রহমত, নাজাত ও মাগফিরাতের বারতা নিয়ে পবিত্র মাহে রমজান আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। মহান প্রভু আমাদেরকে আরো একটি বরকতময় মাস উপভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। এ মাস এতটাই বরকতপূর্ণ যে, প্রতিটি আমলের বিনিময়স্বরূপ বান্দা পেয়ে যায় তার ৭০ গুণ বেশি প্রাপ্য। বন্ধ হয়ে যায় কবরবাসীর শাস্তি। তারা মনেপ্রাণে এই মাসেরই কামনা করতে থাকে। এই মাস বরকতময় মাস। এই মাস কুরআন নাজিলের মাস। এই মাসেই রয়েছে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম রজনী। সুতরাং এই মাসের শ্রেষ্ঠত্ব বোঝাতে মনে হয় না আর কিছুর প্রয়োজন পড়বে। এই মাসকে কেন্দ্র করে বেনামাজি যারা, তারাও মসজিদমুখী হয়ে যায়। মাথায় চাপিয়ে রাখে সর্বদা রাসূলের সুন্নত টুপিকে। হাতে হাতে দেখা যায় মিসওয়াকের মতো লোপ পাওয়া সুন্নত। বিরাজ করে চারদিকে বেহেশতি আমেজ। এমন পরিবেশে মন আনন্দে নেচে ওঠে। মানুষের চলনে-বলনে দেখা যায় আমূল পরিবর্তন। (এর ভিন্ন কিছু অবশ্য রয়েছে, এমন থাকবেই সর্বকালে) রমজানের ছোঁয়া পেয়ে বেশির ভাগ মানুষের মধ্যেই যেন মনুষত্ব ফিরে আসে। পবিত্র মাহে রমজান যেহেতু পবিত্র কুরআন নাজিলের মাস, সেহেতু এই সময়টিতে কুরআনের অধ্যয়নও হয় ব্যাপকভাবে। যাদের কখনো কুরআনের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি তারাও রমজান উপলক্ষে কুরআনকে ঘনিষ্ঠ করে নেয়। ব্যাপকভাবে তিলাওয়াত করতে থাকে। টার্গেট নিয়ে নিয়ে পড়তে থাকে। কেউ এক খতম এবং অনেকে একাধিক খতমও আদায় করেন। কেউ কেউ দাবি করে থাকেন অর্থ না বুঝে কুরআন তিলাওয়াত করলে নেকি পাওয়া যায় না, (যদিও তা একদমই অবান্তর ও ভিত্তিহীন কথা) রমজানে তারাও তিলাওয়াত করে; অর্থ বুঝুক কিংবা না বুঝুক। আর কেনই বা মানুষ কুরআন পড়বে না। যার প্রতি হরফে ১০ নেকির স্থলে রমজান হিসেবে মিলছে ৭০০ নেকি। আর এক হরফে কে-ই-বা ক্ষ্যান্ত থাকে? পড়ে যায় অগুনতি হরফ। আমলনামায় লিখা হতে থাকে বেহিসাব নেকি।
প্রতি হরফে নেকি অর্জনের জন্য যদিও অর্থ বোঝার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু কেউ যখন অর্থ বুঝে পড়বে, আল্লাহ কখন কী বলছেন, কী আদেশ করছেন, কী নিষেধ করছেন, কাদের ব্যাপারে সুসংবাদ এবং কাদের ব্যাপারে লাঞ্ছনাকর শাস্তির ঘোষণা দান করেছেন, এগুলো তখন তার সামনে খানিকটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। জান্নাতের অফুরন্ত নিয়ামতরাজির বর্ণনা ও জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তির লোমহর্ষক বিবরণ কী স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে, সেটি জানার জন্য অর্থসহ পড়া উচিত। তা ছাড়া যুগে যুগে বান্দাদেরকে আল্লাহর নিদর্শনাবলি দেখানোর কত কত চমকপ্রদ ঘটনা বিবরণ করেছেন এই কুরআনে। এগুলো যখন কোনো বান্দা একটু খেয়াল করে অর্থের সাথে মিলিয়ে পড়বে তখন তার মনের মধ্যে যে কত ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হবে এটি কেবল খোদ পাঠকই বলতে পারবে।
