সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৩ পূর্বাহ্ন

মার্কিন তেল-গ্যাস কোম্পানির প্রস্তাব

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় রবিবার, ১৯ মার্চ, ২০২৩

আবারো শীর্ষস্থানীয় মার্কিন কোম্পানির বৃহৎ আকারে গ্যাস অনুসন্ধানের প্রস্তাব। জ্বালানি খাতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ কোম্পানি এক্সনমোবিল ১৫টি ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানের প্রস্তাব দিয়েছে পেট্রোবাংলাকে। প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনার পর এখন জ্বালানি বিভাগে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। জ্বালানি বিভাগ যাচাই শেষে তা পাঠাবে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক মহলের কাছে। তবে নির্বাচনের আগে বিশ্বের বৃহৎ মার্কিন কোম্পানির এমন প্রস্তাব এরই মধ্যে দোদুল্যমানতায় ফেলেছে খাতটির নীতিনির্ধারকদের। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে মার্কিন কোম্পানির চাপ ও রফতানির সিদ্ধান্ত না নেয়ায় ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে—এমনটাই অভিযোগ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর। আবারো একই ধরনের সন্ধিক্ষণ। তবে এ মুহূর্তে গ্যাসের তীব্র সংকট থাকায় রফতানির প্রসঙ্গটি অমূলক বলে দাবি করছে পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট সূত্র। যদিও বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনীতি বিবেচনায় বিশ্বের বৃহৎ মার্কিন কোম্পানিকে এত অধিকসংখ্যক ব্লক জরিপ ও অনুসন্ধানের কাজ দেয়া যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ। এ প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এক্সনমোবিলের প্রস্তাব আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। তারা ১৫টি ব্লক চেয়েছে। আমরা সে প্রস্তাব খতিয়ে দেখে জ্বালানি বিভাগে প্রতিবেদন পাঠাব।’
নরওয়েভিত্তিক ডিএন মিডিয়া গ্রুপের জ্বালানিবিষয়ক অনলাইন সংবাদমাধ্যম আপস্ট্রিমে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন জায়ান্ট এক্সনমোবিল যদি বঙ্গোপসাগরের গভীরে সি ত বিপুল পরিমাণ গ্যাস তুলে আনতে পারে, তবে তা বাংলাদেশের শিল্প খাতের জন্য বড় ধরনের সহায়ক ভূমিকা নিতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন খাত থেকে বেরিয়ে এসেছে। এ অবস্থায় সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সহায়তার মতো প্রযুক্তি সক্ষমতা ও সামর্থ্য—দুই-ই এক্সনমোবিলের আছে। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে সংবাদমাধ্যমটির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে এক্সনমোবিলের এক মুখপাত্র বলেন, ‘অনুসন্ধান কার্যক্রম নিয়ে বাংলাদেশের পরিকল্পনা সম্পর্কে এক্সনমোবিল ও পেট্রোবাংলার মধ্যে আলোচনা হয়েছে।’
পেট্রোবাংলাকে দেয়া এক্সনমোবিলের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সরকারের অনুমোদন পেলে শুরুতে সংশ্লিষ্ট ব্লকগুলোয় টুডি সিসমিক সার্ভে চালানো হবে। এতে সময় লাগবে দুই বছর। এরপর থ্রিডি সিসমিক তথ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণের কাজটি সম্পন্ন করা হবে পরবর্তী তিন বছরে। এজন্য সরকারের সঙ্গে একটি পিএসসি সইয়ের কথা বলা আছে প্রস্তাবে। এর আগে একটি অফশোর ব্লকে সাগরের তলদেশে জ্বালানি তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের কাজে নিয়োজিত ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি পসকো ইন্টারন্যাশনাল। কোম্পানিটি বাণিজ্যিকভাবে আরো লাভজনক শর্ত যুক্ত করে পিএসসির মেয়াদ বাড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু পেট্রোবাংলা অস্বীকৃতি জানানোয় কোম্পানিটি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়।
এছাড়া মার্কিন কোম্পানি কনোকোফিলিপস ও নরওয়েভিত্তিক স্ট্যাটঅয়েল যৌথ বিনিয়োগের ভিত্তিতে কয়েকটি ব্লকে অনুসন্ধান চালানোর কাজ পেয়েছিল। কিন্তু শর্ত লাভজনক মনে না হওয়ায় পিএসসি সই হওয়ার আগেই বিদায় নেয় কোম্পানি দুটি।
পেট্রোবাংলা-সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ এখন জ্বালানি খাতের আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে চাচ্ছে। এজন্য নতুন পিএসসি মডেলে বিদেশী কোম্পানিগুলোর জন্য শর্ত আরো লাভজনক করার চিন্তাভাবনা চলছে। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তিতে গ্যাসের মূল্য দেয়া হতে পারে প্রতি এমএমবিটিইউ ১০ ডলারের কাছাকাছি মূল্যে। বর্তমানে এ মূল্য ধরা আছে ২ ডলার ৭৫ সেন্ট করে। এছাড়া নতুন মডেলে সরকারের গ্যাস মুনাফার হার ৫৫-৮০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪০-৭০ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। চলতি মার্চের মধ্যেই পিএসসির নতুন মডেলসংশ্লিষ্ট মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনের প্রক্রিয়া শেষ হতে পারে।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, এক্সনমোবিল পেট্রোবাংলার আগের পিএসসিগুলো সংগ্রহ করেছে। যদিও পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে নতুন মডেলের আওতায় চুক্তিতে আসতে উৎসাহিত করা হয়েছে। এজন্য মার্কিন কোম্পানিটি নতুন পিএসসির খসড়াও নিয়েছে। সেটি এখন তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে।
