শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:১৪ পূর্বাহ্ন

ইউরোপের আধুনিকায়নে তাসরিফের আলো

আহমেদ দীন রুমি
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৩১ মার্চ, ২০২৩

ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন ধার্মিকরা। ইনকুইজিশনপন্থীরা যেন আরো কয়েক ধাপ সামনে। রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের কাছে আবেদন জানালেন, এন্ড্রিয়াস ভেসালিয়াসকে পুড়িয়ে মারা হবে। কারণ সে মরদেহ ব্যবচ্ছেদ করেছে। পাপটা ছোট নয়। পোপ অষ্টম বোনিফেস ১২৯৯ সালে বিশেষ ঘোষণার মাধ্যমে কাজটিকে নিষিদ্ধ করেছেন। তবে যেহেতু ফিলিপের সঙ্গে ভেসালিয়াসের সম্পর্ক ভালো, তাই বেঁচে গেলেন ইনকুইজিশনের আগুনে পুড়ে মরা থেকে। ভেসালিয়াস মরদেহ ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন স্বপ্নের জন্য। মানুষের শরীরের রহস্য উন্মোচন করার স্বপ্ন। তা পূরণ হয়েছিল তীব্রভাবেই। আধুনিক ইউরোপ তাকে স্মরণ করে রেনেসাঁর প্রধান শল্যচিকিৎসক হিসেবে। অথচ ভেসালিয়াসকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন আল রাজি, ইবনে সিনা ও আবুল কাসিম আল জাহরাভি। শুধু ভেসালিয়াস না, ইউরোপীয় শল্যচিকিৎসার উত্থানে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে আরব সিলসিলা। সেখানে প্রথম সারিতেই ছিলেন জাহরাভি ও তার লেখা ‘কিতাব আত তাসরিফ লিমান আজিজা আনিত তা’লিফ’।
আবুল কাসিম আল জাহরাভি ইউরোপে পরিচিত আলবুকাসিস নামে। ১০০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি শেষ করেছিলেন কিতাব আত তাসরিফ লেখার কাজ। বর্ণনাভঙ্গির সরলতা, ভাষাগত স্পষ্টতা ও সংক্ষিপ্ততার জন্য দ্রুত গ্রন্থটি প্রভাব বিস্তার করে ইউরোপের বোদ্ধা মহলে। মুসলিম দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে প্রকাশের পর পরই। আন্দালুসিয়া থেকে বাগদাদ পর্যন্ত পঠিত হয় ইবনে সিনার ‘আল কানুন’ গ্রন্থের সঙ্গে। ইউরোপে এতদিন পরিচিত ছিলেন গ্যালেন ও হিপোক্রেটিস। তাসরিফের আলো তাদের ছাপিয়ে গেল। ক্রুসেড ও রিকনকোয়েস্তার সময়ই তাসরিফের শিক্ষা অল্প অল্প করে ছড়িয়ে পড়তে থাকে মূল ইউরোপের ভূখ-ে। আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় দ্বাদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে। জেরার্ড অব ক্রেমোনা (১১১৪-১১৮৭ খ্রিস্টাব্দ) আরবি থেকে লাতিনে অনুবাদ করেন তাসরিফ। অনূদিত বইয়ের নাম হয় ‘লাইবার আলশাহরাভি ডে কিরুরগিয়ে’। আরবরা একসময় যেভাবে প্রাচীন গ্রেকো-রোমান চিন্তাকে অনুবাদ করেছিল, জেরার্ড ইউরোপের হয়ে যেন সে দায়িত্ব পালন করলেন। তার মাধ্যমেই তাসরিফ প্রথমে ইতালি ও পরে ফ্রান্সের চিকিৎসক মহলে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু পেশাদার শল্যবিদের জন্য না, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্য তালিকায় প্রবেশ করে আল তাসরিফ। নতুন দুয়ার উন্মোচিত হয় ইউরোপীয় জ্ঞানচর্চায়।
