মধ্যরাতে উড়ালসড়কে মোটরসাইকেল থামালেন নারী
রাজধানীর আরামবাগের একটি ছাপাখানায় চাকরি করেন শামীম খান। কাজ শেষ করতে প্রায়ই তাঁর দেরি হয়। ৯ আগস্ট ছাপাখানা থেকে বের হন রাত সাড়ে ১১টার দিকে। পল্লবীর বাসায় যেতে মোটরসাইকেল নিয়ে শান্তিনগর থেকে উড়ালসড়কে ওঠেন তিনি। তবে জ্বালানি তেল শেষ হয়ে যাওয়ায় মোটরসাইকেলটি মগবাজার মোড় পার হওয়ার পরপরই বন্ধ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে তিনি মোটরসাইকেল ঠেলে এগোতে থাকেন। হঠাৎ এক নারী এসে বলেন, ‘ভাইয়া, একপাশ দিয়ে চলেন। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’ এরপর সেখানে আসেন দুই ব্যক্তি। তাঁরা এসেই শামীমকে চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে তাঁর মুঠোফোন কেড়ে নেন। এমন সময় বিপরীত দিক থেকে দুটি মোটরসাইকেল আসে। মোটরসাইকেল দুটির চার আরোহীকে শামীমকে কোপাতে দেখেন। তাঁরা দ্রুত মোটরসাইকেল থামিয়ে শামীমের কাছে আসতে থাকেন। টের পেয়ে দুই ছিনতাইকারী দ্রুত পালিয়ে যান। তবে শামীম রক্তাক্ত অবস্থায়ও ওই নারীকে ধরে রাখেন।
এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে মীম নামের ওই নারীসহ চারজনকে ১০ আগস্ট গ্রেপ্তার করেছে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে মীম ও শেফালী ঢাকার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সেই জবানবন্দিতে এই চক্র কীভাবে ছিনতাই করে, কোথায় তাদের আস্তানা, সেসব বিস্তারিত উঠে এসেছে।
সেদিন মধ্যরাতে কী ঘটেছিল: ৯ আগস্ট দিনভরই বৃষ্টি হয় ঢাকায়। শামীম কাজ শেষে রাত সাড়ে ১১টায় মোটরসাইকেল নিয়ে পল্লবীর বাসার উদ্দেশে রওয়ানা হন। উড়ালসড়কের মৌচাক অংশে আসার পর একবার মোটরসাইকেল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর কয়েকবারের চেষ্টায় সেটি চালু করে তিনি মগবাজার পর্যন্ত আসেন। তখন আবার মোটরসাইকেল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আর সেটি চালু হচ্ছিল না। উপায়ন্তর না দেখে মোটরসাইকেল ঠেলে হোটেল সোনারগাঁও ক্রসিংয়ের দিকে এগোতে থাকেন। উড়ালসড়কের একপাশে বৃষ্টির পানি জমে থাকায় তিনি মাঝখান দিয়ে আসছিলেন। এমন সময় উড়ালসড়কে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে থাকা মীম নামের ওই নারী শামীমকে একপাশ দিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তাঁর কথামতো শামীমও উড়ালসড়কের একপাশে চলে আসেন। তখন উড়ালসড়কের নিচের ‘আস্তানা’ থেকে মুহূর্তের মধ্যে দুই যুবক চাপাতি হাতে শামীমের সামনে হাজির হন। কিছু বোঝার আগেই শামীমকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন তাঁরা। শামীম হাত দিয়ে কোপ ঠেকানোর চেষ্টা করেন। তখন মোটরসাইকেলটি সড়কে পড়ে যায়।
শামীম বলেন, ‘আমাকে ছিনতাইকারীদের কোপানোর দৃশ্য দেখে বিপরীত পাশে দুটি মোটরসাইকেল আরোহী থামেন। তাঁরা মোটরসাইকেল রেখে আমার কাছে আসতে থাকেন। তা দেখে দুই যুবক যেন হাওয়া হয়ে যায়। আমি তখন ওই নারীকে আটকে রাখি। পরে ওই চারজন এসে নারীকে ওড়না দিয়ে আমার মোটরসাইকেলের সঙ্গে বেঁধে ফেলেন। এরপর ৯৯৯-এ (জাতীয় জরুরি সেবা) ফোন দিলে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে আমাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।’
