পরিবারের সবার দায়িত্ব নিজ হাতে সামলাতে গিয়ে অনেক নারীই নিজের প্রতি উদাসহীন থাকেন। অনেক নারীই আছেন, যারা শরীরে বিভিন্ন রোগ পুষে রাখেন! শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা লক্ষণ দেখেও তা অবহেলা করার কারণে গুরুতর সব রোগ বাসা বাঁধে শরীরে। সব নারীদের উচিত এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া। ৩০ বছরের পর থেকেই নারীদের উচিত নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা। এতে করে বিভিন্ন কঠিন রোগ এমনকি ক্যানসারও সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
গতকাল ২৯ এপ্রিল ছিল ‘বিশ্ব নারী সুস্থতা দিবস’। প্রতি বছর এপ্রিলের শেষ শুক্রবার পালিত হয় দিবসটি। এ বছর ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে দিবসটি। এ দিবসের উদ্দেশ্য হলো, নারীর শরীরিক ও মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানো। বর্তমানে বিশ্বের সব দেশেই নারীরা পুরুষের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখছেন। একজন নারী নিজ হাতে সংসার, ঘরের কাজ, রান্না, সন্তান লালন-পালন, চাকরি, ব্যবসা’সহ গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ সামলাচ্ছেন। এতো কাজ করতে গিয়ে কখনো নারী শারীরকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন আবার কখনো মাত্রাতিরিক্ত চাপ নিতে গিয়ে মানসিকভাবে অস্থির হয়ে উঠছেন। নারীর শারীরিক ও মানসিক নানা টানাপোড়েন হয়তো পরিবারের সদস্যরা এমনকি স্বামী-সন্তানও কখনো কখনো বুঝতে পারেন না।
এজন্য নারীদের উচিত নিজের শাররিক ও মনিসিক স্বাস্থ্যের যতœ নিজেরই নেওয়া। জেনে নিন সুস্থ থাকতে সব নারীরই যে কয়েকটি কাজ করা জরুরি-
প্রতিদিন ৩০ মিনিট ব্যায়াম করুন: নিয়মিত শরীরচর্চার মাধ্যমে বেশিরভাগ রোগই প্রতিরোধ করা সম্ভব। ইউকন হেলথের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের চেয়ারপার্সন মলি ব্রুয়ার সব নারীদেরকে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট শরীরচর্চার পরামর্শ দিয়েছেন। এই বিশেষজ্ঞের মতে, এটি শুধু আপনার কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যেরই উন্নতি করে না বরং স্বাস্থ্যকর ওজন, বডি মাস ইনডেক্স বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
ফলে স্থূলতার সঙ্গে যুক্ত এন্ডোমেট্রিয়াল (জরায়ু) ক্যানসার, স্তন ক্যানসার ও কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি কমবে। এছাড়া ব্যায়াম শরীরে অতিরিক্ত হরমোন কমাতে পারে। ফলে স্ট্রেস কমে ও মানসিকভাবেও সুস্থতা মেলে।
শরীরের কথা শুনুন:বয়সের সঙ্গে সঙ্গে একজন নারী জীবনের নানা স্টেজে পদার্পণ করেন। নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে রোগগুলো দেখা দেয় তার মধ্যে অন্যতম হলো, এন্ডোমেট্রিওসিস, ডিম্বাশয়ের সিস্ট, জরায়ু ফাইব্রয়েড, স্তন ক্যানসার বা স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত ক্যানসার যেমন- এন্ডোমেট্রিয়াল, সার্ভিকাল বা ডিম্বাশয়। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ লুসিয়ানো জানিয়েছেন, নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে প্রারম্ভিক ক্যানসার শনাক্ত হয়। এছাড়া বেশ কিছু লক্ষণ আছে যেমন- মাসিক চক্রের পরিবর্তন, অস্বাভাবিক রক্তপাত, ফোলাভাব, ক্লান্তি ও স্বাস্থ্যের যে কোনো পরিবর্তন দেখে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
স্বাস্থ্যকর খাবার খান:বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি কমাতে শরীরচর্চার পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া জরুরি। পুষ্টিকর, রঙিন ফল ও শাকসবজি নিয়মিত খাওয়ার মাধ্যমে স্তন’সহ বিভিন্ন ক্যানসারের ঝুঁকি প্রতিরোধ করা যায়।