সালিচেতোতে ১২১০ সালে জন্মগ্রহণ করেন উইলিয়াম।
বলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেন। ১২৭৫ সালে তিনি লিখেন ‘কিরুরগিয়ে’। সার্জিক্যাল ছুরির ব্যবহার, চিকিৎসায় পরিচ্ছন্নতা, গর্ভবতী ও নারী সম্পর্কে তার যে আলোচনা, তাতে আত তাসরিফের প্রভাব স্পষ্ট। তিনি জাহরাভিকে স্থান দিয়েছেন গ্যালেন ও হিপোক্রেটিসের সঙ্গে। তবে ইউরোপে তাসরিফের শক্ত পাটাতন তৈরি হয় গাই দি শলিয়াক বা গুইদোর মাধ্যমে। ফ্রান্সের শলিয়াকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন গুইদো। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তার পারদর্শিতা ছিল অভাবনীয়। আধুনিক শল্যচিকিৎসার পথিকৃৎ তিনি। ব্যক্তিগত চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করেন পোপ ষষ্ঠ ক্লিমেন্ট, ষষ্ঠ ইনোসেন্ট ও পঞ্চম আরবানের সময়। তার লেখা ‘কিরুরগিয়ে ম্যাগনা’ বা দ্য গ্রেট ওয়ার্ক অন সার্জারি পরবর্তী তিন শতাব্দী ধরে পঠিত হয়েছে ইউরোপে। নিজের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি গুইদো তুলে ধরেছেন পূর্ববর্তী চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের চিন্তা। সেখানে দুইশ বারের বেশি উদ্ধৃত হয়েছে জাহরাভির নাম। মূলত শলিয়াকের শল্যচিকিৎসা বিষয়ক চিন্তার বড় একটা অংশই তাসরিফের পুনরুৎপাদন। তার দাবি অনুযায়ী, শল্যচিকিৎসার যাত্রা শুরু হয়েছে হিপোক্রেটিস ও গ্যালেনের মাধ্যমে। মুসলিম দুনিয়ায় আলি আব্বাস, জাহরাভি ও আল-রাজির মাধ্যমে পেয়েছে পরিণতি। কিরুরগিয়ে ম্যাগনা গ্রন্থে একটু পর পরই যেমন ইবনে সিনার উদ্ধৃতি খুঁজে পাওয়া যায়। একইভাবে পাওয়া যায় তাসরিফের বয়ান। গুইদোর ছাত্র ছিলেন পিয়েত্রো দি আরগেলাতা। ১৪১০ সালে অ্যান্টিপোপ পঞ্চম আলেকজান্ডার মৃত্যুবরণ করেন। ধারণা করা হয়েছিল তাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার দায়িত্ব হিসেবে পোস্ট মর্টেম করেন এই পিয়েত্রো।। গুইদোর মতো তিনিও ছিলেন তাসরিফ থেকে প্রভাবিত। জেরার্ড অনূদিত তাসরিফের সঙ্গেই তার লেখা ‘কিরুরগিয়ে’ পঠিত হয় পরবর্তী প্রজন্মে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে গিরোলামো ফ্যাব্রিজিও স্বীকৃত ভ্রূণতত্ত্বের জনক অভিধায়। শারীরসংস্থানবিদ্যা ও শল্যচিকিৎসার পথিকৃৎ তিনি। ১৫৩৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন।
