শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১৩ পূর্বাহ্ন

কুরবানি: তাক্বওয়া ও আল্লাহর নৈকট্য লাভ

মুহাদ্দিস ডক্টর এনামুল হক
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৭ জুন, ২০২৩

হিজরী বর্ষের দ্বাদশ এবং সর্বশেষ মাস জিলহজ্ব। মুসলিম উম্মাহর নিকট এ মাসটি অত্যন্ত মহিমান্বিত ও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এ মাসেই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অদম্য বাসনা নিয়ে সারা বিশ্বের সক্ষম ও সামর্থ্যবান মুসলমানেরা পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেন। শুধু তাই নয়; এ মাসে রয়েছে ইসলামের আরো দুটি শাশ্বত বিধান তথা কুরবানি ও ঈদুল আযহা। যা মুসলিম উম্মাহর মাঝে তাক্বওয়া সৃষ্টি করে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের ঈমানী চেতনাকে করে অধিকতর শাণিত। আল্লাহ তায়ালার নৈকট্যলাভ, আত্মত্যাগ, আত্মোৎসর্গ, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, সাম্য, মৈত্রী, ভালোবাসা, সম্প্রীতি ও তাক্বওয়ার সুমহান মহিমায় ভাস্বর কুরবানি। কুরবানি আমাদের আদি পিতা আদম (আ.) ও তদীয় পুত্র হাবিল-কাবীল এবং মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আ.) ও তদীয় পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর সুমহান আত্মত্যাগ এবং আল্লাহ তাআলার প্রতি অবিচল আস্থা-ভরসা ও জীবনের সর্বস্ব সমর্পণের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সমন্বয়।
কুরবানির পরিচয়
আরবী ‘কুরব’ বা ‘কুরবান’ ও ‘কুরবাতুন’ শব্দটি উর্দু ও ফার্সীতে কুরবানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। যার অর্থ, নৈকট্য, সান্নিধ্য। আল কুরআন, সহীহ হাদীস ও অভিধানে এর কয়েকটি সমার্থক শব্দ দেখা যায়। যেমন;
১. নাহর অর্থে; যেমন, আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের বাণী ‘সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশে সালাত আদায় করুন এবং কুরবানি করুন। -সূরা আল কাউসার, আয়াত: ২। এ অর্থে কুরবানির দিনকে বলা হয়।
২. নাসাক অর্থে; যেমন- মহান আল্লাহর বাণী- ‘আপনি বলুন, আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ সবই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য নিবেদিত’। -সূরা আল আন‘আম, আয়াত: ১৬২।
৩. মানসাক অর্থে; যেমন আল্লাহর বাণী, ‘আমি প্রত্যেক উম্মাতের জন্য কুরবানির বিধান রেখেছি’। -সূরা আল হজ্ব, আয়াত: ৩৪।
৪. আযহা অর্থে; হাদীসে এসেছে, এ অর্থে কুরবানির ঈদকে ঈদুল আযহা বলা হয়।
হাদীসে কুরবানি শব্দটি ব্যবহৃত না হয়ে ‘উযহিয়্যাহ’ এবং ‘যাহিয়্যাহ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
পরিভাষায়: কুরবানি হলো আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্ধারিত সময়ে, নির্দিষ্ট নিয়মে, নির্দিষ্ট পশু যবেহ করা।
কুরবানি ঈদের প্রাক ইতিহাস
আমরা যেভাবে কুরবানির ঈদ উদযাপন করি তার শুরু বস্তুত হিজরতের অব্যবহতি পরে। ঈদুল আযহা তথা কুরবানি দিবসের মাহাত্ম্য ও সুমহান তাৎপর্য যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে হ’লে এর ইতিহাস জানা একান্তভাবেই প্রয়োজন। মুহাম্মাদ (সা) মাক্কা থেকে মাদীনায় হিজরত করেন। মাদীনায় এসে তিনি জানতে পারলেন যে, সেখানকার অধিবাসীগণ শরতের পূর্ণিমায় ‘নওরোজ’ ও বসন্তের পূর্ণিমায় ‘মিহিরজান’ নামে দু’টি উৎসব প্রতিবছর উদযাপন করে থাকে। কিন্তু এ দু’টি উৎসবের চালচলন, রীতিনীতি ছিল ইসলামের সুমহান আদর্শ ও ঐতিহ্য-সংস্কৃতির পরিপন্থি। শ্রেণী-বৈষম্য, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান, ঐশ্বর্য-অহমিকার পূর্ণ স্বীকৃতি প্রদান করত এ দু’টি উৎসব। দু’টি উৎসব ছিল ছয়দিনব্যাপী এবং এ বারোটি দিন ভাগ করে দেয়া হত বিভিন্ন শ্রেণীর লোকজনদের মধ্যে।
