শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০৬ পূর্বাহ্ন

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সভ্যতার ভবিষ্যৎ

অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১১ আগস্ট, ২০২৩

অপরাজিতা, দিশা, সানা, লিসা, নাদিরা, সামিয়া ও ফেদা নামগুলোর সাথে পরিচয় কমবেশি সবারই। এরা সবাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে টেলিভিশনের সংবাদপাঠিকা। হইচই ফেলে দিয়েছে টেলিভিশনের সংবাদ পাঠে, বাচনভঙ্গিতে, উপস্থাপনায়। তাদের অতি দ্রুত জনপ্রিয়তায় সংবাদ পাঠক-পাঠিকাদের চোখে সর্ষেফুল দেখার অবস্থা। পাদপ্রদীপের ঝলমলে আলোর বুদ্ধিদীপ্ত সংবাদ পাঠের ও উপস্থাপনার ক্ষেত্রে তাদের সীমাবদ্ধতা ক্রমে প্রতিভাত হচ্ছে। যাদের নাম শুরুতে উল্লেøখ করেছি তারা সবাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফসল। অপরাজিতা বাংলাদেশের টেলিভিশন সংবাদ উপস্থাপনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রথম সফল প্রয়োগ। পৃথিবীজুড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এখন চলছে তুমুল আলোচনা। এভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন আমাদের সমাজজীবনে, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ধীরে ধীরে প্রভাব ফেলছে। ভূমিকাকে আরো শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতার মুখোমুখি করছে মানুষকে। মূলত সফটওয়্যারজাত বুদ্ধিমত্তা, যা মানুষ বা বিভিন্ন প্রাণীর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তার সাথে এখন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হিসেবে পরিচিত। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা বুদ্ধিমত্তার প্রতিফলন, স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠা মানবচিন্তা ও তার পরিধি কি পরাজিত হয়ে হারিয়ে যাবে তার সৃষ্ট কোনো ঊনমানুষরূপী অতিমানবের কাছে?
নতুন উদ্ভাবনের চমক ও পরিবর্তনে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অবদান সীমাহীন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথ্য প্রযুক্তি খাতের কর্মসংস্থানের ওপর ছাপ ফেলেছে। শুরুতে ভাবা হয়েছিল এ প্রযুক্তি মানুষের কাজ সহজ করে দেবে। আনন্দময় করে তুলবে জীবন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি, হচ্ছে না; বরং এর প্রভাবে খোদ সিলিকন ভ্যালিতে কর্মী ছাঁটাইয়ের হার বেড়ে গেছে। কারণ, মানব প্রযুক্তিতে ২৪ ঘণ্টার কাজ করতে লাগবে তিনজন দক্ষ শ্রমিক। বিপরীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক ইউনিট দিয়ে টানা ২৪ ঘণ্টার কাজ আদায় করার সুযোগ উন্মোচিত হয়েছে। উপরন্তু খাওয়ার ঝামেলা নেই, নেই বিশ্রামের ঝামেলা। সাপ্তাহিক মাসিক বাৎসরিক ছুটিরও কোনো বালাই নেই। ফলে কর্মীর ঝামেলা এড়াতে ছুটির পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব মেলানোর ঝামেলা নেই। ফলে নিরবচ্ছিন্ন ব্যবস্থা ঝামেলামুক্ত কর্মপরিবেশে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর স্বাভাবিকভাবে লাভের অঙ্ক বাড়াতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে ইতোমধ্যে। ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের ঘোষণা এর বাস্তবতা। মাত্র গত মে মাসে সিলিকন ভ্যালিতে কর্মচ্যুত হয়েছেন তিন হাজার ৯০০ লোক। সম্প্রতি প্রকাশিত সিএনএনের প্রতিবেদনে আইবিএম, ড্রপবক্সসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাঁটাইয়ের পাশাপাশি নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে কিছু নির্দিষ্ট পেশার ওপর ঝুঁকি বাড়াবে। ভবিষ্যতে এটি মানবকর্মসংস্থানের ওপর কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারে এটি দেখার বিষয়। দ্বিতীয় বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যতই উৎকর্ষ সাধন করুক না কেন, তা মানুষের হৃদয়ের অনুভূতিগুলো এতে কোনোভাবে প্রতিস্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। ফলে এতে কাজ হবে ঠিকই; কিন্তু সেখানে মানবিক অনুভূতির অনুপস্থিতিকে প্রতিস্থাপিত করা সুদূর পরাহত হয়ে থাকবে বলে মনে হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রশ্ন অস্তিত্বের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। নতুন চ্যাটবট মানুষকে সঙ্গ দিচ্ছে, কথা বলছে, শিশুদের খেলার সাথী হচ্ছে, বয়স্কদের প্রমোদ সঙ্গী হচ্ছে। এ সব কিছু একজন ব্যক্তিকে সমাজবিমুখ করে আত্মকেন্দ্রিক করে তুলছে। পরিবার ও সমাজ বিচ্ছিন্ন অবস্থান তৈরি করছে। এখানে সমাজবিজ্ঞান, মানুষ ও বিজ্ঞান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মুখোমুখি হচ্ছে। মানুষ সামাজিক জীব- এ ধারণা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। সমাজের ধ্যান-ধারণা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার সুবাদে মানবসভ্যতা, মানব ইতিহাস সব হয়তো আবার নতুন করে শিখতে হবে। মানুষ ভবিষ্যতে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনরূপী তার সৃষ্টিকে অপার সম্ভবনার পৃথিবীতে স্বাগত জানাবে নাকি আপন সৃষ্ট ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের হাতে সংহারিত হবে তা এখন বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। সভ্যতার স্বর্ণালি অধ্যায় অস্তমিত করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা এখন দেখার বিষয়। বিশ্বব্যবস্থার ভারসাম্য, মানবসমাজ এবং সভ্যতাকে কিভাবে এগিয়ে নেবে; তা এখন ভবিষ্যৎ বলে দেবে। মানুষ অতিমানুষ ও ঊনমানুষ কিভাবে যৌথ প্রচেষ্টায় পৃথিবীতে এগিয়ে নেবে তাই এখন নির্ণয় করবে মানবজাতির ভবিষ্যৎ। ভাগ্যিস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আজ বেঁচে নেই। নইলে ভবিষ্যতের মানুষ আবার তাকে নতুন আঙ্গিকে লিখতে হতো। এ লজ্জা থেকে বেঁচে গেছেন তিনি গতায়ু হয়ে। নইলে মানুষ, ঊনমানুষ ও অতিমানুষের যন্ত্রণায় হয়তো নিজেই নিজের সংহারক হতেন। এদের কা-কারখানা দেখে তিনি হয়তো ভিরমি খেয়ে পড়তেন নিঃসন্দেহে। লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ঊসধরষ-shah.b.islam@gmail.com




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com