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে পিএসসিতে গ্যাস রফতানির সুযোগ নেই দাবি করে পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমরা নিজেরাই গ্যাসের সংকটে ভুগছি। তাহলে আমাদের রফতানির সুযোগ কোথায়?’
তবে এক্সনমোবিলের প্রস্তাবটি নিয়ে জ্বালানি বিভাগের একাংশে দোদুল্যমান মনোভাব দেখা দিলেও বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ এটিকে বাংলাদেশের জন্য সুযোগ হিসেবে দেখছেন। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের জ্বালানি সংকটের মুহূর্তে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের এক্সনমোবিলের প্রস্তাব অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। এটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে দ্রুত একটি সিদ্ধান্তে আসা উচিত সরকারের। অফশোর এলাকায় বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে বলেই বিশ্বের বৃহৎ জ্বালানি তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানিটি আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আরব দেশগুলোর জ্বালানি তেল ও গ্যাস উত্তোলনে তাদের ভূমিকা অনবদ্য। এক্ষেত্রে তারা যতগুলো ব্লক চেয়েছে, উচিত হবে সেগুলোর বিশ্লেষণ করে অর্ধেক হলেও তাদের দিয়ে দেয়া।’ বর্তমানে দেশের ভূভাগে জ্বালানি তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান ব্লকের সংখ্যা ২২। অফশোরে ব্লক আছে ২৬টি। এর মধ্যে ১৫টির অবস্থান গভীর সমুদ্রে। অগভীর সাগরে আছে ১১টি। বর্তমানে সাগরের অগভীর অংশের দুটি ব্লকে পিএসসির অধীনে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাচ্ছে দুটি ভারতীয় কোম্পানি—ওএনজিসি ভিদেশ লিমিটেড ও অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড।
এছাড়া দেশের ভূভাগে চারটি ব্লকে বিদেশী কোম্পানির মাধ্যমে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে, যার তিনটিই করছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শেভরন। আরেকটি ব্লকে অনুসন্ধান চালাচ্ছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ক্রিস এনার্জি।
জ্বালানি খাতের ঘটনাপঞ্জিকে রাজনীতির বাইরে রেখে দেখার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করছেন রাজনীতি-অর্থনীতির পর্যবেক্ষকরা। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তীতুমীর বলেন, ‘সারা পৃথিবীতেই জ্বালানি খাতকে নিরাপত্তার সঙ্গে সংযুক্ত দেখা হয়। সেহেতু এর একটি রাজনৈতিক সংযোগ আছে। তবে দেখার বিষয় হলো জ্বালানি খাতের সঙ্গে রাজনীতির এ সংযোগ রাষ্ট্র বা জনগণের স্বার্থে নাকি কোনো কোম্পানি অথবা ব্যক্তির স্বার্থে যাচ্ছে। দেশের জ্বালানি খাতে অনেক আগে থেকেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নীতি কাঠামোর অভাব দেখা গেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘১৯৭৫ সালে আমাদের অর্থ ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে শেল অয়েল কোম্পানির কাছ থেকে পাঁচটি ব্লক কিনে নেন। গত পাঁচ দশকে দেশী সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এমন দূরদর্শিতা আর কোনো সরকার দেখায়নি।’
প্রসঙ্গত, অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক পরিম-লে বাংলাদেশ থেকে গ্যাস রফতানি বড় ইস্যু হয়ে উঠেছিল। মার্কিন কোম্পানি শেল, ইউনোকল ও অক্সিডেন্টালের প্রতিনিধি থেকে শুরু করে বিদেশী রাষ্ট্রদূতরা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে দ্রুত গ্যাস রফতানির বিষয়ে চাপ দিতে শুরু করেন। ২০০০ সালের ১৪ মার্চ বাংলাদেশ সফরে আসেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। ওই সফরের সময়ে মার্কিন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তিনটি পিএসসি (উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি) সইয়ের জন্য অনুমোদন দিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে মার্কিন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন ব্লকে উৎপাদন-বণ্টন নিয়ে কোনো চুক্তি সই হয়নি। কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারাও বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।
রাজনৈতিক পরিম-লে বিতর্ক ওঠে, গ্যাস রফতানিতে সরকারকে চাপ দিতেই বাংলাদেশে এসেছেন বিল ক্লিনটন। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে এ ধরনের কোনো বিষয় আসেনি বলে হোয়াইট হাউজের বিবৃতিতে জানানো হয়।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com