স্বীয় পা-িত্যের জন্য তিন ব্যক্তির কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন। রোমের সেলসাস, গ্রিসের পল ও আন্দালুসিয়ার জাহরাভি। তাসরিফ তাকে শল্যচিকিৎসা সম্পর্কে নতুন পথের সন্ধান দেয়। এ স্বীকৃতি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গিরোলামোর মাধ্যমেই ইউরোপে শারীরসংস্থানবিদ্যার জন্য স্থায়ী গবেষণাগার স্থাপিত হয়। তিনি ছিলেন পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরবর্তী কয়েকজন পুরোধাপুরুষ ছিলেন তার ছাত্র। তাদের মধ্যে জুলিয়াস সিজারিয়াস (১৫৫২-১৬১৬ খ্রিস্টাব্দ), উইলিয়াম হার্ভে (১৫৭৮-১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দ), স্পিগেল (১৫৭৮-১৬২৫ খ্রিস্টাব্দ) প্রধান। গিরোলামোর পরই ১৬০৪ সালে পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শারীরসংস্থানবিদ্যার অধ্যাপক হন জুলিয়াস সিজারিয়াস। ১৬১৫ সালে অধ্যাপক হন স্পিগেল। ততদিনে তাসরিফ ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। অনূদিত হয়েছে কয়েক দফা। যুক্ত হয়েছে টীকা-টিপ্পনি ও ব্যাখ্যা। তাসরিফের আগে শল্যচিকিৎসার যন্ত্রপাতি নিয়ে কেউ পদ্ধতিগত আলোচনা হাজির করেনি। এ কারণেই শুধু জেরার্ডের অনুবাদে গ্রন্থটি স্যালারনো ও মনটেপিলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত হয়েছে কয়েক শতাব্দী। ইউরোপে গ্রেকো-রোমান চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের রচনাবলির পাশে স্থান পেয়েছে গুরুত্বের সঙ্গে। তাসরিফের দলিল দিয়ে সংশোধিত হয়েছে গ্যালেন ও হিপোক্রেটিসের ত্রুটি। তাসরিফের আলোচিত ২০০ প্রকার সার্জারির যন্ত্রপাতি গৃহীত হয়েছে নমুনা হিসেবে। ইউরোপীয় চিকিৎসাবিজ্ঞান নিজেদের মতো করে অগ্রগতি সাধন করেছে। এগিয়ে গেছে শল্যচিকিৎসা। মধ্যযুগের ইউরোপে জাহরাভির তাসরিফ ইবনে সিনার কানুনকেও অতিক্রম করে যায়। জাহরাভি যেহেতু তাসরিফকে রোগ ও তার চিকিৎসাকে শ্রেণীকরণের মাধ্যমে সুগঠিত করেছেন। সঙ্গে ঠিক করেছেন ডাক্তারের জন্য করণীয়। ফলে চিকিৎসকদের জন্য ব্যবহারিক পুস্তকে পরিণত হয়েছে তাসরিফ।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে বহুদূর এগিয়েছে ইউরোপ। শল্যচিকিৎসা পরিব্যাপ্ত হয়েছে বিভিন্ন শাখায়। অনেক শাখার পেছনেই রয়েছে তাসরিফের উত্তরাধিকার। উল্লেখযোগ্য আলোচনার একটি ওরাল সার্জারি। মুখে ও দাঁতে অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে তাসরিফ সংশ্লিষ্ট টিস্যুর ব্যাপারে সতর্কতার নির্দেশনা দিয়েছে। দাঁত চেঁছে পরিষ্কার করা কিংবা তুলে ফেলার জন্য বিবৃত হয়েছে সহজ পদ্ধতি। পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে নতুন ধরনের যন্ত্রপাতির সঙ্গে। দাঁত তুলে বের করে আনার জন্য সাঁড়াশি ও দাঁত ওঠানোর সময় জিহ্বা চেপে রাখার জন্য ডিপ্রেসর তাদের মধ্যে অন্যতম। দাঁতের সম্পূর্ণ অংশ তুলে ফেলার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেছেন জাহরাভি। এক দাঁতের ওপর দিয়ে আরেক দাঁত উঠে গেলে তাকে সরিয়ে দেয়া কিংবা নড়বড়ে দাঁতকে অন্য দাঁতের সঙ্গে স্বর্ণ বা রুপার তার দিয়ে বেঁধে দেয়া নিয়ে রয়েছে বিস্তর আলোচনা। কৃত্রিম দাঁত হিসেবে গরু ও অন্যান্য প্রাণীর দাঁত ব্যবহারের প্রক্রিয়া তুলে ধরেছেন স্পষ্টভাবে। তিনিই প্রথম দাঁতের চিকিৎসায় তুলার ব্যবহার করেন। পরবর্তী ইউরোপের দন্ত চিকিৎসা অনুসরণ করেছে তাসরিফের বর্ণিত পথ। তবে গ্রন্থটির সবচেয়ে আলোচিত প্রভাব সম্ভবত গাইনেকোমাস্টিয়া নিয়ে। পুরুষদের বুকের দুই পাশ থেকে টিস্যু সরিয়ে ফেলার পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন জাহরাভি। সি-আকৃতির যন্ত্রের মাধ্যমে কাজটি করা হবে। এক হাজার বছর পর হাল দুনিয়ার ব্রেস্ট সার্জারির পাটাতন এখানে। অস্ত্রোপচার-পরবর্তী ঝুঁকি থেকে মুক্ত রাখতে ড্রেসিংয়ের ধারণা দিয়েছে তাসরিফ। গ্রেকো-রোমান ধারার শল্যচিকিৎসায় অপারেশন চলাকালে কয়েক দফা তরল অ্যানেস্থেসিয়া দেয়া হতো। এটা রোগী ও ডাক্তার উভয়ের জন্যই প্রতিকূল। তাসরিফের মাধ্যমে ইউরোপ পরিচিত হয় বিশেষ ধরনের সুগন্ধযুক্ত অ্যানেস্থেসিয়ার সঙ্গে, যা আধুনিক চিকিৎসায় ‘অ্যারাবিয়ান নাইটস’ নামে খ্যাত। একবার ঘ্রাণ নিলেই পুরো অপারেশন পরিচালনার জন্য যথেষ্ট।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, সিএসএফ বা সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড মস্তিষ্কে পুষ্টি সরবরাহের কাজ করে থাকে। এই তরল পদার্থ যদি মস্তিষ্ক থেকে ঠিকঠাক নিঃসৃত হতে না পারে, তাহলে মাথার ভেতরে জমে গিয়ে রোগের সৃষ্টি করে, এ রোগের নাম হাইড্রোসেফালাস। সর্বপ্রথম হিপোক্রেটিস হাইড্রোসেফালাসকে চিহ্নিত করেন। কিন্তু বিস্তারিত চিকিৎসার বিবরণ দেন জাহরাভি। রোগটির কারণে রোগীর মাথব্যথা হয়। কমে যায় স্মৃতিশক্তি। শিশুদের মাথা বড় হতে থাকে। প্রতিদিন বাড়তে থাকে মস্তিষ্কের আকার। দেখা দেয় শারীরিক সমস্যা। তাসরিফে রোগটির চিকিৎসা নিয়ে অনুসরণ করা হয়েছে অভিনব এক পদ্ধতি। অতিরিক্ত তরলকে টি-আকৃতির ছেদক ও ছুরি দিয়ে বের করে নেয়ার উপায়। জাহরাভির ভাষায়, ‘এক্ষেত্রে আমাদের মস্তিষ্কের তিন জায়গায় অস্ত্রোপচার করতে হবে। বের করে আনতে হবে অতিরিক্ত তরল। কাজ সমাপ্ত হলে ক্ষতস্থান বন্ধ করে শক্ত করে বেঁধে দিতে হবে।’ পুরোপুরি আরোগ্য না হলেও সাময়িক নিরাময় দেখা যেত তাসরিফের দেখানো চিকিৎসায়। ইউরোপেও দীর্ঘদিন এ পদ্ধতিকে অনুসরণ করেছেন চিকিৎসকরা। ১৮৮১ সালে কার্ল ভারনিকা সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড বের করে নেয়ার আধুনিক প্রক্রিয়া সামনে আনেন। মাতৃত্বকালীন চিকিৎসা ও প্রসূতিবিদ্যার অগ্রগতিতে পথ দেখিয়েছে তাসরিফ। জরায়ুতে অস্ত্রোপচার করতে বিশেষ ধরনের ব্লেড উদ্ভাবন করেন জাহরাভি। বিস্তারিত বলা হয় মৃত ভ্রূণ বের করে আনার প্রক্রিয়া নিয়ে। তাসরিফ যখন ইউরোপে অনূদিত হয়, প্রথম দিকে শল্যচিকিৎসকরাও ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি বিষয়টি। নতুন আবিষ্কৃত যন্ত্রের নাম ও আরবি পরিভাষা সম্পর্কে ধারণায় কমতি থাকা তার বড় কারণ। পদ্ধতিটিকে ঠাহর করতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ইউরোপের। সন্তান জন্মদানকালীন মাকে কয়েকটি অবস্থানে রাখা হয় ধাত্রীবিদ্যায়।
তাদের মধ্যে লিথোটমি অবস্থান ও ওয়েলচার অবস্থান বেশি পরিচিত। দুটি ধারণাতেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে তাসরিফের বর্ণনা। ওয়েলচার অবস্থানটি মূলত জাহরাভিরই উদ্ভাবন। ইউরোপীয় প্রসূতিবিদ্যা সেটা অভিযোজন করে নিয়েছে মাত্র। শ্বাসনালিতে অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য ইঙ্গিত দিয়েছে তাসরিফ। জনৈক দাসী নিজের গলা কেটে আত্মহত্যা করতে চাইলে তাকে অস্ত্রোপচারে সুস্থ করে তোলেন জাহরাভি। মুসলমান পুরুষের জন্য খতনা অবশ্য পালনীয় বিধান। সে সূত্র ধরেই জননাঙ্গে অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি নিয়ে এগিয়েছে তাসরিফ। এগারোতম অধ্যায়ে হাজির হয়েছে চোখের অস্ত্রোপচার প্রসঙ্গ। চোখে সার্জারির সুবিধার্থে ভি-আকৃতির বিশেষ ধরনের যন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন জাহরাভি। অপারেশনের স্থান চিহ্নিত করার জন্য ব্যবহার করতেন বিশেষ ধরনের কালি। হাল আমলের ইউরোপেও এ চর্চা অব্যাহত রয়েছে। মূত্রথলি কেটে কিডনির পাথর বের করে আনার পদ্ধতি নিয়ে বলেছেন জাহরাভি। পার্থক্য নির্ণয় করেছেন গয়টার ও ক্যানসারের মধ্যে। তার অনুসৃত ক্যাটগাট সেলাই এখনো ব্যবহূত প্রচলিত সার্জারিতে। হাতে অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রেও আলো ফেলেছে তাসরিফ। বিশেষ করে পলিড্যাকটিলি ও সিনড্যাকটিলির ক্ষেত্রে। পলিড্যাকটিলিতে একটা অতিরিক্ত আঙুল থাকে। আর সিনড্যাকটিলিতে থাকে দুটো আঙুল যুক্ত অবস্থায়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অতিরিক্ত আঙুল অপসারণ কিংবা আঙুলদ্বয়কে পৃথক করার প্রক্রিয়া আলোচনায় এসেছে, যা ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষা দেয়া হতো কয়েক শতাব্দী ধরে। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র ও টনসিল অপসারণ নিয়ে তাসরিফের আলোচনা তাদের জন্য ছিল অনুকরণীয়। শিরা ও ধমনির পার্থক্য বুঝতে বিশেষ ধরনের যন্ত্র হাজির করেছেন তিনি। ধমনির রক্তপাত বন্ধে প্রবর্তন করেছেন নতুন পদ্ধতি। তার ৬০০ বছর পর রেনেসাঁর ইউরোপে সে ধারণাই জনপ্রিয় করেন অ্যামব্রোইজ পারে (১৫১০-১৫৯০ খ্রিস্টাব্দ)। এক হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে কিতাব আল তাসরিফের। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও বিশেষ করে শল্যচিকিৎসার ইতিহাস। আর এ উত্থানের মেরদ- তৈরি করে দিয়েছে কিতাব আত তাসরিফ। দাঁড় হয়েছে ইউরোপের শল্যচিকিৎসার ঐতিহ্য। আন্দালুসিয়ার তাসরিফই আলো হয়ে উজ্জ্বল করেছে পরবর্তী ফ্রান্স ও ইতালি হয়ে সারা ইউরোপকে। সূত্র: বণিকবার্তা সিল্ক রোড। আহমেদ দীন রুমি: লেখক




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com