রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:২৩ অপরাহ্ন

জ্বিন তাড়ানোর ঝাড়-ফুঁকের নামে আফ্রিকায় নারীদের যৌন নির্যাতন

হানান রাজেক,বিবিসি নিউজ আরবী
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৩

ঝাড়ফুঁকের পেশার আড়ালে নারীদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা জানার জন্য বিবিসি ছদ্মবেশী সাংবাদিক দিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে। জ্বিন তাড়ানোর নামে ঝাড়-ফুঁক করিয়ে থাকে এমন কিছু পুরুষ আফ্রিকার কিছু দেশে আধ্যাত্মিক কবিরাজ” সেজে নারীদের ওপর যৌন অত্যাচার ও শোষণ চালাচ্ছে। বিবিসির আরবী বিভাগের এক তদন্তে উঠে এসেছে এই গোপন জগতের বিস্তারিত। আরব মুসলিম বিশ্বের কিছু দেশে “আধ্যাত্মিক চিকিৎসা” নামে পরিচিত একধরনের ঝাড়-ফুঁক বেশ জনপ্রিয়। এই ‘কবিরাজ’দের কাছে যারা যান তাদের বেশির ভাগই নারী। এই নারীরা বিশ্বাস করেন যে এধরনের ঝাড়-ফুঁকের মাধ্যমে খারাপ জ্বিনের অশুভ প্রভাব দূর করে নানা সমস্যার সমাধান, রোগের চিকিৎসা ইত্যাদি করা সম্ভব। আফ্রিকার দুটি দেশ মরক্কো ও সুদানে এধরনের ঝাড়-ফুঁক বিশেষভাবে জনপ্রিয়। এ দুটি দেশে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ৮৫ জন নারীর জবানবন্দী সংগ্রহ করেছে বিবিসি। এই নারীরা মোট ৬৫ জন “কবিরাজের” নাম উল্লেখ করেছেন, এবং তাদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে ধর্ষণ পর্যন্ত নানা অভিযোগ এনেছেন। আমরা কয়েক মাস ধরে কথা বলেছি বিভিন্ন এনজিও, আদালত, আইনজীবী এবং অন্য নারীদের সাথে – যৌন অত্যাচারের গল্পগুলো সংগ্রহ করেছি, যাচাই করেছি। এ ছাড়া আমাদের একজন ছদ্মবেশী রিপোর্টার তদন্তের স্বার্থে রোগী সেজে এরকম একজন কবিরাজের চিকিৎসা নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তার দেহে অশোভনভাবে হাত দেয়া হলে তিনি ওই স্থান ছেড়ে পালিয়ে যান।
কয়েক বছর আগের কথা। ক্যাসাব্লাংকার কাছে একটি ছোট শহরে এরকম একজন ঝাড়-ফুঁক বিশারদের কাছে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন দালাল নামে একজন নারী (এটি তার আসল নাম নয়)। তার বয়স ছিল ২০-এর কোঠায় এবং তিনি বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন। তিনি বলছেন, সেই কবিরাজ তাকে জানান যে তার ওপর একজন “প্রেমিক জ্বিনের আছর পড়েছে” এবং এটাই তার বিষণ্ণতার কারণ।
একদিনের চিকিৎসার সময় – যখন তারা ছাড়া আর কেউই উপস্থিত ছিল না – তখন এই কবিরাজ তাকে একটি সুগন্ধি শুঁকতে দিলেন। তিনি বলেছিলেন – এটা কস্তুরী বা মৃগনাভি, কিন্তু এখন দালাল বিশ্বাস করেন যে আসলে তা ছিল কোন মাদকদ্রব্য – কারণ শোঁকার পরই তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিলেন। এর আগে দালালের কোন রকম যৌন অভিজ্ঞতা ছিল না। তিনি বলছেন, সেই দিন জ্ঞান ফিরে পাবার পর তিনি দেখতে পান তার অন্তর্বাস খুলে ফেলা হয়েছে, এবং বুঝতে পারলেন যে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তখন তিনি সেই রাকি (আধ্যাত্মিক চিকিৎসক)-র উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে লাগলেন, এবং জানতে চাইলেন যে তাকে কী করা হয়েছে। “আমি বললাম, তোমার লজ্জা হওয়া উচিৎ, কেন তুমি আমার সাথে এমন করলে? সে বললো, “আমি এটা করেছি যাতে জ্বিন তোমার দেহ ছেড়ে চলে যায়।” দালাল বলছেন, এ ঘটনা তাকে গভীরভাবে লজ্জিত করে এবং তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে এ জন্য সবাই তাকেই দোষ দেবে। এ কারণে তিনি ঘটনাটির কথা কাউকে বলেননি। এর কয়েক সপ্তাহ পর তিনি আবিষ্কার করলেন যে তিনি গর্ভবতী হয়ে পড়েছেন। এতে তিনি আতংকিত হয়ে পড়লেন, এবং আত্মহত্যা করার কথাও ভেবেছিলেন। তিনি যখন ওই কবিরাজকে তার গর্ভাবস্থার কথা বললেন, তখন তার জবাব ছিল, সেই জ্বিন নিশ্চয়ই তাকে গর্ভবতী করে দিয়ে গেছে।
