আজকাল বেশির ভাগ অর্থনৈতিক ভাষ্যে ‘বৈপরীত্যের (ডাইভারজেন্স)’ ওপর অধিক দৃষ্টি দেয়া হচ্ছে। আর সেই ভিন্নতাটি হলো একদিকে বৃহত্তর শেয়ারবাজারের সূচকগুলো সর্বকালের ঊর্ধ্বমুখিনতায় বিরাজ করছে, অন্যদিকে বৃহত্তর অর্থনীতি অন্যতম ভয়াবহ অধোগতি থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য লড়ছে। এদিকে যদিও রাসেল ২০০০ সূচক এখনো ৫ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে, তবে এসঅ্যান্ডপি৫০০ সূচক ও রাসেল ৩০০০ সূচক তাদের প্রাক-মহামারীর মাত্রায় পুরোপুরি ফিরে এসেছে। আবার নাসডাক সূচক, যেটি ডিজিটাল ও টেকনোলজি কোম্পানিগুলোর দিকে কিছুটা ঝুঁকে আছে, প্রায় ২৬ শতাংশ ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। অনেকেই সিদ্ধান্ত টেনেছে যে পুঁজিবাজার অর্থনৈতিক বাস্তবতা থেকে নোঙ্গর তুলছে। তবে অন্যভাবে দেখলে আজকের পুঁজিবাজারগুলো মহামারীকালীন অর্থনীতি দ্বারা সম্প্রসারিত হওয়া শক্তিশালী অন্তর্নিহিত প্রবণতাগুলোয় অংশত প্রতিফলিত হতে পারে। শেয়ারমূল্য ও বাজার সূচকগুলো মালিকদের পুঁজির মূল্য সৃষ্টির নিরিখে পরিমাপ করা হয়। যেটি অবশ্য বৃহত্তর অর্থনীতিতে মূল্য সৃষ্টির মতো একই বিষয় নয়; যেখানে শ্রম, বস্তুক ও নির্বস্তুক পুঁজি প্রত্যেকেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
অধিকন্তু, বাজারগুলো মূলধনে প্রত্যাশিত ভবিষ্যৎ প্রকৃত রিটার্নের প্রতিফলন ঘটায়। শ্রম আয়ের বর্তমান মূল্য নির্ণয়ের প্রসঙ্গ যখন আসে, তখন আসলে নিছকই কোনো তুলনাযোগ্য সম্মুখদর্শী সূচক আমাদের কাছে নেই। মূলগতভাবে তারপর যদি একটি তাৎপর্যপূর্ণ অনুমিত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার হয়েও থাকে, তাহলে পুঁজি ও শ্রম আয়ের পরিস্থিতিও একই হতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে কেবল মূলধনের প্রত্যাশিত ভবিষ্যৎই বর্তমানে প্রতিফলিত হবে। তবে গল্পের আরো দিক আছে। বাজার মূল্যমান নির্ধারণ আজকাল কেবল মালিকানা ও তথ্যের নিয়ন্ত্রণ নয়, নির্বস্তুক সম্পদের ভিত্তিতেও হচ্ছে, যা মূল্যসৃষ্টি ও নগদায়নের (মনিটাইজেশন) নিজস্ব পদ্ধতি প্রদান করে। এসঅ্যান্ডপি৫০০-এর একটি সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, কর্মীপ্রতি নির্বস্তুক পুঁজির উচ্চমাত্রা থাকা কোম্পানিগুলোর শেয়ার চলতি বছর সবচেয়ে বেশি সুফল অর্জনের (গেইন) রেকর্ড করেছে এবং কর্মীপ্রতি কম নির্বস্তুক পুঁজি থাকা কোম্পানিগুলোর শেয়ার সবচেয়ে খারাপ করেছে।
অন্য কথায়, বাজারে ও কর্মসংস্থানে প্রান্তিক মূল্য সৃষ্টি ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। যদিও এটি মহামারীর আগে বেশি সত্য ছিল, তবে এ প্রবণতা এখন আরো ত্বরান্বিত হয়েছে। এজন্য অন্তত দুটি কারণ রয়েছে। একটি হলো লকডাউনের প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবে ডিজিটাল প্রযুক্তিগুলোর দ্রুত গ্রহণ। দ্বিতীয়টি হলো, অনেক শ্রমনিবিড় খাত (যেগুলো সাধারণত শ্রম ও নির্বস্তুক পুঁজিতে মূল্য সংযোজন করে) লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব বা ভোক্তাঝুঁকি এড়ানোর ফলে অংশত বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
