বাণিজ্যিক সম্পর্ক অবসানের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের জন্য বেইজিংকে মোকাবিলা করতে গিয়ে বিশ্ববাজারে মার্কিন প্রভাব কমে যেতে পারে, যদি ওয়াশিংটন তার মিত্র দেশ ও ব্যাবসায়িক অংশীদারদের চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে আপস করার অনুমতি দেয়। বেইজিংয়ের সঙ্গে মার্কিন মিত্রের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করতে এবং চীন-মার্কিন নেতিবাচক সম্পর্ক মোকাবিলায় ওয়াশিংটন এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক রদকে একধরনের কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছে
বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের প্রচেষ্টায় জুন ও জুলাইয়ে তিন মার্কিন মন্ত্রিপরিষদ কর্মকর্তা চীন পরিদর্শন করেন। এখন আবার চতুর্থ ব্যক্তি মার্কিন বাণিজ্য সচিব জিনা রাইমন্ডো এই মাসের শেষে চীন পরিদর্শনে যেতে পারেন। তবে এই মুহূর্তে মার্কিন-চীন কৌশলগত প্রতিযোগিতা ঠান্ডা হওয়ার আশা করা ঠিক হবে না। এক্ষেত্রে বেইজিং জোর দিয়ে বলছে যে ওয়াশিংটন তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক অবসানের মাধ্যমে চীনের উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা তৈরির ক্ষীণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। চীনা কর্মকর্তারা সম্প্রতি জো বাইডেনের নির্বাহী আদেশে প্রযুক্তির ওপর বিনিয়োগ কমানোর কথা উল্লেখ করে তাদের মন্তব্যের যথার্থতা প্রমাণের চেষ্টা করেন। অন্যদিকে ওয়াশিংটন মনে করে, এসব উচ্চপর্যায়ের সফর দ্বিপাক্ষিক মৌলিক মতবিরোধ সমাধানে ন্যূনতম ভূমিকা পালন করবে না। বরং তারা নিজেদের মধ্যে একটা যোগাযোগের চ্যানেল খুলে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনা যেন কোনো সংঘাতে রূপ না নেয়, সেই প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং সেই সঙ্গে চীনকে মার্কিন কৌশল সম্পর্কে একটা গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব অ্যান্টনি ব্লিনকেন, ট্রেজারি সেক্রেটারি জেনেট ইয়েলেন ও জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত জন কেরির চীন সফরের সময় বেইজিংয়ের সরকারি সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া চীনা উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক অবসানের অলংকৃত ফাঁদ থেকে দূরে থাকার জন্য সতর্ক করে। এটা একটা পরোক্ষ সংকেত ছিল যে এসব উচ্চপর্যায়ের আলোচনা হওয়া সত্ত্বেও দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করবে। অর্থাৎ, এর মাধ্যমে ওয়াশিংটন সাপ্লাই চেইন ও চীনের বৈদেশিক প্রযুক্তিগত বিনিময় ব্যাহত করে চীনকে নিয়ন্ত্রণে রেখে তার বৈশ্বিক আধিপত্য রক্ষা করতে চায়। বেইজিং আরো বলে, যেকোনো ধরনের অর্থনৈতিক সম্পর্কের অবনতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশ ও উদীয়মান বাজার অর্থনীতিকে বেশি আঘাত করে। বেইজিং শুধু চীনা উদ্যোক্তাদেরই না, বিশ্বের সব উন্নয়নশীল দেশকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে এবং এর মাধ্যমে এটা বোঝাতে চায় যে এখানে চীনসহ সবাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ফাঁদের শিকার হতে পারে।
এই অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতার সম্ভাবনা (ডি-রিস্কিং) বেইজিংকে সরাসরি আঘাত করেছে বলে মনে হচ্ছে। এটি হতে পারে, কারণ এর মাধ্যমে প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক আধিপত্য অর্জনের জন্য অন্যান্য পরিকল্পনার মধ্যে বৈদেশিক বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি (ওহঃবষষবপঃঁধষ চৎড়ঢ়বৎঃু) এবং মূলধন লাভের জন্য চীনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চায় এমন মিত্র দেশ ও অংশীদারদের সঙ্গে পরামর্শ করে ওয়াশিংটন তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে চায়। ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের মতে, শুধু চীনের আইপি (ওহঃবষষবপঃঁধষ চৎড়ঢ়বৎঃু) চুরির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বছরে ২২৫ বিলিয়ন থেকে ৬০০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে। এই কৌশলের মাধ্যমে বেইজিং একটি অসম প্রতিযোগিতা তৈরি করেছে, যা অবাধ প্রতিযোগিতাকে কার্যত অসম্ভব করে তোলে, যা অন্যান্য সমস্যার জন্ম দেয়। কারণ চীনের প্রতি মার্কিন নীতি ওয়াশিংটনের জন্য একধরনের কৌশলগত প্রতিযোগিতা। এই যে সাহায্যহীন অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা, ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃত, একটা অবশ্যম্ভাবী বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত দেয়। সেটা হলো যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে কৌশলগত প্রতিযোগিতা সম্ভব নয়, কারণ এখানে এক পক্ষ অন্যায়ভাবে হলেও জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
