বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সম্মানের সঙ্গে উদযাপনের লক্ষ্যে ব্রিটেনে পালিত হচ্ছে ‘সাউথ এশিয়ান হেরিটেজ মাস’। গত ১৮ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এ উদযাপন শেষ হবে আগামী ১৭ আগস্ট। ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের কয়েকশ কমিউনিটি সংগঠন রয়েছে। অথচ, ২০১৯ সাল থেকে সেখানে এ মাসটি পালিত হলেও ২৭ জুলাই ও পহেলা আগস্ট দুটি বাংলা চলচিত্রের প্রদর্শনী শো এবং ৫ আগস্ট স্টোরি অব বেঙ্গল শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান ছাড়া মাসটিতে দশ লক্ষাধিক বাংলাদেশি বহুল বাংলাদেশ কমিউনিটির দৃশ্যমান কোনও সম্পৃক্ততা বা অংশগ্রহণ থাকছে না।
ব্রিটেনের অন্য কমিউনিটি বা ব্রিটিশ বাংলাদেশি নতুন প্রজন্মের মাঝে বাংলাদেশের ইতিহাস ও বর্ণিল ঐতিহ্যকে তুলে ধরার নেই কোনও প্রয়াসও। বাংলাদেশের পর পশ্চিমবঙ্গের বাইরে সবচেয়ে বেশি বাংলাভাষী মানুষের বাস ব্রিটেনে। সে কারণে ‘তৃতীয় বাংলা’ বলা হয় ব্রিটেনকে। সেই ‘তৃতীয় বাংলা’তেই এখন বাংলা ভাষার ঘোর দুর্দিন। ব্রিটেনে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রজন্মের মধ্যে বাংলা পড়তে-লিখতে পারে সক্ষমদের সংখ্যা গত ১০ বছরে নেমে আসছে পাঁচ শতাংশেরও নিচে।
ব্রিটেনে বাংলাদেশি ও ব্রিটিশ বাংলাদেশি মিলিয়ে ১১ লক্ষাধিক বাংলাদেশির বাস। এ কমিউনিটিতে লন্ডনের ক্যামডেন, কার্ডিফ, বার্মিংহামের হাতেগোনা চার-পাঁচটি খ-কালীন বাংলা স্কুলে সব মিলিয়ে বড়জোর শ’খানেক শিশু বাংলা পড়া ও লেখা শিখছে। হাজার হাজার ব্রিটিশ বাংলাদেশি শিশুর জন্য মাতৃভাষায় শুদ্ধভাবে বলতে, পড়তে বা লিখতে শেখার কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগই থাকছে না।
ব্রিটেনে আশির দশকে জিসিএসই এবং এ লেভেলের পাঠ্যসূচি ও পরীক্ষায় ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে বাংলাকে অর্ন্তভুক্ত করা হয়। সে সময় বছরে কয়েকশ শিক্ষার্থী বাংলায় পড়াশোনা ও পরীক্ষা দিলেও গত বছরে এ লেভেলে বাংলা বিষয়ে পরীক্ষার্থী ছিলেন মাত্র একজন।
আশির দশকে পূর্ব লন্ডনে কয়েকটি মূলধারার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম বঙ্গবন্ধু প্রাইমারি স্কুল, বঙ্গবীর ওসমানী প্রাইমারি স্কুল, কবি নজরুল স্কুল, শাপলা স্কুল নামে নামকরণ করা হয়। গত ৩০ বছরে পূর্ব লন্ডনে বাংলাদেশি জনসংখ্যা কয়েকগুণ বাড়লেও কোনও মূলধারার স্কুল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম বাংলায় রাখার উদ্যোগ দেখা যায়নি। উল্টো কবি নজরুল স্কুল, ওসমানী স্কুলের নাম পরিবর্তনের জন্য শ্বেতাঙ্গরা দফায় দফায় কিছুদিন পরপর পিটিশন দিচ্ছেন। নাম বদলে দেওয়ার জন্য যথারীতি পাবলিক কনসালটেশনও হচ্ছে। ব্রিটেনে বাঙালির ঐতিহ্যের প্রধান প্রতীক আলতাব আলী পার্কের নাম পরিবর্তন করে পুনরায় সেন্ট মেরিজ পার্ক নামকরণের অপচেষ্টাও হয়েছিল। গত এক দশকে ব্রিটেনের বেশিরভাগ বাংলা পত্রিকা ও অনেকগুলো বাংলাদেশি টিভি স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ অধ্যুষিত বিভিন্ন শহরে খুব সামান্য কিছু দোকানপাটের নাম বাংলায় লেখা হলেও ব্রিটেনে জন্ম নেওয়া বর্তমান প্রজন্মের প্রায় ৯০ ভাগ তরুণ বাংলাদেশি বাংলায় পড়তে বা লিখতে পারেন না।
লন্ডনের বার্কিং ও ডেগেনহাম কাউন্সিলর ও নাট্য সংগঠক মুহিব চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশি সংস্কৃতি চর্চার নামে গানের কনসার্ট আর বিভিন্ন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির ব্যবসা চলে। কিন্তু নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটানোর কোনও প্রয়াস নেই। তিনি আরও বলেন, সাউথ এশিয়ান হেরিটেজ মাস উপলক্ষে আমাদের কাউন্সিলে পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি যেভাবে ব্রিটেনে তুলে ধরার সুযোগ ছিল, আমাদের কমিউনিটি সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে।
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাবেক কাউন্সিলর কমিউনিটি নেতা সুনাওর আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এবারও দুটি পুরোনো বাংলা চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী এবং গল্পের অনুষ্ঠান ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি তুলে ধরার কোনও সমন্বিত এবং কার্যকর উদ্যোগ নেই।
যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী এক মিলিয়নেরও বেশি বাঙালির ব্রিটেনের বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের কোনও দৃশ্যমান সম্পৃক্ততা বা অংশগ্রহণ নেই। যুক্তরাজ্যের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে বা ব্রিটিশ বাঙালিদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরার কোনও প্রয়াস নেই। এ ব্যাপারে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের কোনও কার্যক্রম আছে কিনা জানতে হাই কমিশনার সাইদা মুনা তাসনিমের সঙ্গে ফোনে ও লিখিত প্রশ্ন পাঠিয়ে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনও সাড়া দেননি।-বাংলাট্রিবিউন