উদাহরণস্বরূপ, ডাউ জোনস ইউএস এয়ারলাইনস ইনডেক্স পরিষ্কারভাবে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে এবং এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। স্বাভাবিক সময়ে এ খাত প্রধানত বস্তুক পুঁজি, শ্রম নিয়ে মূল্য সৃষ্টি করে এবং ব্যবসায় শক্তির জোগান দেয় (যদিও এর ব্যবসায়ও তাৎপর্যপূর্ণ ডিজিটাল উপাদান রয়েছে)। সত্যি বলতে কি, সাধারণ বাজার মূল্যায়ন ইউএস ফেডারেল রিজার্ভ এবং অন্য প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সুদহার নীতিগুলো দ্বারা সমর্থিত হয়ে এসেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতিগুলো মূলগতভাবে কভিড-১৯ অভিঘাত মোকাবেলায় নেয়া বড় আর্থিক কর্মসূচিগুলোর অর্থায়নের জন্য ঋণ ব্যবহারে সরকারগুলোর পরিসর সৃষ্টির উদ্দেশ্যেপ্রণীত। তবে অতিনিম্ন সুদহার আজকের বাজার মূল্যায়নে কিছুটা সাধারণ সমর্থন জোগাতে পারলেও বিভিন্ন খাতজুড়ে তা লক্ষণীয় পার্থক্য সৃষ্টির জন্য দায়ী নয়। সর্বোপরি, পাবলিকলি ট্রেডেড স্টকে প্রতিফলিত না হওয়া অর্থনীতির অংশও ভুগছে (অবশ্য ডিজিটাল সেক্টরগুলোর কিছু ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানি রয়েছে, যেগুলোর মূল্যায়ন ও রিটার্ন একই ধরনের বা এমনকি পাবলিক বাজারে নির্বস্তুক পুঁজি স্পেক্ট্রামের উচ্চ প্রান্তের চেয়ে বেশি)।
আরো বৃহত্তরভাবে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো এবং ছোট-ভঙ্গুর স্থিতিপত্রের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো কোনো কার্যকর অভিঘাত প্রশমনকারী রেখে যায়নি এবং স্বাভাবিক সময়ে তাৎপর্যপূর্ণ কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী শ্রমনিবিড় খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান (হোটেল, রেস্তোরাঁ ও বার) অংশত বন্ধ হয়ে গেছে। এসব প্রবণতা মোকাবেলায় সভরেন ব্যালান্স শিটগুলো অর্থনীতির বৃহত্তর অংশের জন্য অভিঘাত প্রশমনকারী হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
কিন্তু অর্থনীতির সব ক্ষেত্রেই এমনটি হয়নি। যদিও বর্তমান সংকট আসলে কিছু কোম্পানির মূল্য চাঙ্গা করছে, সেহেতু জিজ্ঞাসা করা ভালো হবে যে বিপুল শেয়ারের মালিকানা আসলে কাদের। এসব শেয়ারের মালিকানা নিশ্চিতভাবে ব্যক্তি পরিবার এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো নয়, যাদের স্থিতিপত্রগুলো অভিঘাত প্রশমনকারী হিসেবে কাজ করার ক্ষেত্রে খুব দুর্বল। আজকের উচ্চমূল্যমানের ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানিগুলো এবং ভালো স্থিতিপত্রের প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় সমর্থন প্রদানে এরই মধ্যে যথেষ্ট শক্তিশালী প্রমাণ হয়েছে।
যখন মহামারী-পরবর্তী ধাপ দৃশ্যপটে আসবে, তখন কর্মীপ্রতি নিম্ন নির্বস্তুক পুঁজিসম্পন্ন শ্রমনিবিড় খাতগুলো একটি খারাপ নৈপুণ্যের সময় পার করতে পারে, যেহেতু সেগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় থাকবে। এমনকি এই দৃশ্যপট সত্ত্বেও অর্থনীতির ডিজিটাল পথনকশা সম্প্রসারিত হতে পারে এবং নির্বস্তুক পুঁজি ও এর মালিকদের পৃষ্ঠপোষকতা জোগানোর প্রবণতাগুলো অব্যাহত থাকবে।
