ডেঙ্গু আতঙ্কে সারাদেশের মানুষ এখন আতঙ্কিত। কে কখন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হবে, তা নিয়ে সবাই চিন্তায় আছে। ঔষধ ডেঙ্গু দমনে তেমন একটা কাজে আসছে না। ডেঙ্গু রোগের জন্য দায়ী এডিস মশা ইতোমধ্যেই অনেক মানুষকে হত্যা করেছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আছে হাজারো মানুষ। ডেঙ্গুর আক্রমণে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে সকল বয়সের মানুষই রয়েছে। মারা যাওয়া মানুষগুলো কারো না কারো স্বজন। স্বজন হারানোর বেদনায় তারা ব্যথিত। কান্না এবং শোকে তারা পাথর হয়ে গেছে। অনেকের ফুলের মতো সাজানো সংসার মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেছে। এডিস মশা নামের একটি ছোট্ট মশা ডেঙ্গু রোগের জন্য প্রধানত দায়ী। এটি বিভিন্ন ধরনের গর্ত এবং নালা-নর্দমায় জমে থাকা পানিতে বসবাস করে আর বংশবৃদ্ধি করে। এছাড়া বাসাবাড়ি ও অফিসের আশেপাশে জমে থাকা ময়লা-আবর্জনা, গাছের টবে জমে থাকা পানি এবং বালতিতে জমে থাকা এসির পানিতেও মশা বসবাস করে এবং বংশবৃদ্ধি করে। আর এই সব মশা মানুষকে কামড়ায়। ফলে মানুষ ডেঙ্গুসহ বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। সুতরাং মশার আক্রমণজনিত রোগব্যাধি থেকে বাঁচতে হলে মশা নির্মূল করতে হবে। তার জন্য মশার বসবাসস্থলসমূহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। শহরের নালা-নর্দমা নিয়মিতভাবে পরিষ্কার করতে হবে। কমপক্ষে প্রতি সপ্তাহে এক বার করে শহরের সকল নালা, নর্দমা এবং ড্রেনগুলো পরিষ্কার করতে হবে। এর জন্য পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি যোগান দিতে হবে। একই সাথে মশা নির্মূলের জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধ যোগান দিতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এত আবিষ্কারের যুগে এডিস মশার আক্রমণে মানুষ রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যাবে, তা ভাবতেও কষ্ট হয়। কিন্তু তাই এখন সত্য। অথচ মানুষের অহমিকার শেষ নেই, দাম্ভিকতার অন্ত নেই। একটু ক্ষমতা পেলেই তা নিয়ে বাহাদুরি করতে কারো কোনো কমতি নেই। মানুষ হয়ে ওঠে বেপরোয়া এবং যখন যা খুশি করে বেড়ায়। আর এডিসের মতো ক্ষুদ্র একটি মশার কাছে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে মানুষের অসহায়ত্বের বিষয়টি আবারো দিবালোকের মতো ফুটে উঠেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে মানুষের অভূতপূর্ব উন্নতির যুগেও তারা একটি মশার হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারছে না। সুতরাং মানুষের উচিত, তার অসহায়ত্বের বিষয়টি নিয়ে চিন্তা এবং গবেষণা করা। তার উচিত অহমিকা, অহংকার এবং দম্ভ পরিহার করা। তার উচিত অন্যায় কাজকে পরিহার করা এবং সত্য-ন্যায়ের পথে চলা। তার উচিত স্রষ্টার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা এবং অতীত ভুলের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করা। তা না হলে মানুষের জন্য দুঃখ এবং কষ্টই একমাত্র অর্জন।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণি মানুষের আসলে দম্ভ করার মতো কোনো ক্ষমতা নেই। বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। মানুষের জন্ম, জন্মসময়, জন্মস্থান, মৃত্যু, মৃত্যুসময় এবং মৃত্যুস্থানের ওপর তার কোনো হাত নেই। মানুষ ইচ্ছা করলে নিজের শরীরটাকে এক ফুট বড় করতে পারে না। তার গায়ের রঙটাও পরিবর্তন করতে পারে না। ইচ্ছা করলেই মানুষ আকাশে উড়তে পারে না, সাগর তলে বাস করতে পারে না এবং হাজার বছর ধরে বাঁচতেও পারে না। তবু মানুষের এই সব বিষয়ে কোনো ভাবনা নেই। অর্থ-বিত্ত-আভিজাত্যের নেশায় মশগুল। ক্ষমতার মোহে অন্ধ। জনগণের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। মানুষকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। ঘুষের টাকা আর দুর্নীতি করে কীভাবে সম্পদ বাড়াবে সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। একটি বাড়ি হলে চাই আরো একটি বাড়ি, একটি গাড়ি হলে দরকার আরো একটি গাড়ি। বিলাসিতার শেষ নেই, চাহিদার সীমা নেই। অথচ, এই অর্থ, সম্পদ, আভিজাত্য এবং ক্ষমতার বাহাদুরীÑ সবই