শ্রমজীবী মানুষের প্রতি দয়ার্দ্র হন, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আপনার দুনিয়া-আখিরাতের ভাগ্য সুপ্রসন্ন করে দেবেন। আপনার প্রতি আল্লাহর দয়ার ভা-ার খুলে দেবেন। মানসিক প্রশান্তির সাথে সাথে আপনার সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি পাবে। দুর্বল অসহায়দের কৃতজ্ঞতা আপনার জীবনকে ফুলে ফলে সাজিয়ে দেবে।
‘তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর, তার সাথে কাউকে শরিক করোনা এবং পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহার করো, আরো সদ্ব্যবহার কর আত্মীয়-স্বজনদের সাথে, এতিমদের সাথে, দরিদ্রদের সাথে, আত্মীয় প্রতিবেশীদের সাথে, অনাত্মীয় প্রতিবেশীদের সাথে, সফরসঙ্গীর সাথে, পথিকের সাথে এবং দাস-দাসীর সাথে। আল্লাহ দাম্ভিক ও গর্বিত লোককে পছন্দ করেন না।’ (নিসা : ৩৬) খবরের কাগজে প্রায়ই এমন কিছু খবর চোখে পড়ে যা হৃদয়কে দারুণভাবে ব্যথিত করে, বিবেক হয় মারাত্মকভাবে আহত। এ গুলোর মধ্যে একটি হলো : ‘কাজের মেয়েকে নির্যাতন, গৃহকর্তা বা গৃহকর্তী গ্রেফতার’ অথবা ‘কাজের মেয়ে খুন, গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রী গ্রেফতার’। বর্বর লোকগুলো বর্বরোচিত কাজের সাথে হয়তোবা সতর্কতা অবলম্বন করতে পারেনি বলেই খবরগুলো অসাবধানতাবশত খবরের কাগজের মাধ্যমে মানুষের গোচরীভূত হয়। কিন্তু যারা বর্বরতার সাথে ধূর্ততা, সাবধনতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাদের হাজারো নির্যাতনের খবর রয়ে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে। জঠরজ্বালা নিবারণের জন্য শত শত আশরাফুল মাখলুখাত বনি আদম তার নিজ সম্প্রদায়ভুক্ত অপর আশরাফুল মাখলুখাত নামের বর্বরদের শত নির্যাতন নীরবে সহ্য করে যায়। এসব দুর্বল ও অসহায়ের আর্তচিৎকার পাষাণদের চারদেয়ালকে ভেদ করে কখনো বাইরে আসতে পারে না। ফলে এগুলো লোকচক্ষুর অগোচরেই থেকে যায়। দ্ধিতীয়ত, কদাচিৎ যেই খবরগুলো জনসমক্ষে আসে, তারও সঠিক বিচার হয় না; বরং আইনের ফাঁক গলিয়ে অথবা হাত বেয়ে অন্ধকার কুটিরে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়।
সমাজে মাঝে মধ্যে এমন মহানুভব ব্যক্তির দেখাও মেলে, যারা মানুষ নামটিকে সার্থক করে তোলেন। এই ব্যক্তিরা কাজের ছেলে বা মেয়েটির সাথে নিজের ছেলে-মেয়ের মতো আচরণ করেন। তারা এ ধরনের ছেলে-মেয়ের থাকা, খাওয়া ও পোশাক পরিচ্ছদসহ কোনো কিছুইতেই পার্থক্য করেন না। নিজেরা যে খাদ্য গ্রহণ করেন, যে ধরনের বিছানায় ঘুমান, যেই সাবানটি বা অন্যান্য প্রসাধনসামগ্রী ব্যবহার করেন, কাজের লোককে সেগুলোই ব্যবহার করতে দেন। এদেরকে সংসারেরই একজন সদস্য মনে করা হয়। এমনকি ন্যায়সঙ্গতভাবে তার জন্য আনুমানিক একটা বেতন ধার্য করে প্রতি মাসে তার নামে অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা জমা করে দেন। তাই বলে এসব মহানুভব ব্যক্তির আভিজাত্য কোনো অংশে কমে যায় না; বরং তাদের মান-ইজ্জত বহলাংশে বেড়ে যায় এবং সুনাম ও সুখ্যাতি চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কাজের মেয়েদের নির্যাতন করার সহজ কারণ এরা দুর্বল ও অসহায়। কিন্তু এদের আপন করে নেয়া কঠিন।
আমরা কি এ অসহায় বি তদের জন্য উল্লেখিত ভদ্রলোকদের মতো হতে পারি না? মনে রাখতে হবে আল্লাহ তায়ালাই আমাকে ধনসম্পদ দিয়েছেন, তাঁরই অনুগ্রহে আমরা লেখাপড়া শিখে বা ব্যবসাবাণিজ্য করে সমাজের এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি। তিনি আমাদেরকে অসহায়দের মালিক বানিয়েছেন। এমনটিও তো হতে পারত যে, আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। সুতরাং ্এদের প্রতি সহায় হন। আপনার একটু ভালোবাসা ওদের অন্তরের অন্তস্তলকে এতটাই সিক্ত করবে যে, সে আপনার একান্ত আপন ও বাধ্য হয়ে যাবে। যেখানেই থাকেন না কেন এরা সারা জীবন আপনার ভালো কামনাই