এটি বিস্ময়ের নয় যে নির্বস্তুক পুঁজিনিবিড় খাতগুলোর একটি তুলনামূলক সুবিধা থাকলেও থাকতে পারে। এসব খাতের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই তাদের ব্যয় কাঠামো অস্বাভাবিকভাবে স্থির ব্যয় ও নিম্ন বা সামান্য প্রান্তিক ব্যয়ের দিকে হেলেছে। এটি কিছু প্লাটফর্মকে স্কেলেবল করে তুলবে, বিপরীতে দাম নির্ধারণ ও বাজার প্রবেশাধিকারের দিক থেকে যা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা প্রদান করবে।
এসব অর্থনৈতিক বাস্তবতা থেকে যে কেউ কিছু সিদ্ধান্ত টানতে পারে। স্টার্টারদের জন্য মহামারীকালীন অর্থনীতি তুলনামূলক কম কর্মী নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে নির্বস্তুক সম্পদমূল্য সৃষ্টির অনুকূল প্রাক-মহামারী প্রবণতাগুলোকে ত্বরান্বিত করেছে। আমরা প্রত্যাশা করি এ প্রবণতা অব্যাহত থাকবে, যদিও তা মহামারী প্রভাবিত উচ্চগতিতে না-ও চলতে পারে। গতানুগতিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দাঁড়াবে, কর্মীপ্রতি নির্বস্তুক উপাদানগুলোর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানজুড়ে মূল্য সৃষ্টির মধ্যকার বিযুক্তি বজায় থাকবে এবং এটি একটি প্রধান অর্থনৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে যাবে।
বাজার ও অর্থনীতি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হচ্ছেÍএ ধারণা সুনির্দিষ্ট সূচকগুলোর ওপর একটি সংকীর্ণ ফোকাসের প্রতিফলন ঘটায়। তবে কোনো একটি একক সূচক অর্থনৈতিক অবস্থা ও প্রবণতাগুলো বাদে সার্বিক বাজারের একটি সুফলপ্রদায়ী সারাৎসার প্রদান করে। উপরন্তু, বিভিন্ন খাত এবং সেখানে কাজ করা কর্মীদের অর্থনৈতিক সুফলে বড় ধরনের ভিন্নতা-ব্যবধানের কারণে মহামারীকালীন অর্থনীতিতে শেয়ারবাজারের সূচকগুলো আরো অধিক অস্পষ্ট হবে।
পরিশেষে, মূল্য সৃষ্টিতে ডিজিটাল নির্বস্তুক সম্পদের ব্যাপকতর অবদানের বাস্তবতায় বর্ধিষ্ণু সম্পদবৈষম্যের প্রবণতা বদলানোর একটি উপায় খুঁজে বের করা কঠিন। কারণ আয় ও সম্পদ ল্যাডার নিম্নমুখী করা প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থিতিপত্রগুলো ব্যাপকভাবে উচ্চ নির্বস্তুক ও ডিজিটাল কনটেন্ট থেকে বঞ্চিত, কাজেই বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ডিনামিক্সের সুফলগুলোকেও তার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। [স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট] মাইকেল স্পেন্স: নোবেলজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ; নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির স্টার্ন স্কুল বিজনেসের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং হুভার ইনস্টিটিউশনের জ্যেষ্ঠ ফেলো, ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির ( দৈনিক বণিকবার্তার সৌজন্যে)