যদি এই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী গিনা রাইমন্ডোর চীন সফর সত্যিই পরিকল্পনামতো এগিয়ে যায়, তাহলে ডি-রিস্কিংয়ের সম্ভাবনা আরো প্রবল হতে পারে। রাইমন্ডো গত মাসে বলেছিলেন, সেমিকন্ডাক্টর বাদে অন্যান্য পণ্য যেমন খাদ্য, বিনোদন, স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যবর্ধনের পণ্যের মতো কিছু খাতে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। সব সম্ভাবনার মধ্যে রাইমন্ডো এই বার্তা বেইজিংয়ে নিয়ে যাবেনÍএই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার তৃতীয় বৃহত্তর রপ্তানি বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় না এবং এমন কিছু খাত রয়েছে, যেখানে চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখতে তাদের কোনো আপত্তি নেই।
বাণিজ্যিক সম্পর্ক অবসানের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের জন্য বেইজিংকে মোকাবিলা করতে গিয়ে বিশ্ববাজারে মার্কিন প্রভাব কমে যেতে পারে, যদি ওয়াশিংটন তার মিত্র দেশ ও ব্যাবসায়িক অংশীদারদের চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে আপস করার অনুমতি দেয়। বেইজিংয়ের সঙ্গে মার্কিন মিত্রের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করতে এবং চীন-মার্কিন নেতিবাচক সম্পর্ক মোকাবিলায় ওয়াশিংটন এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক রদকে একধরনের কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছে, যেটা গত মে মাসে জি-৭-এর সাধারণ সভায় ওয়াশিংটন নিশ্চিত করেছে। বেইজিং থেকে উদ্ভূত জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি প্রশমিত করার জন্য এবং বেইজিংয়ের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রদ করতে ওয়াশিংটনের জন্য তার মিত্র ও ব্যাবসায়িক অংশীদারদের সঙ্গে পরামর্শ করা খুব জরুরি। কারণ, চীন বৈধ ও অবৈধ উপায় ব্যবহার করা, রাষ্ট্রের মালিকানা লুকিয়ে রাখা বা আপাতদৃষ্টিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করাসহ বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক কৌশল অবলম্বন করে তার লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। এক্ষেত্রে ওয়াশিংটন কোনো ভুল করলেই বেইজিং তার ফায়দা লোটার চেষ্টা করবে। ওয়াশিংটনকে সব সময় ভাবা উচিত, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা প্রণয়ন করার সময় বেইজিং কীভাবে তাদের নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর চেষ্টা করবে। এক্ষেত্রে মার্কিন বহির্মুখী বিনিয়োগের বিষয়ে বাইডেনের সাম্প্রতিক ফরমান একটা গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। ফরমানটি যেকোনো বৈদেশিক চাপের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রথম পদক্ষেপ, তবে বেইজিংয়ের কার্যকলাপ থেকে উদ্ভূত জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি প্রশমনে চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য আরো বিস্তৃত পদ্ধতির প্রয়োজন হবে। সেমিকন্ডাক্টর, মাইক্রোইলেকট্রনিকস, কোয়ান্টাম ইনফরমেশন টেকনোলজি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অন্তর্ভুক্ত প্রযুক্তির ওপর প্রয়োজনীয় নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রেও কার্যকর পদ্ধতি অবলম্বন করা জরুরি।
উক্ত ফরমানের প্রতিক্রিয়ায় চীন দাবি করছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ঝুঁকি হ্রাসের কথা বলে চীনের সঙ্গে অন্যান্য দেশের বাণিজ্যিক সম্প্রর্কে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। বেইজিংয়ের প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করে ওয়াশিংটন যে কৌশলই অনুসরণ করুক না কেন এবং এটিকে যে নামেই অভিহিত করুক না কেন, চীনা কর্মকর্তারা এটিকে চীনকে আঘাত করার লক্ষ্যে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্কে বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা বলে দাবি করবে। মার্কিন ব্যবস্থার প্রতি প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বেইজিং ব্যাপকভাবে সম্প্রচার করছে যে বৈশ্বিক বাণিজ্যিক সমস্যার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই দায়ী। এখানে বেইজিং এমন যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করছে যে চীন বিশ্বকে একটি উন্নত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে পারে। উভয় ধারণাই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ এবং গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভের যথার্থতা ও কার্যকারিতা প্রমাণের চেষ্টা করছে। তাদের এসব উদ্যোগ ও বিবৃতি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে বেইজিং নিজেকে ও ওয়াশিংটনকে একটি দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ের মধ্যে দেখছে। বেইজিংয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তখনই পুনঃস্থাপন করা সম্ভব হবে, যখন ওয়াশিংটন তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও অবাস্তব দাবি তুলে নিতে রাজি হবে। অতএব, মার্কিন কর্মকর্তাদের চীনা নেতাদের বোঝানোর বৃথা আশা করা উচিত নয় যে ওয়াশিংটন আসলে চীন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টা করছে না। তবে এটি উতসাহজনক যে ওয়াশিংটন এবং তার ব্যাবসায়িক অংশীদাররা ‘ডি-রিস্কিং’ শব্দকে ঘিরে একমত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এখন ওয়াশিংটনের লক্ষ্য হওয়া উচিত তাদের পরবর্তী ব্যবস্থা যেন এই বিষয়টাকে পুরোপুরি নিশ্চিত করে। উৎস: ইত্তেফাক অন লাইন। লেখক: আটলান্টিক কাউন্সিল ফেলো.আটলান্টিক কাউন্সিল থেকে অনুবাদ :আব্দুল্লাহ আল মামুন