হিরো আলম জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন খবরের শিরোনাম। টকশো ও ভিডিও আকারে ব্যাপকভাবে আলোচনা-সমালোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ বেশকিছু বিরোধী রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের অংশ হিসেবে এই সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে। আর এই সময়টিতে দেশের বর্তমান সময়ের অন্যতম ইন্টারনেট সেনসেশন হিরো, অভিনেতা-সোশ্যাল মিডিয়ার আলোচিত ব্যক্তি হিরো আলম বগুড়ায় দুটি উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) ও বগুড়া-৬ (সদর) আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়ে দেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত হতে থাকেন আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলম। উভয় আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হলেও বগুড়া-৪ আসনে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ নেতা এ কে এম রেজাউল করিম তানসেন মশাল প্রতীকে ২০ হাজার ৪০৫ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন তার নিকটতম প্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলম পান (হিরো আলম) ১৯ হাজার ৫৭১ ভোট। মাত্র ৮৩৪ ভোটের ব্যবধানে তিনি পরাজিত হন। নির্বাচনের এই ফলাফল হিরো আলম মেনে নিতে পারেননি। তিনি কারচুপির অভিযোগ তুলেন, বলেন নির্বাচনের ফল পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে বগুড়া-৪ আসনে নির্বাচন তার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে নির্বাচনের লড়াইয়ে পুনরায় পা বাড়ালেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে। রাজধানীর গুলশান, বনানী ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৭ আসন। এই আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ২৫ হাজার ২০৫ জন।
হিরো আলম একটি সাধারণ ও নি¤œবিত্ত পরিবারের সদস্য। নিজের যোগ্যতা ও মেধা দিয়ে ডিশ লাইনের ব্যবসা দিয়ে জীবনের অগ্রযাত্রা শুরু করে, পর্যায়ক্রমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে কখনো নিজে অভিনয় করে নাটক, মডেলিং কখনো বিতর্কিতভাবে গান গেয়ে, কখনো কবিতা আবৃত্তি করে, বই লিখে এক ধরনের জনপ্রিয়তা ও আলোচিত-সমালোচিত হয়ে সারা দেশে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে। আর এই পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের বৈতরণী পাড়ি দিতে নির্বাচনের মাঠে নামেন হিরো আলম। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ আলী আরাফাত (মোহাম্মদ এ আরাফাত) ‘নৌকা’ প্রতীক, জাতীয় পার্টি (জাপা) প্রার্থী সিকদার আনিসুর রহমান ‘লাঙ্গল’, বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রার্থী মো. রেজাউল ইসলাম স্বপন ‘ডাব’, জাকের পার্টির কাজী মো. রাশিদুল হাসান ‘গোলাপ ফুল’, তৃণমূল বিএনপি’র প্রার্থী শেখ হাবিবুর রহমান ‘সোনালী আঁশ’, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রার্থী মো. আকতার হোসেন ‘ছড়ি’ প্রতীক এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলম ‘একতারা’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনে ৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় হিরো আলমের সঙ্গে। ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ আলী আরাফাত ২৮ হাজার ৮১৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম পেয়েছেন ৫ হাজার ৬০৯ ভোট।
ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে শুরু থেকেই প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়েন হিরো আলম। মনোনয়নপত্র দাখিল করার পর হিরো আলমের মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করেছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। পরে নির্বাচন কমিশনে আপিল করে প্রার্থিতা ফিরে পান তিনি। নির্বাচনে প্রচারণা চালানো কালে তিনি শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হন। সর্বশেষ নির্বাচনের দিন বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভোটকেন্দ্রের বাহিরে মর্মান্তিক শারীরিক নির্যাতন বা গণধোলাই ও মারপিটের শিকার হন তিনি। বিকাল ৩টা ২০ মিনিটের দিকে এ ঘটনা ঘটে। মুহূর্তে হিরো আলমের গণধোলাই ও মারপিটের সংবাদ- ভিডিও দেশের গ-ি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্তাপ সৃষ্টি করে। উদ্বেগ জানাতে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক মহল। হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস। যদিও দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকায় জাতিসংঘের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক সমন্বয়কারী শেলডন ইয়েটকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে সরকার। এর মধ্যদিয়ে সরকার তার কঠোর অবস্থান ক্লিয়ার করেছে। একই সঙ্গে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের দিন স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলমের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ঢাকায় অবস্থিত ১২টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূতাবাস। যৌথভাবে এক বিবৃতিতে প্রতিবাদ জানায় দূতাবাসগুলো। যা দূতাবাস ও হাইকমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিদাতা দূতাবাস ও হাইকমিশনগুলো হলো- কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়? ইউনিয়ন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আমরা ১৭ই জুলাই ঢাকা-১৭ আসনের প্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলমের যিনি হিরো আলম নামে পরিচিত, তার ওপর হামলার নিন্দা জানাই। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সহিংসতার কোনো স্থান নেই। আমরা পূর্ণ তদন্ত ও দোষীদের জবাবদিহিতার দাবি জানাই- আগামী নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয় সে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিশ্চিত করতে হবে। ১২ দেশের এই বিবৃতির ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন। তিনি এটিকে অগ্রহণযোগ্য বলে অভিহিত করেছেন। তবে পশ্চিমা কূটনীতিকরাও স্পষ্ট বার্তা দেয়ার চেষ্টা করছেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (২০শে জুলাই) ঢাকায় নিযুক্ত বৃটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক ওবায়দুল কাদের এবং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে দেখা করে তাদের অবস্থান জানিয়েছেন। চাওয়া অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। আলোচনায় এসেছে সাম্প্রতিক রাজপথে সরকার ও বিরোধীদলের কর্মকা-।
এর আগে গত ১২ই জুন বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে হামলার শিকার হন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর মেয়র প্রার্থী মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ দুইজন প্রার্থীর ওপর নির্বাচন চলাকালে হামলাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে অংশগ্রহণমূলক অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সরকারের সদিচ্ছা এবং সক্ষমতা নিয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
এই অবস্থায় ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে হামলার শিকার স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, এই সরকারের আমলে আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনবার নির্বাচন করে মার খেয়েছি। প্রথমে ২০১৮ সালে, এরপর বগুড়ায় উপনির্বাচনে জিতেও ফল পাইনি। আবার ঢাকায় উপনির্বাচন করতে এসে মার খেলাম। আমি চেষ্টা করেছি, সুষ্ঠু ভোট হোক, ভোটাররা ভোট দিতে আসুক। কিন্তু মার খেলাম। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে আর নির্বাচনে যাবো না। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত হিরো আলমও এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে আর অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়েছে।’ ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিলো সে মরে নাই’।
অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিনোদনকেন্দ্রিক হিরো আলম ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং এর প্রেক্ষিতে তার সঙ্গে নির্বাচনের সময় যে আচরণ করা হয়েছে বিশেষত প্রথমে তার মনোনয়ন বাতিল, পরে ফিরিয়ে দেয়া, প্রচার কাজে বাধা দেয়া সর্বোপরি ভোটের দিন তাকে মারধর করা, এ সবের প্রতিক্রিয়ায় হিরো আলমের পক্ষ থেকে নির্বাচনে জাল ভোট দেয়ার অভিযোগ একইসঙ্গে এই সরকারের অধীনে আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা এবং এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে বা হচ্ছে এতে হিরো আলম এখন রাজনৈতিক অঙ্গনেও হিরো হতে যাচ্ছে!