ছেড়ে মানুষকে এই পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয়। যে সম্পদ সে অর্জন করে, সে সম্পদ সে ভোগ করতে পারে না। এটাই অনিবার্য বাস্তবতা। তবু মানুষের চাওয়া-পাওয়ার শেষ নেই, অহমিকার অন্ত নেই। আর এসব নিয়ে একটু চিন্তারও কোনো সুযোগ আমাদের নেই। মানুষ এই পৃথিবীতে অনেক কিছু বানিয়েছে, অনেক কিছু আবিষ্কার করেছে এবং পৃথিবীকে অনেক উন্নত করেছে। মানুষের এই অবদানকে এক বাক্যে স্বীকার করি এবং সম্মান করি। কিন্তু এসব মানুষের একক অবদান নয়। কারণ, মানুষ যাই বানিয়েছে তার সবকিছুর উপাদান প্রকৃতিতেই বিদ্যমান। মানুষ কেবল চিন্তা, গবেষণা এবং পরিশ্রম করে সেটাকে ব্যবহারের উপযোগী করেছে। আমরা লোহা দিয়ে বাড়ি, বিমান, জাহাজ তৈরি করেছি। কিন্তু সেই লোহা তো মানুষ তৈরি করেনি। সেটা তো প্রকৃতিতেই ছিল। আমরা জ্বালানি তেল দিয়ে গাড়ি, বিমান, জাহাজ, কলকারখানা সবই চালাচ্ছি। কিন্তু সেই জ্বালানি তেল তো মানুষ বানায়নি। সেটা প্রকৃতিতেই ছিল। মানুষ সেটাকে কেবল ব্যবহার উপযোগী করছে। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির চমকপ্রদ উপাদান কম্পিউটারের চিপসের মূল উপাদান সিলিকন তো প্রকৃতিরই অবদান। মানুষ গবেষণার মাধ্যমে সেটাকে কেবল ব্যবহার উপযোগী করেছে। এভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, প্রতিটি জিনিসই প্রকৃতির অবদান। যে সূর্য পৃথিবীকে আলো দেয়, যে চন্দ্রকে আমরা উপভোগ করি তাও প্রকৃতির দান। আবার সাগর, নদী, পর্বত ও মানুষের সৃষ্ট নয়। যে অক্সিজেন আর পানি নিয়ে আমরা বেঁচে আছি সেটাও প্রকৃতির দান। যে খাবার আমরা খাই তাও সব প্রকৃতির অসীম দান। অথচ, এই প্রকৃতিটা কার দান তা নিয়ে আমরা একটুও চিন্তা করি না।
এদিকে একদল বিজ্ঞানী আমাদেরকে আবার পৃথিবী ছেড়ে মঙ্গলে বসবাস করার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। পৃথিবীটা নাকি ক্রমেই মানুষের জন্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। তাই কিছু মানুষকে মঙ্গলে পাঠানো হবে এবং মঙ্গলে মানুষের বসতি গড়ে তোলা হবে। এজন্য ব্যয় করছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মঙ্গলে মানুষের বসবাস কখনোই সম্ভব হবে না। বিজ্ঞানের চরম উন্নতি সত্ত্বেও তা কখনো সম্ভব হবে না। কারণ বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে না। চিকিৎসা বিজ্ঞান একজন মানুষের রোগ নিরাময়ে সক্ষম। কিন্তু তাই বলে মানুষকে অমরত্ব দানে সক্ষম নয়। নারী গর্ভে থাকা সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে তা প্রসবের আগে জানা সম্ভব। কিন্তু তাই বলে ইচ্ছামত ছেলে অথবা মেয়ে শিশুর জন্ম দেয়া সম্ভব নয়। মানুষ তার ইচ্ছামত দিনরাত্রিকে যেমন বড়-ছোট করতে পারে না, ঠিক তেমনি রোদ-বৃষ্টি আর শীতকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। একইভাবে ভূমিকম্প, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগকে বন্ধ করার উপায়ও মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি। কারণ, মানুষের জ্ঞান এবং ক্ষমতার একটি সীমারেখা আছে, যা অতিক্রম করা কোনদিনও সম্ভব নয়। মানুষ লক্ষ কোটি মাইল দূরের মঙ্গল গ্রহে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, অথচ টাইটানিক ডুবে যাবার একশত বছর পেরিয়ে গেলেও, তারা এখনো সমুদ্রের মাত্র কয়েক শত ফুট নিচ থেকে জাহাজটিকেই তুলতে পারেনি। আর এখনো ডেঙ্গু এবং ম্যালেরিয়াকেও নির্মূল করতে পারেনি। তাই মানুষের উচিত বাস্তবতায় ফিরে আসা, বাস্তববাদী হওয়া এবং এই মহাবিশ্বের স্রষ্টার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করা। মঙ্গল নিয়ে গবেষণা এবং অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন দেশ যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে, তার সিকি ভাগও যদি মানুষের কল্যাণে ব্যয় করত, তাহলে পৃথিবী থেকে ক্ষুধা, দারিদ্র, অশিক্ষা এবং ডেঙ্গুসহ বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি বহু আগেই দূর হতো আর বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবন অনেক উন্নত হতো এবং একই সঙ্গে মানবজাতি সুখী হতো। লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক। omar_ctg123@yahoo.com