বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০ আগস্ট দিনটি বিশ্ব মশা দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। নোবেল বিজয়ী ব্রিটিশ চিকিৎসক স্যার রোনাল্ড রস ১৮৯৭ সালের ২০ আগস্ট অ্যানোফেলিস গোত্রের মশার অন্ত্রে ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণুর অস্তিত্ব পান এবং প্রমাণ করেন যে অ্যানোফেলিস গোত্রের মশা ম্যালেরিয়া রোগের বাহক। তার এ কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাকে স্মরণীয় করতে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০ আগস্ট দিনটি বিশ্ব মশা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বিশ্ব মশা দিবসের আখ্যান, গুরুত্ব ও প্রতিপাদ্য বিষয় মূলত মশাবাহিত রোগ প্রাদুর্ভাবের বিস্তার রোধ, মশার বংশবৃদ্ধির প্রতিবন্ধকতা ও মশাবাহিত রোগ প্রশমনে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে গৃহীত হয়। অ্যানোফেলিস গোত্রের মশাবাহিত ম্যালেরিয়া রোগ আমাদের দেশে স্বাধীনতা-উত্তরকালে অত্যন্ত মারাত্মক ছিল। সরকারিভাবে ব্যাপকভিত্তিক এবং অর্থপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণের ফলে অ্যানোফেলিসের প্রাদুর্ভাব এবং ম্যালেরিয়া রোগ সংক্রমণ দুটোই যথার্থভাবে হ্রাস পেয়েছে। মশা নিধনে ওই সময় ডিডিটি (ডাই ক্লোরো ডাই ফিনাইল ট্রাইক্লোরো ইথেন) ব্যবহার করা হতো। অর্গানো-ক্লোরিন শ্রেণীর এ কীটনাশক মশা নিধনে অত্যন্ত কার্যকরী হলেও পরিবেশ এবং প্রতিবেশ এর উপাদানগুলোর জন্য অত্যন্ত বিষাক্ত এবং হুমকিস্বরূপ হওয়ায় বিশ্বব্যাপী এর ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়েছে।
বাংলাদেশে অ্যানোফেলিস গোত্রের ৩৫ প্রজাতির মশার অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ম্যালেরিয়া রোগ সংক্রমণ ঝুঁকি সৃষ্টি করেনি। কিন্তু জনমনে উদ্বেগ, আতঙ্ক এবং জীবনহানির কারণ সৃষ্টি করেছে এডিস এজিপ্টি প্রজাতির মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগ। এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ঢাকা শহরে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। আমাদের দেশে ১৯৬৪ সালে সর্বপ্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। তখন থেকেই এ রোগের সংক্রমণ কমবেশি প্রতি বছর হয়ে থাকে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে এ রোগের প্রাদুর্ভাব অতিমাত্রায় বেড়ে চলেছে। ঢাকা শহরের হাসপাতালগুলোয় রোগীর তিল ধারণের ঠাঁই নেই। চিকিৎসক ও সেবক-সেবিকারা নিরন্তর চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সংবাদে প্রতিদিনই মৃত্যুসংখ্যা যুক্ত হচ্ছে। বিগত বছরগুলোর মধ্যে ২০১৯ সালে সংক্রমণ ছিল সর্বাধিক। ওই বছর মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন এবং মোট ১৭৯ জন মৃত্যুবরণ করেছিল। এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে গত বছর মোট ২৮১ জনের মৃত্যু হয়। চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৮৯ হাজার ৮৭৫ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এবং ৪২৬ জন মৃত্যুবরণ করেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী আরো জানা যায় যে ২০০০ সাল থেকে চলতি বছরের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৬১৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে এবং ১ হাজার ১৯৪ জন মৃত্যুবরণ করেছে। এ বছর ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীর ৬৩ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৭ শতাংশ নারী। তবে নারী মৃত্যুহার ৫৭ শতাংশ ও পুরুষ মৃত্যুহার ৪৩ শতাংশ।
ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা ডিম, লার্ভা, পিউপা ও পূর্ণাঙ্গ দশাÍএ চার ধাপে তার জীবনচক্র সম্পন্ন করে। পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী মশা পানির উপরিভাগে ডিম পাড়ে। পানিতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে লার্ভার জন্ম হয়। লার্ভাগুলো শৈবাল ও জৈব পদার্থ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং চারদিনের মধ্যে পিউপা দশায় উপনীত হয়। পিউপাগুলো পানিতে থাকে তবে কোনো খাদ্য গ্রহণ করে না। দুইদিন পর পিউপা পূর্ণাঙ্গ মশায় পরিণত হয় এবং পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় দুই থেকে চার সপ্তাহ বেঁচে থাকে। পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী মশা মানুষের শরীর থেকে তার অনুবিন্ধন ও শোষণোপযোগী মুখোপাঙ্গ দিয়ে রক্ত শোষণ করে। পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী মশা ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী রোগীর শরীর থেকে রক্ত শোষণের সঙ্গে ভাইরাস জীবাণু শোষণ করে এবং বাহক হিসেবে ধারণ করে। মশার দেহে ভাইরাস জীবাণু আট থেকে ১২ দিনের মধ্যে তার উন্মেষ পর্ব (ইনকিউবেশন পিরিয়ড) সম্পন্ন করে। এরপর বাহক মশা সুস্থ মানুষের দেহ থেকে রক্ত শোষণ করার সময় তার লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসরণের মাধ্যমে সুস্থ মানুষের দেহে ডেঙ্গু ভাইরাস সন্নিবেশ করে থাকে। এডিস মশা ডেঙ্গু ছাড়াও চিকুনগুনিয়া, জিকা, মায়ারো ও হলুদ জ্বরের জীবাণুর বাহক হিসেবে পরিগণিত।
ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার লার্ভা দশা পানিতে অতিক্রম হয় এবং পানি ব্যতীত এ দশা অতিক্রম করতে পারে না। সুতরাং যত্রতত্র পানি জমে থাকলে স্বাভাবিকভাবে মশার বংশবৃদ্ধি এবং রোগ সংক্রমণের ব্যাপকতা ঘটে। জলবায়ু পরিবর্তন, নির্মাণাধীন স্থাপনায় জলাবদ্ধতা, বসতবাড়ির আঙিনায় জলাবদ্ধ পানি নিষ্কাশনে নগরবাসীর অমনোযোগিতা ও অসতর্কতা এবং নিরবচ্ছিন্ন সমন্বিত দমন ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এডিস মশার বংশবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করেছে। বাংলাদেশে সাধারণত আগস্ট-সেপ্টেম্বরে এডিস মশার প্রাদুর্ভাব এবং ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ বেশি হয়। তবে এ বছর জুন-জুলাই থেকেই সংক্রমণ মাত্রাতিরিক্ত। মে-জুনের বৃষ্টিপাত এডিস মশার বংশবৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করায় মশার প্রাদুর্ভাব আগাম বৃদ্ধি পেয়েছে। মশার আগাম ও অতিরিক্ত বংশবৃদ্ধি এ বছর অগ্রিম ডেঙ্গু সংক্রমণের মূল কারণ। ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকা সিটি করপোরেশন মশার লার্ভা এবং পূর্ণাঙ্গ মশা দমনে দীর্ঘদিন ধরে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করে আসছে এবং সম্প্রতি ব্যাসিলাস থুরিনজিয়েনসিস বা বিটি ব্যাকটেরিয়া উদ্গত অণুজীবীয় কীটনাশকের ব্যবহার শুরু করেছে। সেই সঙ্গে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছে। এ উদ্যোগ দুটি অত্যন্ত প্রশংসনীয়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় দীর্ঘদিন রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করার পর অণুজীবীয় কীটনাশক কতটা কার্যকরী হবে? কারণ অণুজীবীয় কীটনাশক রাসায়নিক কীটনাশকের চেয়ে কম বিষাক্ত এবং কার্যকারিতা মন্থর। তাছাড়া প্রখর সূর্যালোকে এর কার্যকারিতার অধঃপতন ঘটে। বাংলাদেশে বিদ্যমান এডিস মশার বৈশিষ্ট্য এবং ধরন থেকে এরই মধ্যে বিভিন্ন মহলে উচ্চারিত হচ্ছে যে এ মশার বায়োটাইপ উদ্ভব হয়েছে। উদ্ভাবিত বায়োটাইপ সচরাচর ব্যবহৃত রাসায়নিক কীটনাশকের প্রতি প্রতিরোধী। যতদূর জানা যায়, বিগত বছরগুলোয় মশা নিয়ন্ত্রণে অতিমাত্রায় সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে। এ একক গ্রুপের রাসায়নিক কীটনাশক দীর্ঘদিন ব্যবহার করার ফলে সংশ্লিষ্ট কীটনাশকের প্রতি