দালাল বলছেন, এ অভিজ্ঞতার ফলে তিনি মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন যে তার সন্তানের জন্ম হবার পর তিনি শিশুটির দিকে তাকাতে, তাকে ধরতে বা তাকে একটি নাম দিতেও অস্বীকার করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ওই শিশুটিকে অন্য কাউকে দত্তক নেবার জন্য দিয়ে দেন। তার কথা, যদি তার পরিবার এ ঘটনার কথা জানতে পারে তাহলে তারা দালালকে মেরে ফেলবে।
জ্বিনের ‘প্রতিশোধের’ ভয়: আমরা যে নারীদের সাথে কথা বলেছি তার মধ্যে মাত্র অল্প কয়েকজন তাদের পরিবারকে বলেছেন – তাদের ওপর চালানো অত্যাচারের কথা। পুলিশকে বলার তো প্রশ্নই আসে না। তারা বলেছেন, তাদের ভয় হলো যদি এই নির্যাতনের কথা তারা কাউকে বলেন তাহলে তাদেরকেই এ জন্য দোষ দেয়া হবে।
অন্য কয়েকজন বলেছেন, তারা উদ্বিগ্ন ছিলেন যে এসব ঘটনার কথা বলে দিলে জ্বিন হয়তো তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারে। সাওসান নামে সুদানের একজন নারী বলেছেন, তার স্বামী অন্য এক নারীকে বিয়ে করেন এবং তার সাথে থাকার জন্য পারিবারিক বাড়ি ছেড়ে যান। তখন নিজেকে পরিত্যক্ত ও নিঃস্ব ভেবে সাওসান একজন কবিরাজের সাহায্য চান। তিনি বলেন, তারা আশা ছিল যে কবিরাজ তার স্বামীকে কিছু একটা ওষুধ দেবে – যার ফলে তিনি সাওসানের সাথে ভালো আচরণ করবেন।
কিন্তু তাকে যে চিকিৎসার পরামর্শ দেয়া হলো – তার জন্য তিনি তৈরি ছিলেন না।
কবিরাজ বললেন, তিনি তার সাথে যৌনমিলন করবেন এবং তাদের মিলিত দেহের রস দিয়ে একটি ওষুধ তৈরি করবেন – যা আমার স্বামীকে খাওয়াতে হবে।”
সাওসান বলছেন, “পরামর্শ থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যে তার মধ্যে কোন ভয়ডর ছিল না।
তার আস্থা ছিল যে আমি পুলিশ, আদালত বা এমনকি আমার স্বামীর কাছেও এই ব্যক্তির কথা বলে দেবো না।”
সাওসান বলেন, তিনি তৎক্ষণাৎ ওই স্থান ত্যাগ করেন এবং আর কখনো সেখানে ফিরে যাননি। সেই কবিরাজের আচরণের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও দায়ের করেননি।
সুদানে আমরা যে ৫০ জন নারীর সাথে কথা বলেছি তাদের মধ্যে তিনজনই বিশেষ একজন আধ্যাত্মিক নেতার কথা বেেলছন। তার নাম শেখ ইব্রাহিম।
একজন নারী – যার নাম আমরা প্রকাশ করছি না – বলেছেন, তাকে শেখ ইব্রাহিম যৌন মিলন করতে বাধ্য করেছেন।
আলাফ নামে আরেকজন নারী বলেনে, শেখ ইব্রাহিম তার সাথে যৌন মিলন করতে চাইলে তিনি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন।
তিনি বলেন, তার নিজেকে ক্ষমতাহীন মনে হয়েছিল।
শেখরা যে এসব বলে বা করে এটাই অনেক লোক মানে না। তারা এসব কথা বিশ্বাস করে না। আমি সাক্ষী কোথায় পাবো? ওই ঘরে আমি যে তার সামনে ছিলাম তা তো আর কেউ দেখেনি।”
ফলে এ ব্যাপারে প্রমাণ সংগ্রহের জন্য আমাদের দলের সাথে কর্মরত একজন ছদ্মবেশী সাংবাদিক শেখ ইব্রাহিমের সাথে সাক্ষাৎ করতে রাজী হলেন। আমরা এই রিপোর্টারের নাম দিয়েছি রীম। তিনি সন্তান হচ্ছে না এমন এক নারী” হিসেবে পরিচয় দিয়ে শেখ ইব্রাহিমের কাছে গেলেন।
শেখ ইব্রাহিম বললেন, তিনি তার জন্য প্রার্থনা করবেন, এবং মাহায়া নামে এক বোতল উপশমকারী পানি তৈরি করে দিলেন – যা তাকে বাড়িতে গিয়ে খেতে হবে।

