শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০০ পূর্বাহ্ন

বেঙ্গল আর্মি

নিজাম আশ শামস :
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৪ মে, ২০২৩

কঠিন এক লড়াইয়ের মাধ্যমে ফরাসিদের চন্দননগর কুঠি জয় করে নিলেন রবার্ট ক্লাইভ। তখন ১৭৫৭ সালের মার্চ মাস। ক্লাইভের সেনাবাহিনীতে ছিল পাঠান, রোহিলা, জাট, রাজপুত ইত্যাদি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। বিহার, অযোধ্যা, দোয়াব, রোহিলাখ-, এমনকি ভারতবর্ষের বাইরের বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা এসেছিল। আফগান ও মোগল শাসনের সময় ভাগ্য অন্বেষণে কলকাতায় আগমন ঘটে তাদের পূর্বসূরিদের। সেনাবাহিনীতে অংশ নিয়ে তারা প্রয়োজন মিটিয়েছিল বাংলার সুবাদারদের। কিন্তু প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার পর তারা অবাঞ্ছিত ঘোষিত হতো। তাদের উত্তরসূরিদের নিয়েই বাংলায় সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাটালিয়ন গঠন করেন রবার্ট ক্লাইভ।
২০ জুন, ১৭৫৬। নবাব সিরাজউদ্দৌলার হাতে পতন হয় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের। পালিয়ে গেলেন কোম্পানির বাংলা প্রদেশের গভর্নর রজার ড্রেক ও কমান্ডার ক্যাপ্টেন মিনচিন। এ বিপর্যয়ের পর মাদ্রাজ ও বোম্বেতে সাহায্যের আবেদন জানায় বেঙ্গল কাউন্সিল। এরই মধ্যে এ দুটি প্রদেশে গঠিত হয়েছে কোম্পানির নিজস্ব আর্মি। মাদ্রাজ কাউন্সিল তখন ফ্রান্সের আক্রমণের আশঙ্কায় ছিল। তবে খানিক দ্বিধা ও কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে তারা বেঙ্গল কাউন্সিলকে উদ্ধারকল্পে একটি সৈন্যদল প্রেরণ করে। এ দলে ৬০০ জন ইউরোপীয় অফিসার এবং ৯৪০ জন ভারতীয় সিপাহি ছিল। এ বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন ছিলেন তার সহযোগী। তখন কে ভেবেছিল যে, এ ক্লাইভই অনতিবিলম্বে পাল্টে দেবেন বাংলার ইতিহাস! ১৭৫৭ সালের জানুয়ারিতে তিনি কলকাতা পুনরুদ্ধার করেন। নবাব সন্ধি করতে বাধ্য হন। তার নিকট যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ আদায় করেন ক্লাইভ। বাংলায় কোম্পানি আরো কিছু সুবিধা ও অধিকার আদায় করে নেয়।
ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে শুরু হয়েছে সপ্তবর্ষী যুদ্ধ (১৭৫৬-১৭৬৩)। তার ছোঁয়া এসে লেগেছে সুদূর বাংলায়। উপমহাদেশে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ধারণা করা হচ্ছে ফরাসিদের সঙ্গে আঁতাত করেছেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। এ নিয়ে চিন্তিত রবার্ট ক্লাইভ। কথা ছিল ফোর্ট উইলিয়াম পুনর্দখল করে তিনি ফিরে যাবেন মাদ্রাজে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে তা হওয়ার নয়। তিনি সিরাজউদ্দৌলাকে ফরাসি নবাব মনে করতেন। পরিবর্তে তিনি একজন ইংরেজ নবাব তৈরি করার দিকে মনোযোগী হলেন।
তখন পর্যন্ত ব্রিটিশ কোম্পানি কেবল বাণিজ্যেই ব্রতী ছিল। কোনো সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার বাসনা তাদের মনে দানা বাঁধেনি। ভারতীয় শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ তারা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে চাইত। বাণিজ্যের অগ্রগতির স্বার্থে তারা শান্তি বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিল। তবে সময়ের চাহিদা ছিল ভিন্ন। বাংলায় কোম্পানির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তারা কলকাতায় নবাবের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। তাকে