পৃথিবীতে দুর্যোগ, দুর্ঘটনা একটির পর একটি লেগেই আছে। মহামারী, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, ভূমিধস, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, ঘূর্ণিঝড়, সুনামি, টর্নেডোর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেবল বেড়েই চলছে। কী কারণে কোন দোষে প্রকৃতি দিন দিন এমন অশান্ত হয়ে উঠছে তা খুঁজে বের করার চেষ্টাও চলছে। পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘প্রকৃতি অশান্ত হওয়ার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে পরিবেশ দূষণের কারণে। তারা মনে করেন, কলকারখানা ও ইঞ্জিনচালিত গাড়ির ধোঁয়া থেকে অতিমাত্রায় কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপর দিকে ব্যাপক হারে চলছে বৃক্ষনিধন, বনা ল উজাড় করে নগরায়ন। ফলে প্রকৃতি ভারসাম্য হারাচ্ছে। নেমে আসছে নানা বিপর্যয়।’ মোটকথা পরিবেশবিদরা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মানুষকেই দোষারোপ করছেন। এ কথার মানে দাঁড়ায়- পৃথিবীতে দুর্যোগ তৈরির জন্য মানুষই দায়ী।
আল কুরআনও পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য মানুষকেই দায়ী করেছে। তবে কুরআনের বিশ্লেষণ আর বিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কুরআন বলে, ‘মানুষের কৃতকর্মের কারণে জলে ও স্থলে বিপর্যয় দেখা দেয়। এর দ্বারা আল্লাহ তাদের কোনো কোনো কাজের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা (পাপ থেকে) ফিরে আসে।’ (সূরা রুম : ৪১) অন্যত্র বলেছে, ‘তোমাদেরকে যেসব বিপদাপদ স্পর্শ করে, সেগুলো তোমাদেরই কৃত অপরাধের কারণে। অনেক পাপ তো আল্লাহ (এমনিতেই) ক্ষমা করে দেন।’ (সূরা শুআরা : ৩০) আয়াত দু’টিতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পেছনে স্পষ্টত কারণ হিসেবে মানুষের পাপের কথা বলা হয়েছে। পাপের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হয়, প্রকৃতি অশান্ত হয় এবং নানা দুর্যোগ নেসে আসে- এ কথা ঐতিহাসিকভাবেও সত্য ও প্রমাণিত। অতীতে পৃথিবীর অনেক জাতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধ্বংস হয়েছে। অথচ তখন পৃথিবীতে কলকারখানা ছিল না। ইঞ্জিলচালিত গাড়িও ছিল না। গাছপালাও খুব একটা নিধন হতো না। কিন্তু এরপরও ভয়াবহ দুর্যোগ-দুর্ঘটনার কবলে পড়ে জাতিগুলো ধ্বংস হয়েছে। আজো তাদের ধ্বংসাবশেষ কোথাও কোথাও রয়ে গেছে।
কুরআনের বর্ণনা মতে- হজরত নূহ আ:-এর জাতি ধ্বংস হয়েছিল মহাপ্লাবনে ডুবে। হজরত হুদ আ:-এর জাতি প্রবল ঝড়বৃষ্টিতে, হজরত সালেহ আ:-এর জাতি মহানাদ দ্বারা, হজরত লুত আ:-এর জাতি ভূমি ওলটপালট হয়ে ও হজরত শোয়াইব আ:-এর জাতি অগ্নিবৃষ্টি ও ভূমিকম্পের কবলে পড়ে নিঃশেষ হয়েছিল। আল্লাহদ্রোহী নমরুদ ও তার জাতি মশার কামড়ে মৃত্যুবরণ করেছিল এবং ফেরাউন ও তার জাতি পানিতে নিমজ্জিত হয়ে দুনিয়ার জীবন সাঙ্গ করেছিল। নিকট অতীতে আবরাহা ও তার হস্তিবাহিনী ছোট ছোট পাখিদের প্রস্তরাঘাতে ধ্বংস হয়েছে। সবার ধ্বংসের পেছনে কারণ ছিল পাপ। আল্লাহর অবাধ্যতা।