করে যাবে। আপনি আপনার ছেলে-মেয়েদের বড় বড় দোষত্রুটিকে যদি মাফ করে দিতে পারেন, তবে ওদের সামান্য ত্রুটিকে মাফ করতে পারবেন না কেন? নিপীড়িত মানবতার বন্ধু রাসূলে আকরাম সা: বলেছেন, ‘চাকর-চাকরানী বা দাসদাসীকে প্রয়োজনীয় খাদ্যবস্ত্র দিতে হবে এবং তার ক্ষমতার অতিরিক্ত দায়িত্ব তার ওপর চাপানো যাবে না। নিতান্তই যদি চাপাতে হয়, তবে তার সাথে নিজে কাজ করতে হবে। আল্লাহর সৃষ্টিকে কষ্ট দিও না। তিনি তোমাদেরকে তাদের মালিক বানিয়েছেন, যদি চাইতেন তবে তাদেরকে তোমাদের মালিক বানাতে পারতেন।’(সহিহ মুসলিম) ঘরের কোনো কিছু হারিয়ে গেলে কোনো প্রমাণ ছাড়াই অধীনস্থ লোকটিকে নির্যাতন শুরু করে দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে দেখা যায় যে, নিজেদেরই কেউ তা অন্যত্র সরিয়ে রেখেছে অথবা পরে প্রমাণ হয়েছে যে, কাজটি সে করেনি। কিন্তু শাস্তি যতটুকু পাওয়ার তা সে ইতোমধ্যে পেয়ে গেছে। এ জন্য তার কাছে মাফ চাওয়া তো দূরের কথা উল্টো অন্য কোনো অভিযোগ চাপিয়ে দিয়ে তাকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়। এক হাদিসে বর্ণিত আছে ‘এক মহিলা রাসূল সা:-কে এসে বললেন, হে রাসূল! আমি আমার বাঁদিকে ‘ব্যভিচারিণী’ বলে গাল দিয়েছি। রাসূল সা: বললেন, ‘তুমি কি ব্যভিচারের কোনো লক্ষণ তার মধ্যে দেখেছ? মহিলা বলল, না। রাসূল সা: বললেন, ‘সাবধান, এই মেয়েটি কিয়ামতের দিন তোমার কাছ থেকে বদলা নেবে’। মহিলা তৎক্ষণাৎ তার বাঁদির কাছে গেল এবং তাকে একটা লাঠি দিয়ে বলল, আমাকে মারো। বাঁদিটি রাজি হলো না। তখন ওই মহিলা তাকে আজাদ করে দিলেন। তারপর সে রাসূল সা:-এর কাছে এসে বাঁদিকে স্বাধীন করার খবর জানালেন। রাসূল সা: বললেন, ‘আশা করা যায়, তোমার গুনাহ মাফ হবে’।
অসহায় লোকটির রক্ত-মাংস আর আপনার রক্ত-মাংস একই উপাদানে তৈরি। কারণ একজন মানুষ থেকে সব মানুষের উৎপত্তি এবং রক্ত-মাংস ও শারীরিক উপাদানের দিক থেকে তারা প্রত্যেকে প্রত্যেকের অংশ। প্রথমে এক ব্যক্তি থেকে মানবজাতি সৃষ্টি করা হয়। তাঁর থেকেই এ দুনিয়ার মানববংশ বিস্তার লাভ করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মানব জাতি! তোমাদের রবকে ভয় করো। তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একটি প্রাণ থেকে। আর সেই একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন তার জোড়া। তারপর তাদের দু’জনার থেকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। সেই আল্লাহকে ভয় করো যার দোহাই দিয়ে তোমরা পরস্পরের কাছ থেকে নিজেদের হক আদায় করে থাকো এবং আত্মীয় ও নিকট সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকো। নিশ্চিত জেনে রাখো, আল্লাহ তোমাদের ওপর কড়া নজর রেখেছেন।’ (আন নিসা : ১)
ধনসম্পদ, বংশমর্যাদা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির ভিত্তিতে একজন অন্যজনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে পারে না। তবে আল-কুরআন একমাত্র তাকেই অধিক মর্যাদা দান করেছে যিনি আল্লাহকে বেশি ভয় করেন। ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণে রাসূল সা: বলেন : ‘অনারবদের ওপর আরবদের, আরবদের ওপর অনারবদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তেমনি সাদার ওপর কালো কিংবা কালোর ওপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তোমরা সবাই আদমের সন্তান আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে। মর্যাদার ভিত্তি হচ্ছে শুধু তাকওয়া। সুতরাং সবাইকে বলব অধীনস্থ দুর্বল শ্রেণী, চাকর-চাকরানীদের সাথে দুর্ব্যবহার ও নিষ্ঠুর আচরণ আর করবেন না। এদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করা কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এদের প্রতি সদয় হওয়ার সুমতি দিন। আমিন।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট