নিঃশব্দ বিপ্লব বোধহয় একেই বলে! আগামী সেপ্টেম্বর থেকে ভারত ও বাংলাদেশ ডলারের দাসত্ব মুক্ত হচ্ছে। সেপ্টেম্বর থেকে ভারত ও বাংলাদেশ আমদানি-রপ্তানি করবে ভারতীয় রুপি এবং বাংলাদেশি টাকায়। এলসি খোলার ক্ষেত্রে তবুও চীনের মুদ্রা ইয়েন ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু ডলার একেবারেই নয়। প্রস্তাবটি ছিল ভারত সরকারের, বাংলাদেশ তা সানন্দে গ্রহণ করে। এতদিন পর্যন্ত রুপি ডলারে পরিবর্তিত করে তা ভারতের টাকায় রূপান্তরিত করা হত, ভারতও ঠিক সেইভাবে টাকা ডলারে পরিবর্তন করে বাংলাদেশ রুপিতে পরিবর্তন করতো। এর ফলে সর্বনি¤œ ছ শতাংশ রুপি কিংবা টাকা ক্ষতি হচ্ছিলো বাংলাদেশ কিংবা ভারতের। নতুন ব্যবস্থায় যেহেতু সরাসরি রুপি থেকে টাকা বা টাকা থেকে রুপিতে কনভার্ট করার ব্যবস্থা থাকছে তাই কোনো পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানিয়েছেন যে, তাঁরা টাকা পে কার্ড নামে একটি ডেবিট কার্ড নিয়ে আসছেন যার দ্বারা টাকা কিংবা রুপি তুলতে পারবে মানুষ। তিনি বলেন, ডলার বিলোপ হওয়ার ফলে উপকৃত হবেন চিকিৎসা করাতে যাওয়া মানুষ, ছাত্ররা এবং অবশ্যই ব্যবসায়ীরা।
২১ এপ্রিল ২০২৩-এ বিবিসি নিউজ বাংলা ‘ডলারের পরিবর্তে রুপিতে বাণিজ্যে কে লাভবান হবে- ভারত নাকি বাংলাদেশ?’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো,‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক লেনদেন ডলারের পরিবর্তে রুপিতে করার বিষয়ে দুই দেশ নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ডলারের দাম ওঠানামার ওপর ভিত্তি করে দুই দেশের মুদ্রার মান নির্ধারণ করা হবে। কিভাবে এই প্রক্রিয়া কাজ করবে সেটি নির্ধারণের জন্য দুই দেশের ব্যাংকগুলোর চুক্তিও করতে হবে। সেজন্য রুপিতে বাণিজ্যের বিষয়টি খুব সহসাই শুরু হচ্ছে না। অন্তত ছয় মাস সময় লাগতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা নীতিগতভাবে রাজি হয়েছি। এ বিষয়ে যাবতীয় প্রক্রিয়া চলছে। যদি ব্যাংকগুলো দেখে যে সব ঠিকঠাক আছে তাহলে তারা এই কার্যক্রম হাতে নেবে। শুরু হওয়ার পর বোঝা যাবে সুবিধা অসুবিধা।” ব্যবসায়ী ও নিয়মিত ভ্রমণকারীদের দাবি, টাকা ও রুপিতে বাণিজ্য হলে উভয় দেশই লাভবান হবে।
তবে বিশ্লেষকদের মত, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বড় ধরণের বাণিজ্য ঘাটতি থাকায় রুপিতে লেনদেনে বাংলাদেশ ঝুঁকিতে পড়তে পারে। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-এর গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “রুপি যেহেতু বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃত না এ কারণে ডলারের বিপরীতে ভারতীয় মুদ্রার দর ঘন ঘন ওঠানামা করবে যা প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের সাথে লেনদেনে।”
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে মার্কিন ডলারের দর ব্যাপক উর্ধ্বমুখি হওয়ায় বাংলাদেশ ও ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে। বাড়তি দামেও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় ডলারের ওপর চাপ কমাতে সরাসরি টাকা ও রুপির মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানির বিষয়ে ভাবছে ঢাকা-দিল্লি।
নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেনের এই উদ্যোগ এক দশক আগেই নেয়া হয়েছিল। সে সময় নানা ঝুঁকি বিবেচনায় প্রস্তাবটি আর আলোর মুখ দেখেনি। তবে গত বছরের ডিসেম্বরে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে রুপিতে বাণিজ্যিক লেনদেন করার প্রস্তাব ওঠে। মার্চে বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। এ বিষয়ে আলোচনা করতে গত ১১ই এপ্রিল বাংলাদেশে সফরে আসে ভারতের একটি প্রতিনিধি দল। তারা বাংলাদেশের ব্যাংকারদের সাথে বৈঠক করে টাকা ও রুপিতে দুই দেশের বাণিজ্যিক লেনদেনের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, পাইলট প্রোগ্রাম হিসেবে প্রাথমিকভাবে চারটি ব্যাংকের মাধ্যমে এই লেনদেন চালু হওয়ার কথা রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে – বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক এবং ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও আইসিআইসিআই।
ভারতের দুটি ব্যাংক লেনদেনের হিসাব খুলবে বাংলাদেশের দুটি ব্যাংকে। একইভাবে বাংলাদেশের দুটি ব্যাংক, ভারতীয় দুটি ব্যাংকে তাদের লেনদেনের হিসাব খুলবে।
ফলে লেনদেনের ক্ষেত্রে স্থানীয় মুদ্রা ডলারে রূপান্তর করতে হবে না। বিনিময় হার হবে সরাসরি টাকা থেকে রুপি বা রুপি থেকে টাকায়। অর্থাৎ, বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে যাবেন বা ভারত থেকে পণ্য আমদানি করবেন, তারা ওই ব্যাংক হিসাবে ভারতীয় রুপি যোগ করতে পারবেন।
একইভাবে কোনও ভারতীয় বাংলাদেশে ভ্রমণের সময় বা বাংলাদেশ থেকে পণ্য কিনতে ব্যাংক হিসেবে টাকা যোগ করতে পারবেন। ভারতের সঙ্গে ব্যবসার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে ব্যবসায়ীরাও দ্রুততম সময়ের মধ্যে লেনদেন করতে পারবেন বলে আশা করছেন।
ভারত বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমদ জানান, “ব্যবসায়ীরা চাইলে টাকা রুপি যে কোনোটায় এলসি খুলতে পারেন। যেহেতু ভারত মূল রপ্তানিকারক সেজন্য রুপিতে এলসি খুললে বিনিময় মূল্যে তারতম্য কম হয়। ডলারের পরিবর্তে ভারতীয় রুপিতে লেনদেন করলে রপ্তানি খরচ কিছুটা হলেও সাশ্রয় হবে।” ঝুঁকির আশঙ্কা বিশ্লেষকদের: বিশ্লেষকদের মত, দুই দেশের বাণিজ্যে বাংলাদেশ যেখানে ঘাটতিতে আছে, সেখানে রুপি ও টাকার লেনদেনের প্রস্তাব তত্ত্বগতভাবে ঠিক মনে হলেও বাস্তবে ভারত লাভবান হবে এবং বাংলাদেশ ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের মতে, ভারতে এমন অনেক পণ্য আছে যার কাঁচামাল তাকে ডলারে অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ওই ধরণের পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি করতে গেলে রপ্তানিকারকরা বেশি দাম নির্ধারণ করতে পারে।
এতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য এই লেনদেন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে মনে করেন মি. মোয়াজ্জেম।
ফলে ডলার সংকটের কারণে যে উদ্দেশ্যে ভারতীয় মুদ্রায় লেনদেনের কথা বলা হচ্ছে সেটি দিনশেষে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য লাভজনক থাকবে কিনা সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
এছাড়া একবার রূপি-টাকায় লেনদেনে গেলে এক পর্যায়ে সেটি একপক্ষীয় মুদ্রা বা রূপি-ভিত্তিক বিনিময় কাঠামোয় উপনীত হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন মি. মোয়াজ্জেম।
এমনটা হলে বাংলাদেশের ওপর অধিক হারে ভারতীয় মুদ্রা ব্যবহারের চাপ তৈরি হবে।
এ ব্যাপারে মি. মোয়াজ্জেম বলেন, “বাণিজ্যিক ঘাটতি থাকা অবস্থায় লেনদেনে গেলে ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশে যেহেতু চাহিদা মাত্র ১২ থেকে ১৩ শতাংশ রুপি আছে। সেক্ষেত্রে ভারত থেকে ঋণ করে কিংবা অন্যদেশের সাথে বাণিজ্য কমিয়ে অথবা ডলারকে রুপিতে রূপান্তর করে ওই বাণিজ্য অব্যাহত রাখার প্রবণতা দেখা যাবে। তখন দেখা যাবে ভারত থেকে ঋণের সুদের চাপ থাকবে আবার ডলার ভাঙালে লোকসান হবে।”