সুতরাং ‘প্রকৃতি কেন অশান্ত’ এর মূল কারণ সহজেই বের হয়ে যায়। আর তা হলো, মানুষের পাপ। আল্লাহতায়ালা প্রকৃতি দ্বারা তাঁর অবাধ্যদের থেকে প্রতিশোধ নেন। কারণ প্রকৃতির প্রতিটি সদস্য আল্লাহর বাহিনী। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আসমান জমিনের বাহিনীগুলো আল্লাহর জন্যই।’ (সূরা আল ফাতহ : ৪) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনার প্রতিপালকের বাহিনী সম্পর্কে তিনি ছাড়া কেউ জানে না।’ (সূরা মুদ্দাসসির : ৩১) আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘অবশ্যই আমার বাহিনী বিজয়ী হবে।’ (সূরা আস সাফফাত : ১৭৩) উল্লেখ্য : মুফাসসিরিনে কেরাম বলেন, ‘আল্লাহর বাহিনী’ দ্বারা তাঁর সমুদয় সৃষ্টি উদ্দেশ্য। সে হিসেবে পৃথিবীর প্রতিটি সৃষ্টিই আল্লাহর বাহিনী। সুতরাং পৃথিবীর বুকে ঘটমান প্রতিটি দুর্যোগ বা দুর্ঘটনা আল্লাহর নির্দেশে তাঁর বাহিনীরাই ঘটায়। তাই দুর্যোগের হাত থেকে বাঁচতে হলে তথাকথিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও প্রতিকার ব্যবস্থার আগে মানুষকে পাপাচার থেকে ফিরে আসতে হবে। অন্যায়ের পথ পরিহার করতে হবে।
হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, নবি করিম সা: বলেন, ‘যখন সরকারি মাল নিজের মনে করা হয়, আমানতের মাল নিজ মালের মতো ব্যবহার করা হয়, জাকাতকে জরিমানা ভাবা হয়, ইসলাম বিবর্জিত শিক্ষা গ্রহণ করা হয়, পুরুষ স্ত্রীর আনুগত্য করে, মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করে, বন্ধুকে আপন ভাবে, বাবাকে পর মনে করে, মসজিদে শোরগোল হয়, অসৎ লোক জাতির নেতা হয়, ক্ষতির ভয়ে কোনো লোককে সম্মান দেয়া হয়, গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন অধিক হয়, মদ্যপানের আধিক্য ঘটে, পরবর্তীরা পূর্ববর্তী লোকদের বদনাম করে, তখন তারা যেন লু হাওয়া (গরম বাতাস), ভূমিকম্প, ভূমিধস, আকৃতি বিকৃতি, শিলাবৃষ্টি, রক্তবৃষ্টি ইত্যাদির মতো কঠিন আজাবের অপেক্ষা করে, যা অনবরত ঘটতেই থাকবে।’ (তিরমিজি : ২১১১)
সুতরাং পাপই সব সমস্যার মূল। মানুষ যদি আল্লাহর হুকুম সঠিকভাবে পালন করে তাহলে পৃথিবীর আবহাওয়া, জলবায়ু ও প্রকৃতি সব তাদের অনুকূলে হবে। আল্লাহর রহমত ও বরকতের দরজা তাদের প্রতি সর্বদা অবারিত থাকবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আহলে কিতাব যদি তাদের কাছে তাদের রবের পক্ষ থেকে প্রেরিত তাওরাত, ইঞ্জিল ও অন্যান্য আসমানি কিতাবের বিধানাবলি মেনে চলত তাহলে তাদের জন্য ওপর থেকেও রিজিক বর্ষিত হতো এবং নিচ থেকেও ফুটে বের হতো।’ (সূরা আল মায়েদাহ : ৬৬) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘জনপদগুলোর অধিবাসীরা যদি ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে আমি তাদের জন্য আসমান ও জমিনের বরকতের দরজাগুলো খুলে দিতাম।’ (সূরা আল আরাফ : ৯৬) আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা যদি তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং তাঁর দিকে ফিরে আসো তাহলে তিনি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদের উত্তম জীবনোপকরণ দান করবেন।’ (সূরা হুদ : ৩) তাই আসুন আল্লাহর অনুগত হই। পাপ কাজ ছাড়ি। নেক কাজে ব্রতী হই। প্রকৃতি অবশ্যই আমাদের অনুকূলে হবে। ( উৎস: দৈনিক নয়াদিগন্ত অন লাইন) লেখক : কবি ও কলামিস্ট