ইসলাম হচ্ছে শান্তি, সমৃদ্ধি ও মিলনের সুমহান পুরিপূর্ণ এবং ভারমসাম্যপূর্ণ জীবনাদর্শ। সাম্য, মৈত্রী, প্রেম-প্রীতির মতাদর্শ। ইসলাম শ্রেণীবৈষম্যের স্বীকৃতি দেয় না। তাই শ্রেণীবৈষম্য নির্ভর শালীনতা-বিবর্জিত উৎসব দু’টির বিলুপ্তি ঘটিয়ে মনুষ্য সৃষ্ট কৃত্রিম পার্থক্য দূরীকরণের লক্ষ্যে ধনী-দরিদ্রের মহামিলনের প্রয়াসে মহানবী (সা) প্রবর্তন করলেন দু’টি উৎসব তথা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা বা কুরবানির ঈদ। সহীহ হাদীসে এসেছে, “আনাস ইবন মালিক (রা) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (সা) মাদীনায় আগমনের পর দেখলেন মাদীনাবাসীদের দু’টি উৎসবের দিন রয়েছে, এ দিনে তারা খেলাধুলা, আনন্দ ও চিত্তবিনোদন করে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এ দু’টি দিন কি? তারা বলল, জাহেলী যুগে আমরা এদিনে আনন্দ উৎসব, খেলাধুলা করতাম। রাসূল (সা) তখন বললেন, আল্লাহ তা‘আলা এই দুই দিনের পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দুইটি দিন তোমাদেরকে দান করেছেন। একটি হ’ল ঈদুল ফিতর অপরটি হ’ল ঈদুল আযহা তথা কুরবানির ঈদ।” -সুনানু আবু দাউদ, হাদীস ১১৩৬; সুনানু নাসায়ী, হাদীস ১৫৫৬
কুরবানির প্রথম পটভূমি
মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানির ঘটনা ঘটে আদম (আ.) এর দুই পুত্র হাবিল-কাবীলের মাধ্যমে। কুরআনুল কারীমে হাবিল-কাবীলের কুরবানির ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে; “(হে রাসূল!) আপনি তাদেরকে আদমের পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত যথাযথভাবে পাঠ করে শুনান। যখন তারা উভয়েই কুরবানি করেছিল, তখন একজনের কুরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কুরবানি কবুল হলো না। সে (কাবীল) বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন (হাবিল) বলল, অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকীদের কুরবানি কবুল করেন। সে (হাবিল) বলল, যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হাত প্রসারিত কর, তবুও আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার প্রতি হাত প্রসারিত করব না। কেননা আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।” সূরা আল মায়িদা, আয়াত: ২৭-২৮
তৎকালীন সময়ে কুরবানি কবুল হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল এই যে, আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে কুরবানিকে ভস্মীভূত করে দিত। যে কুরবানি অগ্নি এসে ভস্মীভূত করত না তাকে প্রত্যাখ্যাত মনে করা হ’ত। তখনকার কুরবানির পদ্ধতি সম্পর্কে জনা যায়, কাবিল ছিলো চাষি। তিনি গমের শীষ থেকে ভালগুলো বের করে নিয়ে খারাপগুলোর একটি আটি কুরবানির জন্য পেশ করেন। আর হাবিল ছিলেন পশুপালনকারী। তিনি তার জন্তুর মধ্যে থেকে সবচেয়ে ভাল মোটা তাজা উৎকৃষ্ট একটি দুম্বা কুরবানির জন্য পেশ করেন। এরপর নিয়মানুযায়ী আকাশ থেকে অগ্নিশিখা এসে হাবিলের কুরবানিটি ভস্মীভূত করে দিল। আর কাবিলের কুরবানি যথাস্থানেই পড়ে থাকল। -তাফসীর ইবনে কাসীর, ৩য় খ-, পৃ: ৮২-৮৩; তাফসীরে দুররে মনসূর, ৩য় খ-, পৃ: ৫৪; ফতহুল বায়ান, ৩য় খ-, পৃ: ৪৫; ফতহুল ক্বাদীর, ২য় খ-, পৃ: ২৮-২৯।
এ অকৃতকার্যতায় কাবীলের দুঃখ ও ক্ষোভ আরও বেড়ে গেল। সে আত্মসংবরণ করতে পারল না এবং প্রকাশ্যে হাবিলকে বলে দিল ‘অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব’। হাবিল তখন ক্রোধের জবাবে ক্রোধ প্রদর্শন না করে একটি মার্জিত নীতিবাক্য উচ্চারণ করল। এতে কাবীলের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ও উদারতা ফুটে উঠেছিল। তিনি (হাবিল) বললেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা মুত্তাকী ব্যক্তিদের কুরবানি কবুল করেন।
কুরবানির দ্বিতীয় পটভূমি
কুরবানির সর্বপ্রথম প্রচলন আদি পিতা আদম (আ.) এর সময় থেকে শুরু হ’লেও মুসলিম জাতির কুরবানি মূলতঃ ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (আ.) এবং তদীয় পুত্র ইসমাঈল যবীহুল্লাহ (আ.)-এর কুরবানির স্মৃতি রোমন্থন ও অনুকরণ অনুসরণে চালু হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির হিদায়াতের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন অগ্নি পরীক্ষা নিয়েছিলেন ইবরাহীম (আ.)-এর নিকট থেকে। তিনি প্রতিটি পরীক্ষায় হিমাদ্রীসম ধৈর্য ও ত্যাগের মাধ্যমে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বাণী, ‘যখন ইবরাহীম (আ.)কে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তা পুরোপুরি পূর্ণ করলেন, তখন তিনি বললেন, আমি তোমাকে মাবনজাতির নেতা বানিয়ে দিলাম। সূরা আল বাক্বারা, আয়াত: ১২৪।
মুসলিম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে কুরবানি
মুসলিম জাতি যেহেতু শেষনবী মুহাম্মাদ (সা) এর উম্মাত, সেহেতু তাঁর সুন্নাত বা ঐতিহ্য সংস্কৃতি ছাড়া অন্য কারো ঐতিহ্য-সংস্কৃতি লালন-পালন করার সুযোগ নেই, একমাত্র ইবরাহীম (আ.)-এর ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ব্যতীত। কেননা তিনি মুসলিম উম্মাহর পিতা। এ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে জাগরুক রাখতে আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন, “আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন এবং কুরবানি করুন।” সূরা আল কাউসার, আয়াত: ২।
মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি দেশ ও জনপদে কুরবানির ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদার সাথে উদযাপন করা হয়। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য, লেখা-পড়া ও চাকরিন জন্য বাািড় থেকে দূর-দূরান্তে অবস্থান করা মানুষগুলো পরিবার-পরিজনের সাথে কুরবানিতে অংশগ্রহণের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হ’লেও বাড়িতে চলে আসে। শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্রই সাজ-সাজ রব পরিলক্ষিত হয়। ধনী-দরিদ্র, ইতর-ভদ্র, রাজা-প্রজা সকল ভেদাভেদ ভুলে সকলেই খোলা আকাশের নীচে এক কাতারে দাঁড়িয়ে ঈদের সালাত আদায় করে। সালাতের পর সকলে একসাথে কুরবানি করে কুরবানির গোশত গরীব-দুঃখী, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে বিতরণের যে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তা সত্যিই অবিস্মরণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ।
কুরবানির শরয়ী বিধান
কুরবানির শরয়ী বিধানের বিষয়ে ‘আলিমগণের দু’টি মত রয়েছে। যথা-
১. ওয়াজিব: হানাফী মাজহাব অনুযায়ী সামর্থ্যবানদের ওপর কুরবানি করা ওয়াজিব। তাঁদের দলীল-কুরআনুল কারিমের ভাষায়: ‘সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের জন্য সালাত এবং কুরবানি আদায় করুন।” সূরা আল কাউসার, আয়াত: ০২।
সহীহ হাদীসে এসেছে, “আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত, নিশ্চয়ই রসূলুল্লাহ (সা) বলেন; কুরবানি করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানি করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটে না আসে।” সুনানু ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩১২৩; মুসনাদু আহমাদ, হাদীস নং ৮২৫৬, ৮২৭৩; শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং ৭৩৩৪; সুনানুদ দারি কুতনী, হাদীস নং ৩৫, ৫৩; আল মুসতাদরাক আলাস সহীহাইন, হাদীস নং ৭৫৬৫, ৭৫৬৬; সুনানুদ দারি কুতনী, হাদীস নং ৫৩; কানযুল উম্মাল ফী সুনানিল আকওয়াল ওয়াল আফয়াল, হাদীস নং ১২১৫৯; শুয়াবুল ঈমান, ৭৩৩৪; সুনানুল বাইহাক্বী আল কুবরা, হাদীস নং ১৮৭৯২; সহীহ তারগীর ওয়াত তারহীব, হাদীস নং ১০৮৭; বুলুগুল মারাম ফী আদিল্লাতিল আহকাম, হাদীস নং ১৩৪৮। সনদ: সহীহ ও হাসান
২. সুন্নাতে মুয়াক্কাদা: জমহুর উলামাগণের মতে কুরবানি করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। তাঁদের দলীল; “উম্মুল মু’মিনীন উম্মু সালামা (রা) হতে বর্ণিত তিনি বলেন রসূলুল্লাহ (সা) বলেন: তোমরা যখন জিলহজ্বের চাঁদ দেখবে এবং তোমাদের কেউ কুরবানি করার ইচ্ছে পোষণ করবে তাহলে সে যেন (চাঁদ উদিত হওয়া হতে কুরবানি পর্যন্ত) তার চুল ও নখ কাটা হতে বিরত থাকে।” সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫২৩৪; ৫২৩৬; আল জামিঈ লিত তিরমিযী, হাদীস নং ১৫২৩; সুনানু আবী দাউদ, হাদীস নং ২৭৯৩; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৫৯১৬, ৫৯১৭; মুসনাদু আহমাদ, হাদীস নং ২৬৬৫৪; সুনানুন নাসাঈ, হাদীস নং ৪৩৬১; আল মুসতাদরাক আলাস সহীহাইন, হাদীস নং ৭৫১৮; আল মু’জামুল কবীর, হাদীস নং ৫৫৭; সুনানু ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩১৫০; শারহু মাআনিল আছার, হাদীস নং ৫৭৮১; শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং ৭৩৩১; মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীস নং ১৪৫৯। সনদ: সহীহ
এখানে তোমাদের কেউ কুরবানি করার ইচ্ছে পোষণ করবে’ দ্বারা কুরবানি করাকে আবশ্যক বুঝানো হয়নি বরং সুন্নাতে মুয়াক্কাদা সাব্যস্ত হতে পারে।
যাদের জন্য কুরবানি ওয়াজিব
জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ সুবহে সাদিক হতে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যদি কেউ নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তাহলে তার জন্য কুরবানি করা ওয়াজিব, তবে এ ক্ষেত্রে যাকাতের ন্যায় বছর পূর্ণ হওয়া শর্ত নয়। নিসাব বলতে হাওয়ায়েজে আসলিয়াহ তথা নিত্যপ্রয়োজনীয় ধন-সম্পদ বাদ দিয়ে সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্য বা তার সমপরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তাহলে এ জাতীয় প্রত্যেক মুসলিম (নর-নারী), প্রাপ্তবয়স্ক, মুকিম, হজ্বরত না থাকা ও সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন ব্যক্তির ওপর কুরবানি করা ওয়াজিব।
কুরবানি শুধুমাত্র তাক্বওয়া ও আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশেই
একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী প্রিয়পুত্র ইসমাঈল (আ.) কে কুরবানি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে চরম ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন সে ত্যাগের সুন্নাতকে জারি রাখার জন্যই ঈদুল আযহাতে পশু কুরবানি করতে হয়। সেহেতু কুরবানির উদ্দেশ্য হলো তাক্বওয়া অর্জন ও আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জন। সকল রকমের লৌকিকতা পরিহার, কুপ্রবৃত্তির দমন ও পরম করুণাময়ের সন্তুষ্টির মানসে তাক্বওয়ার গুণাবলি অর্জন করাই কুরবানির উদ্দেশ্য। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “কখনোই আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না কুরবানির পশুর গোশত ও রক্ত; বরং পৌঁছায় তোমাদের তাক্বওয়া। তিনি তাদেরকে তোমাদের জন্য এমনভাবে অনুগত করে দিয়েছেন, যাতে তাঁর দেয়া পথনির্দেশনার ভিত্তিতে তোমরা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো। আর হে নবী! সৎকর্মশীলদেরকে সুসংবাদ দিয়ে দাও।” সূরা আল হজ্ব, আয়াত: ৩৭