সব মিলিয়ে এই দুই দেশের বড় আকারে স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্যে যাওয়ার তেমন সুযোগ তিনি দেখছেন না।
তার আশঙ্কা, যদি রুপি-টাকায় লেনদেন একবার শুরু হয় তাহলে এটি শুধুমাত্র স্থানীয় পণ্যের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং বিভিন্ন সেবামূলক বাণিজ্য যেমন ভ্রমণ, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়বে, যা বাংলাদেশকে ঝুঁকিতে ফেলবে। এমন অবস্থায় ডলারে লেনদেন করাই নিরাপদ ও স্বস্তিদায়ক বলে তিনি মনে করছেন। কেননা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলার সর্বাধিক ব্যবহৃত মুদ্রা হওয়ায় ডলারে লেনদেনের ঝুঁকি সবচেয়ে কম।
মি. মোয়াজ্জেম পরামর্শ দিয়েছেন, সরকারের সর্বতোভাবে চেষ্টা করা দরকার ডলারের মাধ্যমে বিনিময় টিকিয়ে রাখা। ভারতীয় মুদ্রাকে কম ব্যবহার করা।
সেই সাথে সরকার এখন যেমন সীমিত আমদানি করে ডলারের ব্যবহার কিভাবে কমিয় আনছে এই কাঠামোতেই চলার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশি নাগরিকরা ভারতে চিকিৎসা, পর্যটন ও কেনাকাটা বাবদ প্রচুর ব্যয় করেন। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের মোট আমদানির ১৪ শতাংশ হয় ভারত থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে ২০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশ ভারত থেকে পণ্য আমদানি করেছে এক হাজার ৬১৯ কোটি ডলারের। ঘাটতির পরিমাণ এক হাজার ৪১৯ কোটি ডলার। বাণিজ্য ঘাটতি এবং বাংলাদেশের হাতে যেহেতু যথেষ্ট পরিমাণ রুপি নেই, এ কারণে দুই দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ২০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রুপিতে বাণিজ্যিক লেনদেন করা সম্ভব হবে।
অর্থাৎ ২০০ কোটি ডলারের যে রপ্তানি আয় বাংলাদেশ করছে, সে পরিমাণ বাণিজ্য ভারতীয় মুদ্রায় করার কথা ভাবা হচ্ছে। এর বেশি পণ্য রুপিতে কেনা যাবে না, কারণ রফতানি ছাড়া রুপি পাওয়ার সুযোগ নেই।
ফলে বাংলাদেশকে আমদানি মূল্যের বাকি অংশ অর্থাৎ ১৪শ কোটি ডলারের আমদানি ব্যয় আগের মতোই মার্কিন ডলারে পরিশোধ করতে হবে।
রুপিতে লেনদেনের ফলে বাংলাদেশের যে ২০০ কোটি ডলার বেঁচে যাবে সেটা দিয়ে সরকার অন্য দেশ থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ-ভারত চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমদ। তার মতে, এতে উভয় দেশই লাভবান হবে। বাণিজ্য ২০০ কোটিতে বেঁধে দেয়ায় কোন ঝুঁকিও থাকবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হকের দাবি, এই লেনদেন যেহেতু দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে হবে সে কারণে বার বার মুদ্রা রূপান্তর করার খরচ কমবে। বিনিময় মূল্যে আমরা সাশ্রয় করতে পারবো। আবার বাংলাদেশ থেকে ভারতে নিয়মিত ভ্রমণকারীরাও একে লাভজনক উপায় বলে মনে করছেন।
বাংলাদেশ থেকে কেউ যদি ভারতে ভ্রমণে যান তাহলে তার পাসপোর্টে ডলার এনডোর্স করতে হয়। সেই ডলার ভারতে গিয়ে রুপিতে ভাঙিয়ে খরচ করতে হয়। দুবার মুদ্রা বিনিময়ের কারণে লোকসানে পড়ার কথা জানান ভ্রমণকারীরা। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য ১০৬ টাকা থেকে ১১০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে। সে হিসেবে ১০০ ডলার কিনতে খরচ পড়ছে ১০ হাজার ছয়শ থেকে ১১ হাজার টাকার মতো।এই ১০০ ডলারের বিনিময়ে ভারতীয় রুপি পাওয়া যায় আট হাজার দুইশ থেকে আট হাজার তিনশর মতো। কিন্তু এই লেনদেন যদি সরাসরি টাকা ও রুপিতে হতো তাহলে একই পরিমাণ টাকায় ভারতীয় রুপি পাওয়া যেতো ১৩ হাজার থেকে সাড়ে ১৪ হাজারের মতো। বেশ বড় অংকের ফারাক।’