দুই দিন ধরে জ্বরে ভুগছিলেন কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আসাদুজ্জামান আজাদ। শারীরিক দুর্বলতায় বৃহস্পতিবার দুপুরে পড়ে গিয়ে তার মাথা ফেটে যায়। ছাত্রাবাসে থাকা সহশিক্ষার্থীরা তাকে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। চিকিৎসক স্যালাইন লিখে দিলেও হাসপাতালে সরবরাহ না থাকায় বাইরে থেকে কিনতে বলা হয়। সঙ্গে থাকা শিক্ষার্থী নাজমুল হুদা ও আশিকুর গোটা শহর ঘুরে হার্টম্যান নামক ইঞ্জেক্টেবল স্যালাইন খুঁজে পাননি।
হতাশ হয়ে ফিরে পরিচিত এক নার্সের দ্বারস্থ হন নাজমুল। পরে তার সহযোগিতায় হাসপাতালের সামনের একটি ফার্মেসিতে স্যালাইন মেলে। শঙ্কামুক্ত হন আহত আজাদ, স্বস্তি ফিরে পান তার সহশিক্ষার্থীরা। শুধু আজাদ নন, প্রতিদিন এমন দুর্ভোগে পড়ছেন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা কুড়িগ্রামের শত শত রোগী ও তাদের স্বজনরা। স্যালাইনের খোঁজে গোটা শহরের ফার্মেসিগুলো চষে বেড়ালেও কাঙ্ক্ষিত স্যালাইন মিলছে না। যারা পাচ্ছেন তাদের বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে।
নাগেশ্বরী থেকে অসুস্থ বাবাকে নিয়ে কুড়িগ্রাম হাসপাতালে আসা লুৎফর রহমান বলেন, ‘তিন দিন ধরে হাসপাতালে। কিন্তু এখান থেকে কোনও স্যালাইন সরবরাহ করা হয়নি। শহরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে খুঁজে একটি দোকানে ডিএ স্যালাইন পেয়েছি। তাও বেশি দামে কিনতে হয়েছে।’
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারিভাবে চাহিদামতো হাসপাতালে স্যালাইন সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে জীবনরক্ষাকারী এই পণ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ভর্তি হলে চিকিৎসা সেবার শুরুতেই বেশির ভাগ রোগীকে ধরন অনুযায়ী স্যালাইন পুশ করা হয়। এর মধ্যে ডিএনএস (ডেক্সট্রোজ + সোডিয়াম ক্লোরাইড), ডিএ (ডেক্সট্রোজ অ্যাকোয়া), হার্টম্যান সলিউশন, নরমাল স্যালাইন ও কলেরা স্যালাইন উল্লেখযোগ্য। কলেরা স্যালাইনের তেমন সংকট না থাকলেও অন্য স্যালাইনগুলোর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে এই সংকট চলছে। রোগীদের বাইরে থেকে স্যালাইন আনতে বললে তারা ফার্মেসিতে গিয়ে পাচ্ছেন না। হাসপাতালের স্লিপ দেখলেই ফার্মেসি থেকে ‘স্যালাইন নাই’ বলে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে ফার্মেসিগুলো ক্লিনিকগুলোতে অপারেশনের রোগীদের জন্য প্যাকেজ আকারে স্যালাইন সরবরাহ করে।
কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, প্রতিদিন শিশু বাদে হাসপাতালে দুই শতাধিক নতুন রোগী ভর্তি হন। ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন চার শতাধিক রোগী ভর্তি থাকেন। এসব রোগীর জন্য প্রতিদিন বিভিন্ন প্রকারের কমপক্ষে দুইশ’ স্যালাইন প্রয়োজন হয়। কিন্তু এসব স্যালাইনের সরবরাহ নেই। এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) সরকারি হাসপাতালে এসব স্যালাইন সরবরাহ করে থাকে। কিন্তু কয়েক মাস ধরে চাহিদা অনুযায়ী তারা স্যালাইন দিচ্ছে না। ফলে হাসপাতালে স্যালাইনের তীব্র সংকটে চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স আঁখি তারা বলেন, ‘হাসপাতালে স্যালাইনের সংকট চলছে। রোগীরা বাইরে গিয়েও স্যালাইন পাচ্ছেন না। অথচ কোনও দুর্ঘটনা, পেটব্যথা, রক্তক্ষরণ কিংবা অপারেশনের রোগীর জন্য স্যালাইন অত্যাবশ্যক।’
হাসপাতালের নার্সিং সুপারভাইজার ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেও স্যালাইন সংকটের সত্যতা পাওয়া গেছে। হাসপাতালে কর্মরত কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মচারী বলেন, ‘এর আগে কখনও স্যালাইনের এমন সংকট আমরা দেখিনি। সব ধরনের স্যালাইনের এমন সংকট সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য কোনও সিন্ডিকেটের কাজ কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার।’
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শাহীনুর রহমান সরদার বলেন, ‘স্যালাইনের সংকট চলছে। আমরা হিমশিম খাচ্ছি। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। আমরা চাহিদা পাঠাই। কিন্তু খুবই নগণ্য পরিমাণ সরবরাহ দেওয়া হয়। সরবরাহ স্বাভাবিক হলে সংকট কেটে যাবে।’
ওষুধ ব্যবসায়ীরা বলছেন, অপসো, ওরিয়ন, লিবরা ও পপুলার নামে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইঞ্জেক্টেবল স্যালাইন সরবরাহ করে। কিন্তু গত তিন মাস ধরে তারা চাহিদা অনুযায়ী স্যালাইন দিচ্ছে না। ফলে ফার্মেসিগুলোতেও এসব স্যালাইনের সংকট চলছে। শহরের হাসপাতাল মোড়ের ওষুধ ব্যবসায়ী লাতুল বলেন, ‘সাপ্লাই নাই। কোম্পানি স্যালাইন না দিলে আমরা কী করবো! তারা (কোম্পানির প্রতিনিধিরা) বলে যে, ডলার নাই। কাঁচামাল কিনতে না পারায় স্যালাইন উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। যে দু-চারটা স্যালাইন দেয় তা একঘণ্টাও দোকানে থাকে না। দিনভর রোগীর স্বজনরা দোকানে এসে ফেরত যান।’
সিভিল সার্জন ডা. মো. মঞ্জুর-এ-মুর্শেদ বলেন, ‘স্যালাইন সংকট চলছে। তবে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার জন্য আমরা কিছু স্যালাইন রেখেছি। বিভিন্ন মাধ্যম ও কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে আমরা জেনেছি যে, প্রায় জেলাতে এ সংকট চলছে। সংকটের বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি।’