পাঠক আপনি যদি অর্থসহ অল্প অল্প করেও পড়তে পারেন, তাহলে কখনো কখনো আপ্লুত হতে হবে জান্নাতের বিবরণ পড়তে গিয়ে। দুনিয়ার সব কিছুই নগণ্যের চেয়েও নগণ্য মনে হবে সেই অফুরন্ত নিয়ামতরাজির সামনে। গা শিউরে উঠবে জাহান্নামের লোমহর্ষক বর্ণনা পড়তে গিয়ে। দুনিয়ার কঠিন থেকে কঠিন শাস্তিকেও অতি সামান্য ও তুচ্ছ দেখাবে। বান্দার প্রতি রবের অনুগ্রহের বিবরণ দেখে কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আসবে বারবার। ইহুদি খ্রিষ্টানদের কূটচাল কত জঘন্য ছিল এর বিবরণও আপনি কুরআনেই দেখতে পাবেন। কত সুন্দরভাবে নানা ঘটনার দৃশ্যপট অবতারণা করেছেন তা অনুধাবন করলেই মনে খেলে যাবে আনন্দের ফল্গুধারা। কী মহান কিতাবই না পেয়েছি আমরা। সবাই যদি পবিত্র কুরআনকে তাদাব্বুরের সাথে বুঝে পড়তে পারত, তাহলে নিঃসন্দেহে প্রভাবিত করত অনেককেই। পাপের কথা কল্পনা করতেও শতবার ভাবা লাগত। চিন্তার একটু গভীরতায় ডুব দিলেই একত্ববাদে অবিশ্বাসীদেরও অন্তর্দৃষ্টি খুলে যেত।
কিন্তু বাস্তবতা তো এটিই যে, আমরা কুরআন বুঝে পড়ি না। যারা পারি না, তারা তো পড়িই না; বরং যারা অর্থ বুঝে পড়তে পারি, তারাও কেবল তিলাওয়াত করেই পার পেতে চেষ্টা করি। কখনো গভীর ধ্যানে পড়তে পারি না বা পড়া হয় না।
অথচ প্রতিটি আয়াতে আয়াতে রয়েছে কত নিদর্শন, কত বিধি-বিধান। আরো রয়েছে সৃষ্টি সম্পর্কে স্রষ্টার অপরিসীম অনুগ্রহের কথা। এসব যদি কেউ ধ্যানের সাথে পড়ে, তার পক্ষে কি সম্ভব সেই প্রতিপালকের অবাধ্যতায় লিপ্ত হওয়া? কোনোভাবেই না। কেনই বা হবে? যখন তার চোখের সামনে জাজ্বল্যমান থাকবে মৃত্যু-পরবর্তী সময়ের প্রতিটি ক্ষেত্র। রবের শাস্তির ভয়াবহতা ও নিয়ামতের বিশালতা। সে কীভাবে শাস্তির বাড়ি ছেড়ে অগ্নিকু-ে ঝাঁপ দিতে আগ্রহী হবে? কীভাবে সে নশ্বর পৃথিবীর মোহে পড়ে অবিনশ্বর জগত থেকে বিমুখ হয়ে যাবে? এমন হবে না কখনোই যদি কেউ পবিত্র কুরআন বুঝে, অর্থ অনুধাবন করে অন্তত ভয়ভীতি এবং সুসংবাদের জায়গাসমূহ তিলাওয়াত করে।
সুতরাং প্রিয় পাঠক! রমজান উপলক্ষে আমরা কমবেশি সবাই পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করে থাকি এবং দিনের নির্দিষ্ট একটা সময় কুরআনের পেছনে ব্যয় করে থাকি। তাহলে রমজানে কেমন হবে যদি নিয়মিত তিলাওয়াতের পাশাপাশি নির্দিষ্ট কিছু সূরা, বিশেষত যেগুলোতে জান্নাতের অফুরন্ত নিয়ামতরাজির বর্ণনা ও জাহান্নামের ভয়াবহ আজাবের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এবং যেসবে আল্লাহর অনুগ্রহের বিবরণ দেয়া হয়েছে, সেগুলোও অল্প অল্প করে অর্থসহ পড়া হয়? বিধিনিষেধ ও হুকুম আহকামের সূরা ও আয়াতসমূহ তো রয়েছেই। বাংলা অর্থ পড়েই সহজে যেসব অনুধাবন করতে পারি এমন কিছু সূরা বা আয়াতকে যদি কুরআন তিলাওয়াতের পাশাপাশি অর্থ বুঝে পড়ার খোরাক বানাই কেমন হবে সেটি? বেশি কঠিন কোনো কাজ নয়। বেশিও পড়তে হবে না। দু’-চারটি সূরা পুরো রমজানে অল্প অল্প করে অর্থসহ পড়ে নিতে পারবেন? আপনিও অনুধাবন করতে পারবেন কুরআন পাঠের স্বাদ। তিলাওয়াতের মিষ্টতা ও কুরআনের মাধুর্যতা। এর ফলে আপনার অন্তর্দৃষ্টি খুলে গেলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। জান্নাতের অফুরন্ত নিয়ামতরাজির সামনে দুনিয়ায় কষ্টক্লেশে জর্জরিত সামান্য সুখকে দাঁড় করিয়ে শ্রেষ্ঠ বস্তুকে প্রাধান্য দিন। আসুন না তাহলে আমরা কুরআন বুঝে পড়তে চেষ্টা করি। রমজানকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাই।
লেখক : শিক্ষার্থী, জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া বছিলা, মুহাম্মদপুর, ঢাকা