পরাজিত করেছে। কিন্তু ফরাসিদের সঙ্গে নবাবের শক্তির মেলবন্ধন তাদের ফেলতে পারে শনির দশায়। সে কারণে কোম্পানির বেঙ্গল কাউন্সিল সশস্ত্র সেনাবাহিনীর প্রয়োজন অনুভব করে। চাহিবামাত্র তো আর ইংল্যান্ড থেকে সৈন্য আনা যায় না, তাই ক্লাইভ নজর দিলেন স্থানীয় উৎসে। মাদ্রাজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি ইউরোপীয় অফিসার ও স্থানীয় সিপাহিদের সমন্বয়ে গড়ে তোলেন বেঙ্গল আর্মি। তার কিছুটা আন্দাজ এ লেখার শুরুতে দেয়া হয়েছে।
ক্লাইভ বাহিনী গঠন করেই দায় সারেননি। এর যথাযথ উন্নতিকল্পে দিয়েছেন কঠোর শ্রম। ভারতীয় সিপাহিদের তিনি যতদূর সম্ভব ইউরোপীয় সৈনিকদের মতো করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি তাদের আধুনিক যুদ্ধকৌশল এবং শিষ্টাচার শিক্ষা দেন। তিনি তাদের ইউরোপীয় অস্ত্র ও সাজে সজ্জিত করেন। তাদের ইউনিফর্ম ছিল ইউরোপীয়। তাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল নন-কমিশনড ইউরোপীয় অফিসারদের কাঁধে। এ নতুন সিপাহি ব্যাটালিয়নের নেতৃত্ব লাভ করেন ক্যাপ্টেন রিচার্ড নক্স। মাদ্রাজ থেকে ক্লাইভের সঙ্গে এসেছিলেন তিনি। এভাবে প্রথম বেঙ্গল আর্মি সংগঠিত হলো। এর অধীন সিপাহি ব্যাটালিয়নের সদস্যরা ইউরোপীয় অফিসারদের দ্বারা প্রশিক্ষিত হলো ইউরোপীয় পদ্ধতিতে। এক্ষেত্রে ভারতবর্ষে এটিই প্রথম দৃষ্টান্ত। তার আগে গঠিত হওয়া মাদ্রাজ ও বোম্বে প্রদেশের সিপাহিদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিল ভারতীয় অফিসার। স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপীয় প্রশিক্ষকদের অবদানে বেঙ্গল সিপাহি ব্যাটালিয়ন হয়ে উঠেছিল অধিকতর চৌকস। ক্লাইভের এ উদ্যোগ ব্যাপক প্রশংসা লাভ করে। পরবর্তী সময়ে মাদ্রাজ ও বোম্বে তা অনুসরণ করে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর ময়দানে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় বেঙ্গল আর্মি। এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সিপাহি ব্যাটালিয়ন। এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত তারা করেছিল ঠিক একশ বছর পরে। ১৮৫৭ সালে।
১৭৫৭ সালের আগস্ট মাসে রবার্ট ক্লাইভ বেঙ্গল আর্মির দ্বিতীয় সিপাহি ব্যাটালিয়ন তৈরি করেন। এর মাধ্যমে তিনি বড় একটি সমস্যার সমাধান করেন। কলকাতা ও চন্দননগরে অবস্থানরত ইউরোপীয় সৈন্যদের মৃত্যুহার ছিল বেশি। প্রতিকূল আবহাওয়া, অধিকতর পরিশ্রম ও ক্লান্তি ছিল এর কারণ। আরো সমস্যা ছিল। পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর এসব সৈন্য প্রচুর নগদ অর্থ পেয়েছিল পুরস্কার হিসেবে। সে কারণে তারা নানা ধরনের বেলেল্লাপনায় লিপ্ত হয়েছিল। ফলে ১৭৫৭ সালের অক্টোবরের মধ্যে মাদ্রাজ থেকে আসা সৈন্যদলের মাত্র ১৫০ জন জীবিত ছিল। এ ক্ষতি পূরণের জন্য ক্লাইভের ভারতীয় সৈন্যদের দিকে মনোযোগ দেয়া ছাড়া গতি ছিল না। এর মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, বিহারের প্রশাসক রাজা রাম নারায়ণ অযোধ্যার নবাবের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেছেন। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইংরেজদের মনোনীত নবাব মীর জাফরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তিনি পাটনা থেকে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশে রওনা হন। ১৭৫৭ সালের শেষ দিকে মীর জাফর নিজ বাহিনী নিয়ে পাটনা অভিমুখে অগ্রসর হন। এ অভিযানে ক্লাইভ ৫৫০ জন ইউরোপীয় সৈন্য এবং প্রথম ও দ্বিতীয় সিপাহি ব্যাটালিয়ন নিয়ে তার সহযাত্রী হন। তবে কোনো যুদ্ধ হয়নি। রাম নারায়ণ সন্ধি প্রস্তাব করেন। শর্ত অনুসারে, মীর জাফরের পুত্র মীরান বিহারের প্রশাসক হন। রাম নারায়ণ হন তার ডেপুটি। সহজে জয়লাভ করলেও বিচক্ষণ ক্লাইভ নিজের বাহিনী আরো শক্তিশালী করার তাগিদ অনুভব করেন। তাই তিনি বিহার প্রদেশের ভোজপুর জেলা থেকে সিপাহি বাছাই করে তৃতীয় ব্যাটালিয়ন গড়ে তোলেন।
১৭৫৮ সালের শেষ দিকে মাদ্রাজের সেন্ট ডেভিড দুর্গ দখল করে নেয় ফরাসিরা।
এ খবর বাংলায় পৌঁছে। ক্লাইভ বেঙ্গল আর্মির একটি অংশ মাদ্রাজে প্রেরণ করেন। এ আর্মিতে ছিল ৫০০ জন ইউরোপীয় অফিসার এবং দুটি বেঙ্গল সিপাহি ব্যাটালিয়ন। এর নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল ফোর্ড। তিনটির মধ্যে দুটি সিপাহি ব্যাটালিয়ন মাদ্রাজে চলে যাওয়ায় ক্লাইভ বাংলায় আরেকটি সিপাহি ব্যাটালিয়ন গঠন করতে বাধ্য হলেন। তৈরি হলো চতুর্থ বেঙ্গল সিপাহি ব্যাটালিয়ন। কাঠামোগত দিক দিয়ে মাদ্রাজ ও বোম্বের আর্মি থেকে বেঙ্গল আর্মি আলাদা ছিল। মূল পার্থক্য ছিল নেতৃত্বে। প্রতিটি ব্যাটালিয়নের কমান্ডার ছিলেন একজন ইউরোপীয় ক্যাপ্টেন।
একজন লেফটেন্যান্ট ও একজন এনসাইন ফিল্ড অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। আর সিপাহিদের শৃঙ্খলা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব ছিল দুজন সাবঅল্টার্নের ওপর। এ কাজে তাদের সহায়তা করতেন একজন সার্জেন্ট-মেজর ও কয়েকজন সার্জেন্ট। ভারতীয় সেনানায়ক ইউরোপীয় ক্যাপ্টেনের পাশাপাশি সম্মুখভাগে অবস্থান নিতেন। আর ভারতীয় অ্যাডজুট্যান্ট ইউরোপীয় সাবঅল্টার্নদের সঙ্গে ব্যাটালিয়নের পেছন দিকে থাকতেন। প্রতিটি ব্যাটালিয়ন ১০টি কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। এর মধ্যে দুটি ছিল গ্রেনেডিয়ারদের। প্রতিটি কোম্পানিতে ছিলেন একজন সুবাদার, তিনজন জমাদার, পাঁচজন হাবিলদার (এর মধ্যে একজন রজক), চারজন নায়েক, দুজন ড্রামার, একজন ট্রাম্পেটিয়ার এবং ৭০ জন সিপাহি। প্রতিটি কোম্পানির ছিল আলাদা রঙের পতাকা। এ পতাকা কোম্পানিটির সুবাদারের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। মর্যাদার চিহ্ন হিসেবে গ্রেনেডিয়ারদের পতাকার ওপরের দিকে কোনায় থাকত ইউনিয়ন জ্যাক। পর্যাপ্তসংখ্যক ইউরোপীয় অফিসার না থাকার কারণে ক্লাইভ প্রথমে বেঙ্গল আর্মির সব পদ পূরণ করতে পারেননি। তাই সাময়িকভাবে প্রতিটি কোম্পানির অফিসার সংখ্যায় পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছিল। ইউরোপীয় ধাঁচের নেতৃত্ব ও প্রশিক্ষণে বেঙ্গল আর্মি গঠনে ক্লাইভের সার্থকতা বিবেচনা করে কোম্পানির মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সিও তাকে অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৭৫৯ সালে তারা নিজেদের আর্মিকে ক্লাইভীয় পদ্ধতিতে পুনর্গঠন করে। বেঙ্গল আর্মি ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম আধুনিক সেনাবাহিনী হিসেবে গড়ে ওঠে। অন্যান্য প্রদেশের জন্য তা ছিল দৃষ্টান্ত।
সেনাবাহিনী গঠন ও পুনর্গঠনে ক্লাইভ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এদিকে উত্তপ্ত হচ্ছে বাংলার রাজনৈতিক আবহাওয়া। তৎকালীন মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম একদল সৈন্য নিয়ে বাংলা ও বিহার আক্রমণ করতে অগ্রসর হন। মীর জাফর পুনরায় ক্লাইভের সহায়তা কামনা করেন। মাদ্রাজে যাওয়া বেঙ্গল আর্মির দুটি ব্যাটালিয়ন তখনো ফিরে আসেনি। তাই ফোর্ট উইলিয়ামের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তিনি আরেকটি ব্যাটালিয়ন গঠন করেন। সংখ্যাক্রমের দিক থেকে এটি পঞ্চম। কোম্পানির বাহিনী নবাবের সঙ্গে যোগ দেয়। যুবরাজ পরাজিত হন এবং ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হন। ১৭৫৯ সালের শেষপাদে ক্লাইভ ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে জয়লাভ করেন। ইউরোপীয় সৈন্য এবং পঞ্চম নেটিভ ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল।