প্রতিরোধী হওয়া স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ ক্রপ প্রটেকশন অ্যাসোসিয়েশন ২০২১ সালে ‘বাংলাদেশে নিবন্ধিত কৃষি ও জনস্বাস্থ্যে ব্যবহার্য বালাইনাশকের তালিকা’ নামক একটি বই প্রকাশ করে। এ বই থেকে জানা যায় যে বালাইনাশক কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির ৮১তম সভা কর্তৃক অনুমোদিত জনস্বাস্থ্যে ব্যবহার্য বালাইনাশকের ফর্মুলেশন ও ব্র্যান্ডের সংখ্যা যথাক্রমে ৩৬৩ ও ৫৪৪৭। গত ১৬ জুলাই বালাইনাশক কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির ৮৬তম সভায় মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য তিন শতাধিক ব্র্যান্ডের রাসায়নিক কীটনাশকের অনুমোদন দেয়া হয়। এ তথ্য থেকে অনুমিত হয় যে দেশে কীটনাশকের বাজারজাত ও বিপণন খুবই সহজসাধ্য। কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণে সফলতা অপ্রতুল। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে মশা দমনের জৈবিক ব্যবস্থা হিসেবে নগরের নালা-নর্দমায় গাপ্পি মাছ ছাড়া হয়। এ মাছ মশার লার্ভার অন্যতম পরভোজী। স্ত্রী মাছগুলো পুরুষ মাছের তুলনায় অধিক সংখ্যায় লার্ভা ভক্ষণ করে থাকে। ঢাকা মহানগরে মশা নিয়ন্ত্রণের সমন্বিত ব্যবস্থাপনার অন্যতম উপাদান এ জৈবিক ব্যবস্থার এখন প্রয়োগ নেই বললেই চলে।
এডিস মশার দুটি প্রজাতি এডিস এজিপ্টি এবং এডিস এলবোপিকটাস ডেঙ্গু রোগের প্রধান বাহক। এদের মধ্যে ঢাকা শহরে প্রথমটির প্রাদুর্ভাব ঘটে। মানুষের জীবনহানিকর ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন এডিস মশা দমন। আর এজন্য অবলম্বন করতে হবে সমন্বিত মশা দমন ব্যবস্থাপনা। সমন্বিত মশা দমন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে যুক্ত করতে হবে জৈবিক ব্যবস্থা হিসেবে নগরের নালা-নর্দমায় গাপ্পি মাছ ছাড়করণ, বিটি ব্যাকটেরিয়া উদ্গত অণুজীবীয় কীটনাশক ব্যবহার, মশার লার্ভা ও পূর্ণাঙ্গ দশা নিধনের জন্য পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের রাসায়নিক কীটনাশক নিয়মিত কর্মসূচি হিসেবে প্রয়োগ। নাগরিক সচেতনতা আন্দোলন গরে তুলতে হবে। দেশের ডেঙ্গুর এ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে লার্ভা ও পূর্ণাঙ্গ মশা নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে এবং নিয়ন্ত্রণের ধারা অক্টোবর পর্যন্ত অবিরত চালিয়ে যেতে হবে। বাসাবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, অফিস-আদালত, ধর্মীয় উপাসনালয়, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন ইত্যাদি জনগুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ বন্ধের জন্য প্রচারণা চালানো, বাসাবাড়ির আশপাশে জমে থাকা পানি ফেলে দেয়া এবং এসব কার্যক্রম চলমান রাখতে হবে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিষয়ের গবেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কীটতত্ত্ব বিষয়ের গবেষকদের নিয়ে সিটি করপোরেশনে একটি পরামর্শ এবং গবেষণা সেল গঠন করা অতীব জরুরি। সেলে সংশ্লিষ্ট গবেষকদের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত মশার নমুনা সংগ্রহ এবং গবেষণাগারে সংগৃহীত মশার ওপর কীটনাশকের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে সর্বাধিক কার্যকরী কীটনাশক যথাযথ মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। কীটনাশক প্রয়োগ কার্যক্রম একযোগে বিস্তীর্ণ এলাকায় হতে হবে। মশা ও মশাবাহিত রোগ দমনসংক্রান্ত গবেষণা কার্যক্রম চলমান রাখার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে স্থানীয় সরকার বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা অতীব প্রয়োজন। লেখক:ড. মো. রুহুল আমীন: অধ্যাপক, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর