মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী ২০২৫, ০১:০৪ অপরাহ্ন

জাতীয় কবির কাজী নজরুল ইসলামের স্বদেশপ্রেম

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় রবিবার, ২৭ আগস্ট, ২০২৩

গতকাল রোববার ২৭ আগস্ট, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে জাতি তাঁকে শ্রদ্ধা ও ভালাবাসায় স্মরণ করলো ।জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা কাব্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর । বহুমুখী প্রতিভার গুণেই তার সাহিত্য কর্ম বাংলা কাব্য অঙ্গন থেকে বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনে প্রবেশ করেছে। তাঁর কাব্যের ভুবন নানা রঙে রঞ্জিত, নানাভাবে ব্যঞ্জিত। একাধিক ভাব বা ভাবনা তাঁর কাব্য অঙ্গনের পরিধিকে করেছে বহু বিস্তৃত। তাঁর কাব্য ভাবনায় একটি অন্যতম প্রধান বিষয় স্বদেশপ্রেম। কবি এমন এক সময়ে আবির্ভূত হন, যখন দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ছিলেন আন্দোলনরত। এ দেশবাসীর চেতনায় যে স্বদেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, স্বাধীনতা ইত্যাদি ভাব ছিল জাগ্রত, সেসব ভাবই যেন কাজী নজরুলের কবিতায় ভাষা পেয়েছে অর্থাৎ তাঁর কাব্যে ব্যক্ত হয়েছে স্বদেশপ্রেম।
‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘সাম্যবাদী, ‘সর্বহারা’, ‘ফণিমনসা’, ‘জিঞ্জীর’, ‘সন্ধ্যা’, ‘প্রলয়শিখা’ ইত্যাদি কাব্য তাঁর দেশপ্রেমের উজ্জ্বল উদাহরণ। যে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির জন্য কাজী নজরুল ইসলামের কবি-প্রতিভার পরিচিতি ত্বরিত গতিতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিলÍসেই কবিতা রচনার মূলেও কবির স্বদেশপ্রেম ছিল অত্যন্ত সক্রিয়। কবির কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিলÍবল বীর/বল উন্নত মম শির!/শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির। তিনি ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় স্পষ্টভাবেই অধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করতে চেয়েছেন। এ জন্য তিনি বলেছেন, আমি উপাড়ি ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নবসৃষ্টির মহানন্দে। শুধু তাই নয়, তিনি অত্যাচারিত-নির্যাতিত-বঞ্চিত মানুষের জন্য বিদ্রোহী হয়েছেন। এসব মানুষের প্রতি ভালোবাসা মূলত তাঁর স্বদেশপ্রেমেরই নামান্তর। এ জন্য তিনি উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছেনÍযবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না/অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রনিবে নাÍ/বিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেইদিন হব শান্ত।
কবি নজরুল ইসলামের কাব্যে যে স্বদেশপ্রেমের বাণী উচ্চারিত, তা যৌবনের আবেগে উন্মথিত, পৌরুষদীপ্ত এবং জ্বালাময়ী। তাঁর স্বদেশপ্রেমের কবিতায় যে জ্বালাময়ী বিষবাষ্প ছিল এবং যে অগ্নিবীণার সুর ধ্বনিত হয়েছিল, তারই জন্য তাঁকে ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়ে জেল খাটতে হয়েছে। যে ‘বিষের বাঁশী’ তিনি বাজিয়েছেন, যে ‘ভাঙার গান’ তিনি গেয়েছেনÍতার মূলে ছিল স্বদেশপ্রেম।
‘ভাঙার গান’ কবিতাতেও স্বদেশপ্রেমের জন্য এমন বিপ্লবাত্মক ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে। কবি বজ্রকণ্ঠে বলেছেনÍকারার ঐ লৌহ কপাট/ভেঙে ফেল কররে লোপাট/রক্ত জমাট/শিকল পুজোর পাষাণ বেদী/ লাথি মার, ভাঙরে তালা যত সব বন্দীশালায়Íআগুন জ্বালা/আগুন জ্বালা। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালী মুসলমানের ভেতর স্বদেশপ্রেম, স্বাধীনতার চেতনা ইত্যাদি জাগ্রত করার জন্য ইসলামী ঐতিহ্য ও বীরত্বপূর্ণ ঘটনার বর্ণনা তাঁর কাব্যে তুলে ধরেছেন। যেমনÍ‘কামাল পাশা’ কবিতায় তুর্কি বীর কামালের বীরত্ব, স্বদেশপ্রেম ও স্বাধীনতার চেতনাকে এ দেশবাসীর মনে-প্রাণে সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্বদেশের জন্য যারা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন তাদের শহীদ বলে আখ্যা দিয়েছেনÍদেশ বাঁচাতে আপ্নারি জান্ শেষ করেছে।/বেশ করেছে!!/শহীদ ওরাই শহীদ!/বীরের মতন প্রাণ দিয়েছে, খুন ওদেরি লোহিত!/শহীদ ওরাই শহীদ। দেশের জন্য যারা প্রাণ দিয়েছে কবি তাদের মৃত্যুঞ্জয়ী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সুতরাং তাদের জন্য তিনি অশ্রুপাত করতে চান না‘মৃত্যু এরা জয় করেছে, কান্না কিসের? মুসলমানদের স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত করার জন্য ‘মোহররম’ কবিতায় বলেছেনÍফিরে এলো আজ সেই মোহররম মাহিনা/ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহিনা/ জাগো ওঠ মুসলিম, হাঁকো হাইদরী হাঁক। শহীদের দিনে সব লালে লাল হয়ে যাক।’ কবি নজরুল ‘রণভেরী’ কবিতায় স্বাধীনতার জন্য বলেছেন মোরা সৈনিক, মোরা শহীদান বীর বাচ্চা,/মরি জালিমের দাঙ্গায়।/মোরা অসিবুকে বরি’ হাসি মুখে মরি’ জয় স্বাধীনতা গাই। মূলত নজরুল কাব্যের অসংখ্য চরণে রয়েছে স্বদেশপ্রেমের অমর বাণী।
স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে কাজী নজরুল ইসলাম সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যে ধ্বংসযজ্ঞের আহ্বান জানিয়েছিলেন, সেই ধ্বংসের পেছনে সুন্দর একটি দেশগড়ার স্বপ্ন ছিল। এ জন্যই তিনি ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় বলেছেন ‘ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন।/আসছে নবীন-জীবন-হারা অসুন্দরে করতে ছেদন!/তাই যে এমন কেশে-বেশে/প্রলয় বয়েও আনছে হেসে/মধুর হেসে!/ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির-সুন্দর!’ ‘জাগো সৈনিক আত্মা’ কবিতায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম দেশের যুব-সম্প্রদায়কে জাগ্রত হতে বলেছেন, পরাধীন ভারতের শৃঙ্খল মুক্তির জন্য যুবকদের ভেতর যে ‘সৈনিক আত্মা’ রয়েছে তাকে জাগ্রত করেছেন।
স্বদেশের প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করাকে তিনি মৃত্যু নয় অমৃতের উৎসব বলে অভিহিত করেছেন। কবি বলেছেন জাগো এ দেশের দুর্বার যত দুরন্ত যৌবন।/আগুনের ফুল-সুরভি এনেছে চৈতালী সমীরণ। সেই সুরভির নেশায় জেগেছে অঙ্গে অঙ্গে তেজ/রক্তের রঙে রাঙায় ভুবন ভৈরব রংরেজ।/জাগো অনিদ্র অভয় মুক্ত মৃত্যঞ্জয়ী প্রাণ,/তোমাদের পদধ্বনি শুনি হোক অভিনব উত্থান/পরাধীন শৃঙ্খলকবলিত পতিত এ ভারতের।/এতো যৌবন রণ-রস-ঘন হাতে লয়ে শমেশর।’
কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। কবিতায় তিনি যেমন মুসলিম সমাজকে স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত করেছেন, তেমনি তিনি হিন্দু সমাজকেও উজ্জীবিত করেছেন। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশকে তিনি দানবরূপে চিহ্নিত করেছেন। দেশকে মুক্ত করার জন্য এই দানবশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ছাড়া উপায় নেই। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘আগমনী’ কবিতায় হিন্দু দেবদেবীর রুদ্ররূপ বিশেষভাবে চিত্রিত করেছেন। মূলত কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন দেশপ্রেমিক, স্বদেশের প্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েই তিনি বিদ্রোহী হয়েছিলেন, কিন্তু এই বিদ্রোহের মূল লক্ষ্য স্বাধীনতার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com