১৭৬০ সালের জানুয়ারি মাসে ভারত ত্যাগ করেন রবার্ট ক্লাইভ। যাওয়ার আগে তিনি নিজ হাতে গড়া বেঙ্গল আর্মির পাঁচটি সিপাহি ব্যাটালিয়নের কাঠামোগত পরিপূর্ণতা দিতে সক্ষম হন। মাদ্রাজ থেকে কয়েকজন অফিসারকে ডেকে এনে তিনি প্রতিটি ব্যাটালিয়নে ইউরোপীয় কমিশনড ও নন-কমিশনড অফিসারের কোটা পূরণ করেন। প্রতিটি ব্যাটালিয়নে তিনি আরো ১০০ জন সিপাহি নিয়োগ দিয়ে এগুলোকে অধিকতর শক্তিশালী করেন। এভাবে পাঁচটি ব্যাটালিয়নের প্রতিটিতে সিপাহি সংখ্যা এক হাজারে উত্তীর্ণ হয়।
ক্লাইভ চলে গেলেন। তার স্থলাভিষিক্ত হলেন ভানসিটার্ট। কিন্তু ঝামেলা লেগেই ছিল। বাংলার নবাব মীর জাফর ইংরেজদের আনুগত্য অস্বীকার করলেন। অন্যদিকে মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলার সাহায্যে বাংলা আক্রমণ করতে উদ্যত হলেন। ১৭৬১ সাল পর্যন্ত কোম্পানিকে এ দুটি শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাতে হয়েছিল। এসব যুদ্ধে তৃতীয় ও চতুর্থ বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রি কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বেঙ্গল কাউন্সিল কোম্পানির সাম্রাজ্য রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১৭৬১ সালে বেঙ্গল আর্মিতে আরো দুটি সিপাহি ব্যাটালিয়ন যোগ করে। একটি পাটনায়, অন্যটি চট্টগ্রামে। এভাবে ১৭৬২ সালের জানুয়ারির মধ্যে ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নরের অধীন বেঙ্গল আর্মির সিপাহি ব্যাটালিয়নের মোট সংখ্যা হলো সাত।
১৭৬৩ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল আবার যুদ্ধে জড়াল। এবার নবাব মীর কাসিম খানের বিরুদ্ধে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে সে বছর বর্ধমান, মেদিনীপুর, চট্টগ্রাম ও কলকাতায় কয়েকটি নতুন সিপাহি ব্যাটালিয়ন গঠন করা হলো। ১৭৬৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রাক্কালে ১০টি সিপাহি ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে গঠিত ছিল বেঙ্গল আর্মি। সেনাবাহিনীর তালিকা অনুসারে, সে সময় বেঙ্গল আর্মিতে মোট ১০ হাজার সিপাহি ছিল। তবে প্রতিটি ব্যাটালিয়নে সৈন্য সংখ্যা সমান ছিল না। যেমন পাটনা ব্যাটালিয়নে ২৮০৩ জন ভারতীয় সৈনিক ছিল, অথচ মালদহে ছিল মাত্র ৫৭ জন। সিপাহিদের সংখ্যার অনুপাতে বিভিন্ন ব্যাটালিয়নে দায়িত্বরত ইউরোপীয় অফিসারদের সংখ্যায়ও তারতম্য ঘটত। এ কারণে পাটনা সিপাহি ব্যাটালিয়নে তিনজন ক্যাপ্টেন, দুজন লেফটেন্যান্ট, দুজন এনসাইন এবং ১১ জন সার্জেন্ট ছিলেন, কিন্তু ঢাকা, মালদহ ও কাসিমবাজারের ক্ষেত্রে প্রতিটি ব্যাটালিয়নের দায়িত্বে ছিলেন মাত্র একজন সার্জেন্ট।
