সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতিসংঘ ও বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় প্রতিটি আন্তর্জাতিক ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবনমন লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্র, সুশাসন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বাণিজ্য, মানবাধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের মত ক্ষেত্রগুলোতে ধারাবাহিক অবনমনের পর এবার হ্যাপিনেস ইনডেক্সে ২৫ ধাপ অবনমনের মধ্য দিয়ে মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রার চালচিত্রই প্রকাশিত হয়েছে। গৃহযুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দেউলিয়াত্বের শিকার শ্রীলঙ্কা কিংবা পাকিস্তানের চেয়েও বাংলাদেশের মানুষ অসুখী হওয়ার চিত্র খুবই অপ্রত্যাশিত। দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, গণতন্ত্রহীনতা, বিচারহীনতা, সর্বগ্রাসি দুর্নীতি-লুটপাট, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ-দখলবাজি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যের বেআইনী কার্যক্রম ও অপরাধ প্রবণতার কারণেই দেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে। উন্নয়নের কথা বলে নিরাপত্তাহীনতাকে ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সংকট নিরসনে কোনো বাস্তব উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। অব্যাহত মূল্যস্ফীতি ও টাকার মানের অবনতির কারণে বেশিরভাগ মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বহ হয়ে পড়েছে। সেই সাথে মানুষের রাজনৈতিক অধিকার, ভোটাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতার মত ক্ষেত্রগুলো আধুনিক নাগরিক জীবনের চেতনায় বড় প্রভাব সৃষ্টি করে থাকে। রাষ্ট্র ও সরকারের মূল দায়িত্ব হচ্ছে, মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তা ও সুখে-শান্তিতে বসবাসের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইনডেক্সে বড় ধরনের অবনতি ঘটেছে বাংলাদেশের। বিশ্বের ১৩৭টি দেশের মধ্যে এ বছর বাংলাদেশের অবস্থান গত বছরের ৯৪তম স্থান থেকে ছিটকে ১১৮তম অবস্থানে নেমে এসেছে। বিশ্ব র্যাংকিং তো বটেই, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিবেশী দেশ নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভারত, পাকিস্তান ও মালদ্বীপের জনগণের চেয়েও বাংলাদেশের মানুষ অসুখী। উল্লেখ্য, জাতিসংঘের হ্যাপিনেস ইনডেক্সের লক্ষ্য হচ্ছে, গতানুগতিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মানুষের অর্থ-বিত্তের প্রতিযোগিতার বাইরে গিয়ে সত্যিকার অর্থে সুখ-স্বাচ্ছন্দ ও নিরাপত্তাবোধের সাথে প্রাকৃতিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেয়া। হ্যাপিনেস ইনডেক্সের তালিকার দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলো যেমন হ্যাপিনেস ইনডেক্সের শীর্ষে থাকে না, সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর তালিকা থেকেও কোনো দেশ প্রথম ২০টি সুখী দেশের তালিকায় স্থান পাচ্ছে। তবে ইউরোপের দেশগুলো সুখী দেশের তালিকার শীর্ষে অবস্থান করলেও এবারসহ পঞ্চমবারের মত বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় স্থান পাওয়া ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক কিংবা আইসল্যান্ড ইউরোপের সবচেয়ে ধনী বা ক্ষমতাধর দেশগুলোর অন্তর্ভুক্ত নয়। একইভাবে উপমহাদেশের পারমানবিক ক্ষমতাধর ভারত ও পাকিস্তানসহ অন্য দেশগুলোর চেয়ে ভুটান ও মালদ্বীপ সুখী দেশের তালিকায় সব সময়ই এগিয়ে আছে। সুখী দেশের তালিকার তলানিতে থাকা বড় ও ক্ষমতাধর দেশগুলোর রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে এ নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে।
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করেছিল নিজেদের নিরাপত্তা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ নিশ্চিত করার প্রয়োজনে। রাষ্ট্রশক্তির অপব্যবহার, সম্পদের অপব্যবহার এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ ও আধ্যাত্মিক চেতনার উপর অমানবিক হস্তক্ষেপের কারণে মানুষের স্বাভাবিক নিরাপত্তা ও সুখ-শান্তি তিরোহিত হয়ে পড়ছে। পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতা, সম্পদের পাহাড় এবং গতানুগতিক উন্নয়ন ধারণা মানুষের নিরাপত্তা ও সুখ-শান্তির নিশ্চয়তা দিতে পারেনা। উপরন্তু প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রবাহকে কলুষিত ও বাঁধাগ্রস্ত করার কারণে আজকের বিশ্ব ভয়াবহ বিপযর্য়ের সম্মুখীন হয়েছে। শিল্পায়ন ও নগরায়ণের প্রবল প্রতিযোগিতায় ফসিল জ্বালানির অমিত ব্যবহারের কারণে কর্বন নি:সরণ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বের উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছে পুরো মানব সম্প্রদায়। এসব বাস্তব বিষয়গুলোকে সামনে রেখেই জিডিপি প্রবৃদ্ধির বদলে জিএনএইচ (গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস) ধারনাকে প্রাধান্য দিতে শুরু করেছে বিশ্বসম্প্রদায়। ছোট্ট দেশ এই ধারণাকে কাজে লাগিয়ে সুখী দেশে পরিণত হচ্ছে। গতানুগতিক উন্নয়ন ধারনার বদলে এসেছে টেকসই ও পরিবেশ বান্ধব উন্নয়নের ধারণা। রাষ্ট্রের উচ্চ প্রবৃদ্ধি, ব্যক্তির অর্থবিত্ত যদি সুখ-শান্তির গ্যারান্টি দিতে না পারে তাহলে সুখ-শান্তির জন্য প্রয়োজনীয় অনুসঙ্গগুলোর দিকেই আমাদের নজর দিতে হবে।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতা সমুহ দূর করা ছাড়া মানুষের সামগ্রিক ও প্রত্যাশিত উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। দেশের সরকার এবং সব রাজনৈতিক পক্ষকে মানুষের সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। আশা করি সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে। ইতিহাসে ইতিবাচক হিসেবে অবস্থান ধরে রাখতে আন্তরিক হবে।