শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ১০:৩১ পূর্বাহ্ন

রাজু থেকে কালাপাহাড়

নিজাম আশ শামস :
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১১ আগস্ট, ২০২৩

জটিল সমীকরণের মুখোমুখি কালাপাহাড়। তাকে চরম দোলাচলে ফেলে দিয়েছেন সোলায়মান কররানি। একদিকে প্রেম, অন্যদিকে ধর্ম; যেকোনো একটি বিসর্জন দিতে হবে। অনেক ভেবে উভয় কুল রক্ষার একটি উপায় বের করেছিলেন কালাপাহাড়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর হলো না। কৌশলী প্রয়াস হিসেবে একবার ধর্ম ত্যাগের পর বহু প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আর স্বধর্মে ফিরতে পারলেন না কালাপাহাড়। মনোজগতে এক অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটল তার। যে ধর্ম তাকে আর গ্রহণ করল না, সে ধর্মের প্রতি চরম বিদ্বেষী হয়ে উঠলেন তিনি। বিগ্রহ ধ্বংস করা হলো তার জীবনের অন্যতম মিশন। ইতিহাসে তিনি পরিচিতি পেলেন ‘প্রতিমা ধ্বংসকারী’ হিসেবে। তার এ বিধ্বংসী কর্মকা-ের তীব্রতা প্রসঙ্গে গোলাম হোসেন সলিম ‘রিয়াজ-উস-সালাতিন’ গ্রন্থে লেখেন, ‘যেখানে কালাপাহাড়ের ঢাকের শব্দ পৌঁছত, সেখানকার পাথরের মূর্তিগুলোর হাত, পা, কান, নাক ভেঙে পড়ত। তাই এখনো বিভিন্ন জায়গায় হাত ও পা ভাঙা এবং নাক ও কান কাটা মূর্তি দেখা যায়। এটি কালাপাহাড়ের অন্যতম কেরামতি।’
ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের ফাঁকফোকরে বিভিন্ন লোককাহিনী গুঁজে দিয়ে কালাপাহাড়কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন গল্প তৈরি হয়েছে। কালাপাহাড়ের ধর্মান্তরিত হওয়ার গল্পটি তাদের মধ্যে অন্যতম। এটিকে স্রেফ গল্প হিসেবেই পাঠ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ইতিহাসনিষ্ঠতা না খোঁজাটা পাঠকের জন্য মঙ্গলজনক হবে। কালাপাহাড়কে নিয়ে প্রচলিত অসংখ্য লোককাহিনীর প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে এখানে গল্পটি তুলে ধরা হলো। ১৫৬৩ সালে গৌড়ের সিংহাসনে বসলেন পাঠান সুলতান সোলায়মান কররানি। তিনি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় নিজের সাম্রাজ্য বিস্তারের পরিকল্পনা করলেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি অধীনস্থ রাজাদের নিয়ে মোগল সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার মনোভাবও লালন করছিলেন। দিল্লি, অযোধ্যা, গোয়ালিয়র ও এলাহাবাদের অনেক আফগান তার প্রতি আনুগত্য জানিয়েছিলেন। তখন ভুরসুটের (বর্তমান হাওড়া ও হুগলি জেলার সমন্বয়ে গঠিত রাজ্য) রাজা ছিলেন রুদ্রনারায়ণ। তিনি বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর ও পশ্চিম মেদিনীপুরের কিছু অংশ নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিলেন। তার শক্তিশালী নৌবাহিনী ছিল। সোলায়মান কররানির সাম্রাজ্য বিস্তারের পরিকল্পনাকে তিনি হুমকি মনে করলেন। তাই তিনি উড়িষ্যার রাজা গজপতি মুকুন্দদেবের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করলেন। মুকুন্দদেব ১৫৫৯ সালে উড়িষ্যার সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। উড়িষ্যা তখন কলিঙ্গ নামে পরিচিত ছিল। রুদ্রনারায়ণ ও মুকুন্দদেব মিলে ঠিক করলেন যে সোলায়মান কররানি