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ওই নারী জানান, তাঁর নাম মীম। কীভাবে তিনি ছিনতাইকারী দলের হয়ে কাজ করেন, কারা এই ছিনতাইকারী দলের নেতা, সেটি পুলিশকে জানান। পরে ছিনতাইকারী চক্রের দলনেতা আকবরের আস্তানায় অভিযান চালিয়ে চাপাতি, মদের বোতল উদ্ধার করা হয়। আকবর দিনে কারওয়ান বাজারে মাছ কাটেন। রাতে ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ে নেতৃত্ব দেন।
আগে থেকে উড়ালসড়কে থাকা মীম বা শেফালী নানা কৌশলে কাউকে দাঁড় করাতে পারলে ‘সংকেত’ দিত। সঙ্গে সঙ্গে আস্তানা থেকে রশি বেয়ে আকবরসহ অন্যরা উড়ালসড়কে উঠত। তাদের হাতে থাকত চাপাতি।
উড়ালসড়কের পিলারের ওপর ‘আস্তানা’: হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ মো. আওলাদ হোসেন বলেন, ‘মীমের দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে আমরা মগবাজার উড়াল সড়কের নিচে পিলারের ওপর ছিনতাইকারীদের একটি আস্তানার খোঁজ পাই। সেখানে আমাদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিই।
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের দেখে দলনেতা আকবর পিলারের ওপরের আস্তানা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তবে হাত-পায়ে আঘাত পাওয়ায় তিনি পালাতে পারেননি।’
পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, মীম ও আকবরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারেন, দীর্ঘদিন ধরে আকবর মগবাজার উড়ালসড়ক, কারওয়ানবাজারসহ আশপাশের এলাকায় ছিনতাইসহ নানা অপরাধ করে আসছিলেন। মীম, শেফালী ও রবিউল হোসেনসহ আরও কয়েকজন তাঁর সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ছিনতাইয়ের পর উড়ালসড়কের পিলারের ওপরে তাঁরা অবস্থান করতেন। সেখানে অনৈতিক কাজ ও মাদক সেবন করতেন।
আস্তানায় আসা–যাওয়ার বিষয়ে ওসি শাহ মো. আওলাদ হোসেন বলেন, নিচ থেকে তাঁরা (ছিনতাই চক্রের সদস্যরা) কাঠের তৈরি একটি মই বেয়ে সেখানে উঠত। আর সেখান থেকে উড়ালসড়কে ওঠার জন্য ব্যবহার করত কম্বল দিয়ে বানানো একটি রশি। উড়ালসড়কের রেলিংয়ে ওই রশির এক প্রান্ত বাঁধা থাকত। আগে থেকে উড়ালসড়কে থাকা মীম বা শেফালী নানা কৌশলে কাউকে দাঁড় করাতে পারলে ‘সংকেত’ দিত। সঙ্গে সঙ্গে আস্তানা থেকে রশি বেয়ে আকবরসহ অন্যরা উড়ালসড়কে উঠত। তাঁদের হাতে থাকত চাপাতি।
স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে পল্লবীতে ভাড়া থাকেন শামীম। ঘটনার পর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে পর দিন ১০ আগস্ট বিকেলে বাসায় ফেরেন। এখনো তিনি পুরোপুরি সুস্থ হননি। শামীমের স্ত্রী রীমা খাতুন গতকাল সোমবার রাতে বলেন, সাধারণত কাজ শেষে রাত ১২টার মধ্যেই তাঁর স্বামী ঘরে ফেরেন। কিন্তু সেদিন ১২টার পরও না ফেরায় তিনি বারবার স্বামীর মুঠোফোনে কল দেন, কিন্তু বন্ধ পান। এতে করে দুই সন্তানকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পুরো রাত কাটান। পরিচিত অনেককেই ফোন দিয়ে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে কেউই কিছু বলতে পারেননি। পরে সকালে খবর পেয়ে তিনি হাসপাতাল যান। ছিনতাইয়ের কাজে আকবরের নেতৃত্বে চক্রটি চাপাতি ব্যবহার করত উল্লেখ করে হাতিরঝিল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রুহুল আমিন গতকাল রাতে বলেন, এই ছিনতাই চক্রের প্রধান আকবরসহ অন্যরা ভাসমান ব্যক্তি। চক্রের আরও কয়েকজনের নাম জানতে পেরেছি। তাঁদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে। উৎস: – প্রথম আলোক