১৭৯৬ সালে বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রি পুনর্গঠন করা হয়। এর আগে ১৭৮৬ সালে ব্রিগেড গঠন করা হয়েছিল। এবার তার পরিবর্তে গঠিত হলো রেজিমেন্ট। প্রতিটি রেজিমেন্টে ছিল দুটি ব্যাটালিয়ন। সৈন্য সংখ্যা ছিল নির্ধারিত। ২০ জন সুবাদার, ২০ জন জমাদার, ১০০ জন হাবিলদার, ১০০ জন নায়েক, ৪০ জন ড্রামার এবং ১৬০০ জন সিপাহি। দুটি ব্যাটালিয়নে সমভাবে বিভক্ত ছিল এ বাহিনী। এছাড়া স্টাফ হিসেবে দুজন ড্রিল হাবিলদার, দুজন ড্রিল নায়েক এবং দুজন ভারতীয় ডাক্তার প্রতিটি রেজিমেন্টে সংযুক্ত ছিল। ভারতীয় অ্যাডজুট্যান্টের পদটি বিলুপ্ত করা হয়েছিল। কারণ, তৎকালীন প্রশাসকরা বড় কোনো দায়িত্ব ভারতীয় অফিসারদের ওপর অর্পণ করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। ১৮২৪ সালে দুটি ব্যাটালিয়নের পরিবর্তে অধিকতর বড় একটি ব্যাটালিয়ন দিয়ে প্রতিটি রেজিমেন্ট গঠন করা হয়। ১৮৫২ সাল পর্যন্ত এ কাঠামো অপরিবর্তিত ছিল।
নামে বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রি হলেও এর সদস্যদের মধ্যে বাঙালিদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। অযোধ্যার অধিবাসীদের সংখ্যা ছিল বেশি। অযোধ্যার পাশাপাশি পাটনা ও বিহার থেকেও সেনা সংগ্রহ করা হতো।
তাছাড়া গঙ্গা নদীর উত্তর দিকে অবস্থিত শাহাবাদ এবং ভাগলপুর অঞ্চল থেকেও উল্লেখযোগ্য একটি সংখ্যা এসেছিল। ১৮২৪ সালের বার্মা যুদ্ধের সময় বেনারস, বক্সার, কাউনপুর ও দিনাজপুর অঞ্চল থেকেও বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রিতে সিপাহি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। অযোধ্যা এবং এর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো থেকে (যেগুলো আগে অযোধ্যা সরকারের অধীনে ছিল) নিয়োগকৃত সিপাহি দ্বারা বেঙ্গল ইনফ্যান্ট্রির তিন-চতুর্থাংশ সজ্জিত ছিল। অযোধ্যার অধিবাসীদের অধিকতর গুরুত্ব দেয়ার কারণ ছিল তাদের উন্নত দৈহিক বৈশিষ্ট্য। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের অধিবাসীদের থেকে শারীরিক শক্তির দিক দিয়ে তারা বহু গুণ এগিয়ে ছিল। নির্বাচক কমিটির বিবেচনায় তারা ছিল সর্বোৎকৃষ্ট। তারা সামরিক মেজাজের ছিল। এমনকি বোম্বের সিপাহিদের চেয়েও তাদের অধিকতর শক্তিশালী মনে করা হতো।
অযোধ্যা ও বিহার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। সেনা সংগ্রহ এ দুটি প্রদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবে অধিকাংশ সিপাহি ছিল হিন্দু। তাই বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টে হিন্দুরা মুসলমানদের তুলনায় অধিকতর উচ্চপদ লাভ করত। যদিও ১৭৬৫ সালে রবার্ট ক্লাইভ সুপারিশ করেছিলেন যে, প্রতিটি নেটিভ ব্যাটালিয়ন সমানসংখ্যক মুসলিম ও হিন্দুদের দ্বারা গঠিত হতে হবে, যেন ভারসাম্য বজায় থাকে। তবে এটি অনুসরণ করা হয়নি। শুরু থেকেই প্রতিটি বেঙ্গল ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টে হিন্দুদের অংশগ্রহণ বেশি ছিল। ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত আর্মি কমিশনের এক রিপোর্ট অনুসারে জানা যায়, ১৮৫৭ সালে সাতটি রেজিমেন্টে মুসলমান সিপাহির সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১৭০। হিন্দুদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটি ছিল ৬ হাজার ৫৭২। তিন গুণেরও বেশি। আবার হিন্দু সিপাহিদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সিপাহিদের প্রতি ১০ জনের আটজন ছিল ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়। অবশিষ্ট দুজনের একজন মুসলমান, আরেকজন নি¤œবর্ণের হিন্দু। এছাড়া কিছু খ্রিস্টান, শিখ এবং অন্যান্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের লোকও ছিল। (সূত্র: সিল্করোড,বণিকবার্তা) নিজাম আশ শামস: লেখক ও অনুবাদক




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com