অর্থাৎ কুরবানিদাতা যেন আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে শুধুমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির জন্যই কুরবানি করে। আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গ করার জযবায় উজ্জীবিত হওয়া, ইবরাহীমের পুত্র কুরবানির ন্যায় ত্যাগ-পূত আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করা ও তাঁর বড়ত্ব প্রকাশ করাই কুরবানি প্রকৃত তাৎপর্য ও শিক্ষা।
কুরবানিসহ বিবিধ ইবাদতে তাক্বওয়া অর্জন
আল্লাহ তাআলা কুরবানির নির্দেশনায় তাক্বওয়ার বিষয় যেমন বলেছেন, ঠিক তেমনি অন্যান্য ইবাদত ও বিধি-বিধানে তাক্বওয়ার বিষয় অপরিহার্য করে দিয়েছেন। রমযানের সিয়াম প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, হে ঈমানদাগণ! তোমাদের ওপর সওম ফরজ করে দেয়া হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। এ থেকে আশা করা যায়, তোমাদের মধ্যে তাক্বওয়ার গুণাবলি সৃষ্টি হয়ে যাবে। সূরা আল বাক্বারা, আয়াত: ১৮৩
আবার কুরআন থেকে হিদায়াত পাবার অপরিহার্য শর্ত বর্ণনায় আল্লাহ তাআলা বলেন, এটি আল্লাহর কিতাব, এর মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। এটি হিদায়াত ‘মুত্তাকী’দের জন্য। সূরা আল বাক্বারা, আয়াত: ২
অতএব তাক্বওয়া অর্জন ইবাদতের অন্যতম শর্ত। যেটি কুরবানির মধ্যেও আল্লাহ তাআলা বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন। আর তাক্বওয়ার বলে বলিয়ান হয়েই আল্লাহ তাআলার রেজামন্দী অর্জন করা যায়।
কুরবানি কবুলের শর্ত
যে কোনো আমল কবুলের পূর্ব শর্ত হলো কয়েকেটি। যথা: ১) ইখলাছ বা বিশুদ্ধ নিয়ত। অতএব সর্বাগ্রে আমাদের নিয়ত বিশুদ্ধ করতে হবে। সহীহ হাদীসে এসেছে, যাবতীয় কাজ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। সহীহুল বুখারী, হাদীস নং ১, ৫৪, ২৩২৯, ৩৬৮৫, ৪৭৮৩, ৬৩১১, ৬৫৫৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫০৩৬; আল জামিঈ লিত তিরমিযী, হাদীস নং ১৬৪৭; সুনানু আবী দাউদ, হাদীস নং ২২০৩; সুনানুন নাসাঈ, হাদীস নং ৭৫, ৩৪৩৭, ৩৭৯৪; সুনানু ইবন মাজাহ, হাদীস নং৪২২৭; মুসনাদু আহমাদ, হাদীস নং ১৬৮, ৩০০; সহীহ ইবন খুযাইমা, হাদীস নং ১৪২; মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীস নং ১। সনদ: সহীহ ২) হালাল সম্পদের দ্বারা কুরবানি করা। অতএব হারাম পন্থায় উপার্জিত সম্পদ দিয়ে কুরবানি দিলে তা কবুল হবে না। সব ইবাদত কবুলের অন্যতম পূর্ব শর্ত হালাল উপার্জন। সহীহ হাদীসে এসেছে, হে লোকসকল! আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র ছাড়া অন্য কিছু কবুল করেন না। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৩৯২; সুনানুদ দারিমী, হাদীস নং ২৭১৭; শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং ১১৫৯। সনদ: সহীহ
কুরবানির শিক্ষা
মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইবরাহীম (আ.) তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আ.) কে আল্লাহর রাহে কুরবানি দেয়ার সুমহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যেভাবে ঈমানী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মানবজাতিকে ত্যাগের শিক্ষা দিয়ে গেছেন, সে আদর্শ ও প্রেরণায় আমরা আমাদের জীবনকে ঈমানী আলোয় উজ্জীবিত করব, এটাই কুরবানির মৌলিক শিক্ষা। ত্যাগ ছাড়া কখনোই কল্যাণকর কিছুই অর্জন করা যায় না। মহান ত্যাগের মধ্যেই রয়েছে অফুরন্ত প্রশান্তি।