ইউকন হেলথের উইমেন সেন্টারের বেকলি ইমেজিং সেন্টারের রেডিওলজিস্ট অ্যালেক্স মেরকুলভ বলেছেন, ‘নারীদের উচিত ঘরে তৈরি তাজা খাবার খাওয়া, বাক্সবন্দি বা প্যাকটেজাত খাবার খাওয়া বন্ধ করতে হবে।
এছাড়া ভাজা খাবার এড়িয়ে চলুন। কারণ এতে ট্রান্স-ফ্যাট ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে। এসবের পাশাপাশি চিনি ও লবণ কম খান।
ধূমপান ত্যাগ করুন:ধূমপান অকাল মৃত্যু, হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ফুসফুস ও অন্যান্য ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। ফুসফুসের ক্যানসার নারীদের মধ্যে ক্যানসারে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ। যে নারীরা ধূমপান করেন, তাদের ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে এখন থেকেই অভ্যাসটি ত্যাগ করতে হবে। ধূমপানের কারণে সৃষ্ট ক্যানসার প্রতিরোধযোগ্য, যদি আপনি সিগারেট ছাড়েন।
স্তন পরীক্ষা করুন:প্রতি আটজন নারীর মধ্যে একজন তাদের জীবদ্দশায় স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। তবে মেরকুলভের মতে সুসংবাদ হলো, স্তন ক্যানসার যদি তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে তাহলে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থতা মেলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৪০ বছর বয়স থেকেই নারীদের নিয়মিত ম্যামোগ্রাম করা জরুরি। এর মাধ্যমে শনাক্ত করা সম্ভব স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কতটুকু। এছাড়া স্তনে কোনো ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
যৌনরোগে ভুগছেন কি না যাচাই করুন:অজান্তেই কিন্তু আপনার শরীরে বাসা বাঁধতে পারে যৌনরোগ। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা নিয়মিত পেলভিক পরীক্ষা ও প্যাপ স্মিয়ার স্ক্রিনিংয়ের পরামর্শ দেন। হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস বা যৌনাঙ্গে আঁচিলের মতো যৌনবাহিত রোগের পাশাপাশি যোনি ও সার্ভিকাল ক্যানসারের লক্ষণগুলোর জন্য প্যাপ স্মিয়ার পরীক্ষা করা হয়।
এইচপিভি প্রতিরোধ করুন: উচ্চ এইচপিভি প্রাদুর্ভাব জরায়ুমুখের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। ২০০৬ সাল থেকেই এইচপিভি প্রতিরোধের জন্য একটি ভ্যাকসিন পাওয়া যায়। এইচপিভি ভ্যাকসিন শুধু রোগের বিস্তার রোধে কার্যকর।
গর্ভাবস্থায় প্রসবপূর্ব যত্ন: গর্ভাবস্থায় সব নারীর উচিত শরীরের সঠিক যত্ন নেওয়া। মা সুস্থ থাকলে অনাগত সন্তানও সুস্ততার সঙ্গেই পৃথিবীর আলো দেখবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গর্ভাবস্থায় নারীর সুস্থতা কিন্তু সন্তানের সুস্থতার ইঙ্গিত দিতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয় গর্ভাবস্থার আগে ও পরে নিয়মিত চিকিৎসকের শরনাপন্ন হওয়া সুস্থ থাকা। গর্ভধারণের আগে ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করা শুরু করুন, স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন, স্বাস্থ্যকর খাবার খান ও নিয়মিত ব্যায়াম করুন।
কোলনোস্কোপি করুন: কোলন ক্যানসার নারীদের মধ্যে ক্যানসারে মৃত্যুর তৃতীয় বৃহত্তম কারণ। ৫০ বছরের পর থেকে নিয়মিত কোলনোস্কোপি করার পরামর্শ দেন ব্রুয়ার। কোলনোস্কোপির সাহায্যে কোলন পলিপের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ধরা পড়ার মাধ্যমে ক্যানসারের বিকাশ বা বিস্তার রোধ করা যায়। এছাড়া একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা ও পুষ্টিকর খাবার রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। সূত্র: ইউকন টুডে