রীম বলছেন, এর পর তার খুব কাছ ঘেঁষে বসলেন শেখ ইব্রাহিম এবং রীমের পেটের ওপর হাত রাখলেন। রীম যখন তার হাত সরাতে বললেন তখন তিনি তা না করে কাপড়ের ওপর দিয়ে হাতটাকে আরো নিচে যৌনাঙ্গের ওপর নিয়ে গেলেন।
রীম তখন দৌড়ে ঘর থেকে পালিয়ে গেলেন।
সে আমাকে সত্যি ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। তার চেহারাতে এমন একটা ভাব ছিল যা উদ্বেগজনক” – পরে আমাদের বলছিলেন তিনি।
রীমের কথায়, শেখ ইব্রাহিমের আচরণে বোঝা যাচ্ছিল যে এ ধরনের কাজ তার জন্য এটাই প্রথম নয়।
বিবিসি রীমের ব্যাপারে শেখ ইব্রাহিমেকে প্রশ্ন করেছে। তখন তিনি তার কাছে সাহায্য চাইতে আসা নারীদের ওপর যৌন হয়রানি বা আক্রমণ চালানোর কথা অস্বীকার করেন, এবং হঠাৎ করেই সাক্ষাৎকার শেষ করে দেন।
শেখা ফাতিমার নারী-কেন্দ্র: যে নারীরা এরকম ঝুঁকি ছাড়া আধ্যাত্মিক চিকিৎসা নিতে চান তাদের জন্য একটি বিকল্প পথ বাতলে দিচ্ছেন শেখা ফাতিমা। তিনি থাকেন খার্তুমের কাছে এবং তিনি এমন একটি চিকিৎসা কেন্দ্র খুলেছেন যাতে শুরু নারীরাই আছেন। গত ৩০ বছর ধরে এটি একটি বিরল কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে যেখানে নারীদের আধ্যাত্মিক সুশ্রূষা দিয়ে থাকেন নারীরাই। বিবিসিকে এই কেন্দ্রে প্রবেশের বিরল সুযোগ দেয়া হয়। এখানে নারীরা তাদের পারিপার্শ্বিকতার ব্যাপারে সম্পূর্ণ অসচেতন হয়ে পড়তে দেখেছি। শেখা ফাতিমা বলছেন, অন্য কবিরাজরা মেয়েদের এ অবস্থার সুযোগ নিতে পারে এমন সম্ভাবনা থাকে।
অনেক নারী আমাদের বলেছেন, তারা বিশ্বাস কিিরছলেন যে শেখ তাদের দেহ স্পর্শ করে শয়তানকে তাদের ভেতর থেকে বের করে নিয়ে আসছেন। তারা মনে করতেন যে এটা চিকিৎসারই অংশ” – তিনি বলছেন, “এই মেয়েদের কাছ থেকে এসব শুনলে হতবাক হতে হয়।” আমরা আমাদের এ সব সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে মরক্কো ও সুদানের রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়েছি। সুদানের ইসলামিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরিবার ও সমাজ বিভাগের প্রধান ড. আলা আবু জেইদ প্রথমে এটা বিশ্বাস করতে চাননি যে এত বেশীসংখ্যক নারী আমাদের কাছে নির্যাতনের অভিজ্ঞতা বলেছেন। তবে তিনি স্বীকার করেন আধ্যাত্মিক চিকিৎসা বিষয়ে আইনকানুন না থাকায় বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি হচ্ছে। তার মতে, “যেসব লোকের কোন কাজ নেই তারাই এ ভূমিকাকে পেশা হিসেবে ব্যবহার করছে।” তিনি বলেন অতীতে তিনি এসব কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রণে আনার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখেছেন, কিন্তু দেশটির বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য এটি এখন অগ্রাধিকারের মধ্যে নেই। মরক্কোর ইসলামিক অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রী আহমেদ তৌফিক বলেন, তার ধারণা এ ব্যাপারে আলাদা করে আইন করার দরকার নেই। “এসব বিষয়ে আইনগতভাবে হস্তক্ষেপ করা কঠিন। সমাধান হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষা ও তার প্রচার” – বলেন তিনি।
আমাদের সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও মরক্কো ও সুদানের কর্তৃপক্ষ এব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে নারাজ। সে কারণে দায়িত্ব এসে পড়ছে নারীদের ওপরই – যাতে তারা এই ঝাড়ফুঁকের পেশার পেছনে লুকিয়ে থাকা লোকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com