শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০১ পূর্বাহ্ন

শূন্যের ওপরে চলছে বাংলাদেশের রাজনীতি

॥ ইয়াসিন মাহমুদ ॥
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১১ আগস্ট, ২০২৩

একটা প্রবাদ আছে- রাজনীতিতে শেষ বলে কোনো কথা নেই। সকাল, দুপুর এবং রাতে একেক সময় রাজনীতিবিদদের বোল বদলে যেতে দেখা যায়। নানা বাঁকে মোড় নেয় রাজনীতি। কথার মারপ্যাঁচে এখন বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করাও দুঃসাধ্য ও কঠিন হয়ে পড়েছে। আকাশের মতো রং বদলাচ্ছে সময়ে সময়ে। রাজনীতিবিদদের কাদা ছোড়াছুড়ি ও নোংরা বুলিচর্চার কা- দেখে আমজনতা চরম বিব্রত। শূন্যের ওপরে চলছে বাংলাদেশের রাজনীতি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতির ফলে আজ বহির্বিশ্বের হাতে বাংলাদেশ অনেকটাই খেলার পুতুল। এ যেন ঘরের বিচার পরকে দেওয়ার পরিণতিও বটে। এ ঘটনা একদিনে সৃষ্টি হয়েছে, এমনটিও নয়। দীর্ঘদিনের সংকট আজ ভয়াবহতায় রূপ নিয়েছে। তাই পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস শূন্যের কোটায়। রাজনীতিতে এ বিশ্বাস ভঙ্গের শেষ অবস্থা কী হবে, তা বলা মুশকিল। তবে সংকট উত্তরণ সময়ের দাবি। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫২ বছরেও এদেশে একটি সুষ্ঠু ভোটব্যবস্থার নিয়মনীতি থাকবে না- এটা ভাবা যায় না। সবার জন্য সমান নীতি থাকবে। সমান অধিকার থাকবে। কেউ যাতে চোরাগলিপথে ক্ষমতায় না আসতে পারে, সে পথও রুদ্ধ থাকবে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি কে ক্ষমতায় এলো- এটা দিয়ে সাধারণ জনগণের খুব বেশি যায়-আসে না। দেশে শান্তি থাকবে, স্বস্তি থাকবে এটাই চাওয়া সবার। কিন্তু সেই স্বপ্ন আজ অধরা রয়ে গেল। এ সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতায় আসতে হবে। এদেশের দেশপ্রেমিক সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহলকে উদ্যোগ নিতে হবে। সাধারণ জনতাকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। আজ আমরা গাছের শেকড় কেটে মাথায় পানি ঢালার ভূমিকা পালন করছি। এ অবস্থায় বাংলাদেশের গণতন্ত্র মুক্তি অসম্ভব। আমাদের আগে সমস্যা নির্ণয় করতে হবে। মানুষের শরীরের সকল অংশই দরকারি, তবে মস্তকই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মুখাবয়ব দিয়ে একজন মানুষকে চেনা যায়। পরিচয় জানা যায়। আজকে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে রাজনৈতিক এ সংকট দূর করতে হবে। একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের মাধ্যমে সেটা সম্ভব অনেকখানি। আর সেটি করার পূর্বশর্তÑ একটি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে জনগণের ভোটাধিকার প্রদানের সুযোগ। জনগণের এ অধিকার নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের এ দেশটি আর দেশ থাকবে না। থাকবে না আমার পরিচয়। টোটালি ভোটব্যবস্থায় গোয়েবলসীয় অবস্থা। এ যেন সর্ষের ভেতর ভূত ঢোকার মতো অবস্থা। মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায় না, ভোট হয় না। অথচ এমপি, মন্ত্রী হয়। আর এই এমপি-মন্ত্রীদের মানুষ কতটুকু সম্মান করছে, তা সবারই অনুমেয়। মানুষের ন্যূনতম মান-সম্মান থাকলে এ ধরনের ভোটে নির্বাচিত হবার সুখানুভূতি নিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার কথা নয়। সম্প্রতি ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংস্থাসহ বিভিন্ন সংগঠন-সংস্থা বাংলাদেশের চলমান এ রাজনৈতিক সংকট নিরসন চায়। তাদের সফরে জনমনে একটা আশা সঞ্চার করলেও তা ফিকে হতে চলেছে। গত ১৭ জুলাই ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে এমপি পদপ্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমের ওপর সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের মারধর, হেনস্তা প্রমাণ করেছে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ভোটের আর কোনো লক্ষণ নেই। মাত্র ১১ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়। তবে অনেক সংস্থার ধারণা ছিল ৬-৭ শতাংশ ভোট কাস্ট হবে। ভোটার উপস্থিতি একদম কম ছিল। কারণ এই ভোটে মানুষের আগ্রহ-উদ্দীপনা ছিল না বললেই চলে। তবে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে এসএসসি পরীক্ষার্থীদেরও আনা হয়েছেÑ এমন একটি নিউজ দৈনিক যুগান্তর অনলাইনে প্রকাশ পায়। এমন একটি ভোটব্যবস্থাকে কীভাবে ভোট উৎসব হিসেবে দেখানো হচ্ছে, তা বুঝে আসে না। আমার মনে হয়, সরকারের উচিত ছিল ঢাকা-১৭ আসনের উপ-নির্বাচনটা অন্তত সহিংস ও কারচুপিমুক্ত করা। ভোটের দিনে একজন এমপি প্রার্থীকে এভাবে পেটানোর ঘটনা আর কোনো দেশে হয়েছে বলে সন্দেহ। পাশেই ছিল পুলিশি টহল। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি হিরো আলমকে রক্ষা করতে। তাকে সাপের মতো পেটানো হয়েছে। এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভোটব্যবস্থার চিত্র হতে পারে না। এ লজ্জা রাখার জায়গা কোথায়? এ দুঃখ কোথায় লুকাই? এ নির্বাচনে ছিল না বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টির শক্তিশালী কোনো প্রার্থী। এ নির্বাচনকে একটি মাইলফলক নির্বাচন হিসেবে জাতীয় নির্বাচনের জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে দেখানো যেত। ভোটের যে অবস্থা, সামনের দিনগুলোয় আরো খারাপ অবস্থা হবে। এবার তো ১১ শতাংশ ভোট কাস্টের খবর আসছে। সামনে এ মানুষগুলোও মুখ ফিরিয়ে নেবে। খোদ আওয়ামী সমর্থকরাও ভোটের মাঠে যাবে কিনা, সেই পরিবেশ দেখার জন্য হয়তো অপেক্ষা করতে হবে। কোনো মন্ত্রতন্ত্র সাধারণ মানুষকে মোটিভেশন করতে সক্ষম হবে বলে আপাতত মনে হচ্ছে না। সরকার ও নির্বাচন কমিশন চরম একটি ট্রাম্পকার্ড হাতছাড়া করল। একটি ভালো ভোটের নজির স্থাপন খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। উল্লেখ্য, ৪ জুলাই ২০২৩ এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন সুষ্ঠু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ভোট সুষ্ঠু না হলে নাকে খত দিয়ে পদত্যাগের ঘোষণাও দিয়েছিলেন। তবে শেষমেশ তিনি তার ওয়াদা রক্ষা করতে পারেননি। তবে পুলিশের বিভিন্ন কর্মকর্তা হিরো আলমের ওপর হামলাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেও দাবি করেন। গত ১৩ জুন মঙ্গলবার রাজধানীর হাজারীবাগ বাজার মাঠে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক শান্তি সমাবেশে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপি আসুক বা না আসুক, সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’ সব মিলিয়ে সহজ হিসাব, সরকার ইতোমধ্যে প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো শুরু করেছে। আর সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে তো অনেক আগেই বিলুপ্তি করেছে। এদিকে নিজেদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সক্ষম না হলেও আগামী নির্বাচনে নিজেদের তত্ত্বাবধানে আবারো ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছে তারা। কোনো প্রকার ভয়-জড়তা তাদের স্পর্শ করছে না। মানে কাউকে বেল দেয়ার বা মূল্যায়ন করার সময় আওয়ামী লীগের নেইÑ এমন একটা অবস্থা। দলটির সাম্প্রতিক কার্যক্রমে তেমনটি আভাস পাওয়া যাচ্ছে। গত ১৮ জুলাই মঙ্গলবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আয়োজিত ‘শান্তি ও উন্নয়ন’ শোভাযাত্রাপূর্ব সমাবেশে ওবায়দুল কাদের আরো বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নির্বাচনের আগে, পরে ও নির্বাচনের সময় শান্তি চায়। বিএনপি মার্কা তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমরা চাই না। বিএনপি মার্কা নির্বাচনকালীন সরকার আমরা মানি না। আওয়ামী লীগের এক দফা-বাংলাদেশের সংবিধান। সংবিধানে যা লেখা আছে, তাই নির্বাচনে প্রয়োগ করব। নির্বাচন কমিশন সেভাবে নির্বাচন করবে। বিএনপি যতই মারামারি করুক, পাল্টাপাল্টি হুমকি দিক না কেন, কোনো কাজ হবে না। সংবিধান থেকে একচুলও আমরা নড়ব না। আওয়ামী লীগ কারো কাছে মাথা নত করবে না।’ এ সমাবেশে বিএনপির পদযাত্রা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বিএনপির এই পদযাত্রা পরাজয়যাত্রা। পদযাত্রার মাধ্যমে তাদের পতনযাত্রা শুরু হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন কী দিয়ে গেছে? তত্ত্বাবধায়ক দিয়েছে? সরকারের পদত্যাগ নাকি শেখ হাসিনার পদত্যাগ? তারা দেয়ার কে? বিএনপি আসলে পেয়েছে একটা হাঁসের ডিম, ঘোড়ার ডিম। আমেরিকানরা এসেছে, বিএনপি মনে করেছে তত্ত্বাবধায়ক দেবে, তারা বলবেন, সংলাপ করতেই হবে। তারা চলে গেল, বিএনপিকে দিয়ে গেল একটা ঘোড়ার ডিম।’ সর্বসাকুল্যে এ কথা বলা যায়, দেশে গণতান্ত্রিক কোনো পরিবেশ নেই। নেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। সর্বত্র স্বৈরতন্ত্রের আধিপত্য। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এমন চিত্র দেখে বুকের ভেতর বিদীর্ণ হাহাকার জেগে ওঠে। এটা কীভাবে সম্ভব? এদেশের রাজনীতিবিদরা কাদের জন্য রাজনীতি করেন? জনগণের জন্যই যদি রাজনীতি হয়; এ জনগণই যদি রাষ্ট্রের মালিক হয়, তাহলে সেই জনগণকে কীভাবে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা শোভা পায়, এসব প্রশ্ন এসে যায় সহসা। এ সংকট যদি আরো ঘনীভূত হয়, তাহলে সহজে মুক্তির পথ মিলবে না। হয়তো সংলাপ-টংলাপ কোনো কিছুরই অপেক্ষা করবে না এদেশের জনগণ। রাজপথেই হয়তো সমাধান খুঁজবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com