তলা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস বেজমেন্ট ছাড়া পুরো ভবনেই তল্লাশি চালিয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, সাততলা ভবনটির নিচতলা ও দ্বিতীয় তলার সামনের অংশ ভেঙে মূল সড়কে এসে পড়েছে। সাততলা ভবনটির উত্তর পাশে ১৮০ নম্বর ভবন। এ ভবন পাঁচতলা। ভবনের নিচতলার একটি দোকান পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এ ভবনেরও প্রতি তলার জানালার কাচ ভেঙে পড়েছে। বিস্ফোরণস্থলের ভবন লাগোয়া দক্ষিণ পাশের সাততলা আরও একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই ভবনের নিচতলার সিঁড়ির অংশ পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছিলেন। রাত ১১টা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভবন থেকে ১৫ জনের লাশ এবং ৪০ জনকে জীবিত উদ্ধার করেন বলে সংস্থাটির মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন জানিয়েছেন। আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, এ বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত ১৭ জনের লাশ এ হাসপাতালে আনা হয়েছে। আরেকজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন বলেন, বিস্ফোরণের কারণ কী, সেটা এখনো জানা যায়নি। সেনাবাহিনী ও পুলিশের বিস্ফোরক দল কাজ করছে, তারা এ বিষয়ে একটি উপসংহারে পৌঁছাবে। তিনি বলেন, ভবনের ভেতরে আরও কেউ কেউ থাকতে পারে। তবে কতজন আছে, সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়। মঙ্গলবার রাত পৌনে ১১টার দিকে ভবনের উদ্ধারকাজ স্থগিত করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক দিনমনি শর্মা প্রথম আলোকে বলেন, ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় ভবনের বেজমেন্টে উদ্ধারকাজ চালানো সম্ভব নয়। তাই উদ্ধারকাজ স্থগিত করা হয়েছে। বুধবার সকালে সেনাবাহিনী আসবে, তারপর উদ্ধারকাজ শুরু হবে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com