আক্রমণ করার আগেই তাকে আক্রমণ করতে হবে। তাদের আগুনে ঘি ঢাললেন মোগল সম্রাট আকবর। দিল্লির সম্রাটের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন মুকুন্দদেব। সোলায়মান কররানির সম্ভাব্য বিদ্রোহ সম্পর্কে আকবর জ্ঞাত ছিলেন। তাই তিনি মুকুন্দদেব কর্তৃক সোলায়মান কররানিকে আক্রমণ করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কলিঙ্গ ও ভুরসুটরাজ একত্রে গৌড় আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছেন জেনে তিনি খুশি হলেন।
সব জল্পনা-কল্পনা শেষ। গৌড় আক্রমণের জন্য প্রস্তুত যৌথ বাহিনী। এ বাহিনীর সেনাপতি হলেন কালাপাহাড়। ১৫৬৫ সালে হুগলির ত্রিবেণীতে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাজিত হলেন সোলায়মান কররানি। যুদ্ধ জয়ের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব জুটল কালাপাহাড়ের ভাগ্যে। পুরস্কারস্বরূপ তাকে সপ্তগ্রামের প্রশাসক বানিয়ে দিলেন গজপতি মুকুন্দদেব।
যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সোলায়মান কররানির শান্তিচুক্তি হলো। সোলায়মান কররানি নতুন করে পরিকল্পনা করতে লাগলেন। তিনি ভাবলেন, যেহেতু মুকুন্দদেবের প্রতি সম্রাট আকবরের সমর্থন আছে, তাই তাকে আক্রমণ করা নিরর্থক। কিন্তু ভুরসুটের রাজা রুদ্রনারায়ণ তখনো মোগল সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করেননি। তাই সোলায়মান কররানি ভুরসুট আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে সমস্যা হলো কলিঙ্গরাজ মুকুন্দদেব রুদ্রনারায়ণের বন্ধু। তাই প্রয়োজনে তিনি কালাপাহাড়ের সহায়তা পাবেন। আর কালাপাহাড় যতক্ষণ সেনাপতি, ততক্ষণ রুদ্রনারায়ণকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। তাই কালাপাহাড়কে পক্ষে টানতে হবে। আর একবার কালাপাহাড়কে দলে ভেড়াতে পারলে কেবল রুদ্রনারায়ণকেই নয়, মুকুন্দদেবসহ আরো অনেক প্রতিবেশী রাজাদের পরাস্ত করে তাদের রাজ্যগুলো নিজ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন। সবদিক ভেবে এক কূটচাল চাললেন সোলায়মান কররানি। সে চালে কালাপাহাড়ের কিস্তিমাত হলো!
শান্তিচুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে সোলায়মান কররানির প্রাসাদে এলেন কালাপাহাড়। কালাপাহাড়কে আতিথেয়তার দায়িত্ব পড়ল সোলায়মান কররানির সুন্দরী কন্যা গুলনাজের ওপর। কারো কারো মতে, তার নাম ছিল দুলারি। মূলত এটি ছিল সোলায়মান কররানির পরিকল্পনারই অংশ। দুলারির সৌন্দর্য ও গুণে মুগ্ধ কালাপাহাড় তার প্রেমে পড়লেন। তিনি সোলায়মান কররানির কাছে দুলারির পাণিপ্রার্থনা করলেন। সোলায়মান কররানি শর্ত দিলেন, গুলনাজ ওরফে দুলারিকে বিয়ে করতে হলে কালাপাহাড়কে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে মুসলিম হতে হবে। কালাপাহাড় উভয়সংকটে পড়লেন। ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থা! তিনি প্রথমে ধর্মান্তরিত হতে অস্বীকৃতি জানালেন। তিনি একটি পালটা শর্ত দিলেন, গুলনাজই বরং হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করুক। কিন্তু সোলায়মান কররানি তাতে রাজি হলেন না। অগত্যা কালাপাহাড় রাজি হলেন। কিন্তু তার পরিকল্পনা ছিল এমন, গুলনাজকে বিয়ে করে তিনি পুনরায় হিন্দু ধর্মে ফিরে যাবেন। কালাপাহাড় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। তার নতুন নাম হলো মুহাম্মদ ফরমুলি। গুলনাজের সঙ্গে কালাপাহাড়ের বিয়ের খবর বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়ল। সোলায়মান কররানি নিজেই এ খবর ছড়ানোর যথাসাধ্য বন্দোবস্ত করেছিলেন। হিন্দু সমাজ থেকে পরিত্যক্ত হলেন কালাপাহাড়। এমনকি তার পরিবারের সদস্যরাও তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাল।
রাজা মুকুন্দদেব কালাপাহাড়ের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। মুকুন্দদেব ছিলেন গোঁড়া হিন্দু। একজন ধর্মান্তরিতকে তিনি কখনই নিজের সেনাপতি হিসেবে গ্রহণ করবেন না। এ কথা সোলায়মান কররানি ভালোভাবেই জানতেন। তা-ই ঘটল। মুকুন্দদেব আদেশ জারি করলেন যে কালাপাহাড় ও তার বংশধরদের কেউই পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবেন না। আশা ছাড়লেন না কালাপাহাড়। হিন্দু ধর্মে ফিরে যেতে তিনি যেকোনো ধরনের প্রায়শ্চিত্ত করতে রাজি ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণ প-িতদের শরণাপন্ন হলেন। তারা একবাক্যে জানালেন যে হিন্দু শাস্ত্রমতে, কেউ একবার ধর্ম ত্যাগ করলে তার আর ফেরার কোনো উপায় নেই। শেষ উপায় হিসেবে কালাপাহাড় পুরীতে গিয়ে ‘মুক্তি ম-প’-এর মত জানতে চাইলেন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সীমানার ভেতরে একটি পাথরের মঞ্চ আছে। এর ছাদকে ধরে আছে ১৬টি স্তম্ভ। এটিই মুক্তি ম-প নামে পরিচিত। ১৬টি স্তম্ভ দ্বারা পুরীর বিখ্যাত ১৬টি গ্রামকে বোঝায়। এ ১৬টি গ্রামের ব্রাহ্মণরদেরই কেবল মুক্তি ম-পে বসার অধিকার আছে। তারা সেখানে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। ‘মাদল পঞ্জি’ অনুসারে, মুক্তি ম-পের বর্তমান কাঠামোটি ষোলো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নির্মিত হয়েছিল। রাজা মানসিংহের স্ত্রী এটি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু ‘কটকরাজবংশাবলী’ গ্রন্থ অনুসারে, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে মুক্তি ম-পের বর্তমান কাঠামোটি রাজা বীরকেশরী দেবের রাজত্বকালে নির্মিত হয়েছিল। সে যুগে ভারতের পূর্বাঞ্চলে হিন্দু ধর্ম ও আইনসংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে মুক্তি ম-পের ফয়সালাই ছিল চূড়ান্ত। কিন্তু মুক্তি ম-পের ব্রাহ্মণরাও কালাপাহাড়কে উদ্ধারকল্পে এগিয়ে এলেন না। তারাও এ সিদ্ধান্তই দিলেন যে হিন্দু শাস্ত্রে ধর্মত্যাগী ব্যক্তির ধর্মে ফেরার আর কোনো অধিকার নেই। কালাপাহাড়কে তারা অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন।
হিন্দু সমাজে ফেরার সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় কালাপাহাড়ের সামনে কেবল একটি পথই খোলা ছিল। তিনি গৌড়ে ফিরে এলেন। তার প্রতি হওয়া অপমানের প্রতিশোধ নিতে শপথ গ্রহণ করলেন। সোলায়মান কররানি তাকে নিজের সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দিলেন। হিন্দুদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করলেন কালাপাহাড়। যেখানে যেতে লাগলেন, নির্বিচারে প্রতিমা ধ্বংস করতে লাগলেন। হিন্দু ধর্ম ও বিগ্রহের প্রতি মনের সব রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা উগরে দিতে লাগলেন কালাপাহাড়। তিনি উড়িষ্যায় অভিযান চালিয়ে সেখানকার শেষ হিন্দু রাজা মুকুন্দদেবকে পরাজিত করলেন। বলা হয়, মুকুন্দদেবের রানীকে কালাপাহাড় তার জন্য গরুর মাংস পরিবেশনে বাধ্য করেছিলেন। উড়িষ্যার যেখানেই তিনি প্রতিমা পেয়েছেন, সেখানেই তা ধ্বংস করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি কুখ্যাতি অর্জন করেছেন। সমগ্র পূর্ব ভারতে এখনো তার এসব বিধ্বংসী ক্রিয়াকলাপের কথা প্রচলিত। মধ্যযুগে ওড়িয়া ভাষায় রচিত বেশ কয়েকটি ইতিহাস গ্রন্থে কালাপাহাড়ের উল্লেখ আছে। এগুলোর মধ্যে ‘মাদল পঞ্জি’ ও ‘কটকরাজবংশাবলী’র নাম উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া কালাপাহাড়কে কেন্দ্র করে উড়িষ্যায় অনেক লোককাহিনী ও প্রবাদ প্রচলিত। মূর্তি ভাঙার ক্ষেত্রে কালাপাহাড় এতটাই কুখ্যাতি অর্জন করেছেন যে উড়িষ্যার যেকোনো প্রান্তে কোনো একটি মূর্তিতে যদি সামান্যতম ভাঙনের চিহ্নও থাকে, এমনকি যদি তা তার নকশার অংশও হয়, তাহলে অবলীলায় এর দায় কালাপাহাড়ের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়। এভাবেই কিছুটা ইতিহাস, কিছুটা গালগল্পের মিশেলে ‘মূর্তি ধ্বংসকারী’ কালাপাহাড়ের ঐতিহাসিক ‘মূর্তি’ তৈরি হয়েছে।
কালাপাহাড়কে ঘিরে এ ধরনের গল্প প্রচলিত থাকলেও তার প্রকৃত পরিচয় নিয়ে বিতর্ক আছে। ওপরের ঘটনা অনুযায়ী, কালাপাহাড় হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন। পরে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হন। তার প্রকৃত নাম ছিল কালাচাঁদ রায় বা কালিদাস গজদানি। তার আরেকটি নাম পাওয়া যায়Íরাজীব লোচন রায়। কালাপাহাড়ের ডাকনাম ছিল রাজু। কিন্তু নগেন্দ্রনাথ বসু, করুণাসাগর বেহেরা, রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো ঐতিহাসিকদের মতে, কালাপাহাড়ের জন্ম কোনো হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে হয়নি, বরং তিনি এক আফগান মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন। তারা বিভিন্ন ফার্সি গ্রন্থে উল্লেখিত তথ্যের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। যেসব ফার্সি গ্রন্থকে তারা তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন, সেগুলোর মধ্যে ‘তারিখ-ই-ফিরিশতা’, ‘আকবরনামা’, ‘মুনতাখাব-উত-তাওয়ারিখ’, ‘তারিখ-ই-দাউদি’, ‘তারিখ-ই-খানজাহানি’ গ্রন্থের নাম উল্লেখযোগ্য। এগুলোর রচয়িতা যথাক্রমে মুহাম্মদ কাশিম ফিরিশতা, আবুল ফজল, আবদুল কাদির বাদায়ুনি, আবদুল্লাহ ও নিয়ামতউল্লাহ। করুণাসাগর বেহেরা আরেকটি ফার্সি গ্রন্থের দোহাই দিয়েছেনÍশায়খ কবির বাতিনি রচিত ‘আফসানা-ই-শাহান’। এ গ্রন্থ অনুসারে, কালাপাহাড়ের প্রকৃত নাম ছিল ‘এলাহাবাদ’। কৃপাসিন্ধু মিশ্রও তার ‘উৎকল ইতিহাস’ গ্রন্থে কালাপাহাড়ের নামটি উল্লেখ করেছেন। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার ‘বাংলার ইতিহাস-২য় খ- (মধ্যযুগ) গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লেখেন, ‘সুলেমান কররানির সেনাপতি কালাপাহাড় হিন্দু রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান এবং হিন্দুদের মন্দির ও দেবমূর্তি ধ্বংস করার জন্য ইতিহাসে খ্যাত হইয়া আছেন। ইনি প্রথম জীবনে হিন্দু ও ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং পরবর্তীকালে মুসলমান হইয়াছিলেন বলিয়া কিংবদন্তি আছে। কিন্তু এই কিংবদন্তির কোনো ভিত্তি নাই। আবুল ফজলের “আকবরনামা”, বাদায়ুনির “মুনতাখাব উত তাওয়ারিখ” এবং নিয়ামতউল্লাহর “মখজান ই আফগানি” হইতে জানিতে পারা যায় যে, কালাপাহাড় জন্ম-মুসলমান ও আফগান ছিলেন। তিনি সিকান্দার সুরের ভ্রাতা ছিলেন; তাহার নামান্তর “রাজু”। শেষোক্ত বিষয়টি হইতে অনেকে কালাপাহাড়কে হিন্দু মনে করিয়াছেন। কিন্তু “রাজু” নাম হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রচলিত। এই কালাপাহাড় ইসলাম শাহের রাজত্বকাল হইতে শুরু করিয়া দাউদ কররানির রাজত্বকাল পর্যন্ত বাংলার সৈন্যবাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক ছিলেন। দাউদ কররানির মৃত্যুর সাত বৎসর পরে ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে মোগল রাজশক্তির সহিত বিদ্রোহী মাসুম কাবুলির যুদ্ধে কালাপাহাড় মাসুমের হইয়া সংগ্রাম করেন এবং তাহাতেই নিহত হন।
ইনি ভিন্ন আরো একজন কালাপাহাড় ছিলেন। তিনি পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ পাদে বর্তমান ছিলেন। তিনি বাহলুল লোদী ও সিকান্দার লোদীর সমসাময়িক এবং তাহাদের রাজত্বকালে গুরুত্বপূর্ণ রাজপদগুলোয় অধিষ্ঠিত ছিলেন। কেন এ দুইজনের “কালাপাহাড়” নাম হইয়াছিল তাহা বলিতে পারা যায় না। “রিয়াজ-উস-সালাতিন”-এর মতে, কালাপাহাড় বাবরের অন্যতম আমির ছিলেন এবং আকবরের সেনাপতিরূপে উড়িষ্যা জয় করিয়াছিলেন; এই সব কথা একেবারে অমূলক। দুর্গাচরণ সান্যাল তাহার “বাঙ্গালার সামাজিক ইতিহাস” গ্রন্থে কালাপাহাড় সম্বন্ধে যে বিবরণ দিয়াছেন, তাহা সম্পূর্ণ কাল্পনিক, সত্যের বিন্দুবাষ্পও তাহার মধ্যে নাই।’আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তার ‘কালাপাহাড়-কিংবদন্তি ও ইতিহাস’ প্রবন্ধে লেখেন, ‘অতএব উপসংহারে আমরা নিঃসঙ্কোচে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে কালাপাহাড় কোনো ধর্মান্তরিত মুসলমান ছিলেন না। তিনি ছিলেন আফগান সূরবংশীয় একজন আমির এবং অসাধারণ শক্তি ও বীরত্বের অধিকারী একজন অতি প্রখ্যাত যোদ্ধা এবং তার প্রকৃত নাম ছিল খুব সম্ভব রাজু। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন হিন্দুস্তানে। ইসলাম শাহর মৃত্যু ও সিকান্দর সূরের পতনের পরে তিনি বাংলায় আসেন এবং সুলতান সোলায়মান কররানি ও দাউদ কররানির অধীনে কর্মরত থাকেন। ১৫৭৬ সালে দাউদের মৃত্যুর পর তিনি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার বিদ্রোহী আফগান ও মোগল আমিরদের সঙ্গে যোগদান করেন এবং মোগল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে আমরণ সংগ্রামে লিপ্ত থাকেন এবং ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দের যুদ্ধে তিনি প্রাণ হারান।’ জন্মসূত্রে কালাপাহাড় হিন্দু নাকি মুসলিম ছিলেন, তা বিতর্কিত। কিন্তু ভারতবর্ষের ইতিহাসে ‘কালাপাহাড়’ ও ‘আইকনোক্লাস্ট’ শব্দ দুটি যে সমার্থক হয়ে গেছে, এ বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। লেখক: নিজাম আশ শামস: লেখক ও অনুবাদক




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com