পশু কুরবানি মূলত নিজের নফস তথা কুপ্রবৃত্তিকে কুরবানি করার প্রতীক। কুরবানি আমাদেরকে সকল প্রকার লোভ-লালসা, পার্থিব স্বার্থপরতা ও ইন্দ্রিয় কামনা-বাসনার জৈবিক আবিলতা হতে মুক্ত ও পবিত্র হয়ে মহান প্রতিপালকের প্রতি নিবেদিত বান্দা হওয়ার প্রেরণা যোগায় এবং আল্লাহর যমীনে তারই দীন প্রতিষ্ঠার পক্ষে আত্মোৎসর্গ করতে অনুপ্রাণিত করে। কুরবানির সার্থকতা এখানেই। তাই পশুর গলায় ছুরি চালানোর সাথে সাথে যাবতীয় পাপ-পঙ্কিলতা, কুফর, শিরক, হিংসা-বিদ্বেষ, রাগ-ক্রোধ, রিয়া-লৌকিকতা, পরচর্চা-পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা, আত্মগর্ব, আত্মঅহংকার, কৃপণতা, ধনলিপ্সা, দুনিয়ার মায়া-মুহাববত কলুষতার মত যেসব জঘণ্য পশুসুলভ আচরণ সযতেœ লালিত হচ্ছে তারও কেন্দ্রমূলে ছুরি চালাতে হবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি মুহূর্তে প্রভুর আনুগত্য, নির্দেশনা প্রতিপালন ও তাক্বওয়ার দ্বিধাহীন শপথ গ্রহণ করতে হবে।
সমাপনী
পরিশেষে বলা যায়, কুরবানির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি শুধু মুসলিম মিল্লাতের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। যুগ-যুগান্তরের প্রতিটি ধর্মে কুরবানির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু অন্যান্য ধর্মের কুরবানির পদ্ধতি ও মুসলিম মিল্লাতের কুরবানির পদ্ধতির মাঝে বহু বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। মুসলমানদের কুরবানি নিছক কোন আনন্দ-উল্লাসের উৎসব নয়, বরং এটি আত্মত্যাগ, আত্মোৎসর্গ, আত্মসমর্পণের একটি সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মুসলমানদের কুরবানির সংস্কৃতির প্রবর্তক স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আ.) ও তদীয় পুত্র ইসমাঈল (আ.) যে অবিস্মরণীয় ত্যাগ, আল্লাহর নির্দেশের প্রতি অবিচল আস্থা ও আনুগত্যের চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সেই স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় ও পালনীয় কল্পে কুরবানির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আবহমানকাল যাবৎ চলে আসছে। শুধু পশুর গলায় ছুরি চালানোতে প্রকৃত কোন সার্থকতা নেই, বরং কাম-রিপু, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, অহমিকা-দাম্ভিকতা, অবৈধ অর্থ লিপ্সা, সুদ-ঘুষ, দুর্নীতি, পরচর্চা-পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতাসহ যাবতীয় মানবীয় পশুত্বের গলায় ছুরি চালাতে পারলেই কুরবানি সার্থকতা বয়ে আনবে।
আসুন নিজে কুরবানি দেই এবং অপরকে উদ্বুদ্ধ করি। কুরবানির গোশত ও চামড়া থেকে গরিব-দুস্থ মানুষদের অধিকার বুঝিয়ে দেই। নিষ্ঠার সাথে কুরবানি দিয়ে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের পথে এগিয়ে যাই। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মানুষ দেখানোর জন্য কুরবানি নয় বরং পশুকে যবাইয়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে মনের পশু ও আমিত্বকে যবাই করি এবং কুরবানির মাধ্যমে তাক্বওয়ার গুণে গুণান্বিত হয়ে আল্লাহর নির্দেশিত কুরআনী সমাজ বিনির্মাণে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখি। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাউফিক দান করুন। আমীন




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com