দেশের সব আদালতেই জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি অত্যাবশ্যকীয় একটি উপকরণ। এক সময় সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের সব আদালত অঙ্গনে জাল জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফিতে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল। সব আদালত অঙ্গনে এই জাল কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্প সরবরাহ করতো জালিয়াত চক্র। প্রতিটি আদালত অঙ্গন ও বার সমিতিতে গড়ে উঠেছিল এই জালিয়াত চক্রের সিন্ডিকেট। এতে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছিল সরকার।
অবস্থা বেগতিক দেখে জাল জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি ব্যবহার বন্ধে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে নেওয়া হয় বিশেষ উদ্যোগ। ২০২২ সালে জাল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি সনাক্তকরণে সব আদালতে একযোগে ১ হাজার দুইশত ইইডি লাইট ডিটেক্টর সরবরাহ করা হয়। পুলিশের সহায়তায় অভিযান পরিচালনা করে জালিয়াত চক্রের অনেককে গ্রেফতার করা হয়। ফলে প্রায় বন্ধ হয়ে যায় জাল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি ব্যবহার।
কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের প্রায় সব আদালতে জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফির সংকটের কথা জানিয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে সুপ্রিম কোর্টে একের পর এক চিঠি আসছে। ভোগান্তিতে পড়েছেন বিচারপ্রার্থীরা। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন এই সংকটের নেপথ্যে সিন্ডিকেটের কারসাজি থাকতে পারে। এদিকে জরুরী ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি সরবরাহ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার(বিচার) এসকে.এম তোফায়েল হাসান স্বাক্ষরিত চিঠিতে সুপ্রিম কোর্ট সহ অধস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালে স্ট্যাম্প, কার্টিজ পেপার, কোর্ট ফি ও ফলিওর স্বাভাবিক সরবরাহ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে বিচার বিভাগ অন্যতম। সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ এবং দেশের ৬৪টি জেলার অধস্তন আদালতে প্রতি কার্যদিবসে বিচারপ্রার্থী জনগণের পক্ষে মামলা দায়েরসহ অন্যান্য দরখাস্ত দাখিলের সময় জুডিশিয়াল ও নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি সংযুক্ত করতে হয়। আদালতে দাখিলকৃত স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি’র মাধ্যমে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পেয়ে থাকে। জুডিশিয়াল ও নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প জালিয়াতির কারণে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হতে বি ত হচ্ছিল। নকল স্ট্যাম্প ও কোর্ট কি সনাক্তকরণের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ ডাক বিভাগ, সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন বাংলাদেশ লিমিটেড (এসপিসিবিএল), ডিপার্টমেন্ট অব কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট ও পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্ট, বাংলাদেশ ব্যাংক এর সমন্বয়ে কিছু স্বল্প মেয়াদী ও কিছু দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ওঈউ টঠ খঊউ ভষধংয ষরমযঃ (টঠ-৩৬৫হস) ডিভাইস ব্যবহার করে নকল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি সনাক্তকরণের নিমিত্ত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট অধস্তন আদালতের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা এবং জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি/সম্পাদকগণ-কে প্রশিক্ষণ প্রদান করে এবং অধস্তন আদালতে ওঈউ টঠ খঊউ ভষধংয ষরমযঃ (টঠ- ৩৬৫হস) ডিভাইস বিতরণ করে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং দেশের ৬৪টি জেলায় স্ট্যাম্প, কার্টিজ পেপার, কোর্ট ফি ও ফলিও এর সংকট বিরাজ করছে। বিচারপ্রার্থীদের বাধ্য হয়ে কয়েক গুন বেশি দামে ভেন্ডারদের কাছ থেকে এসব কিনতে হচ্ছে। ফলে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ভেন্ডারদের অভিযোগ, ট্রেজারিতে স্ট্যাম্প, কার্টিজ পেপার, কোর্ট ফি ও ফলিও এর চরম সংকট থাকায় ট্রেজারি শাখা থেকে চাহিদামত স্ট্যাম্প, কার্টিজ পেপার, কোর্ট ফি ও ফলিওর সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সহ অধস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালে স্ট্যাম্প, কার্টিজ পেপার, কোর্ট ফি ও ফলিওর স্বাভাবিক সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য নির্দেশক্রমে আপনাকে অনুরোধ করা হলো।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. গোলাম রব্বানী বলেন, ‘জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফির সংকটের বিষয়টি আমরা মাননীয় ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান স্যারকে জানিয়েছি। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরসহ সংশ্লিষ্টদের জরুরী ভিত্তিতে জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি সরবরাহ করতে বলেছেন। আমরা প্রধান বিচারপতির নির্দেশনার কথা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও আইন মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে। আশা করছি দ্রুতই এই সংকট কেটে যাবে।’
জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প- কোর্ট ফি কী
জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প মামলার আবেদন, মামলা দায়ের, ওকালতনামা, এফিডেভিট প্রদান এবং রায় ও আদেশের প্রত্যায়িত অনুলিপিতে ব্যবহৃত হয়। এটি স্ট্যাম্প ‘কোর্ট ফি নামে পরিচিত। দেশের সব আদালতেই জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প অত্যাবশ্যকীয় একটি উপকরণ। এ কারণে সব আদালতে মামলা রুজুর ক্ষেত্রে বহু নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ব্যবহৃত হয়। সাধারণ তথ্য মতে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে ১ হাজার নতুন মামলা রুজু হয়। আদালতে মামলা করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের আবেদন এবং আদেশ বা রায়ের অনুলিপি সংগ্রহ করার প্রতিটি পর্যায়ে সরকারকে নির্ধারিত ফি দিতে হয়। আদালতে এটা কোর্ট ফি নামে পরিচিত। অন্যদিকে জমি কেনা বা হস্তান্তর করতেও রেজিস্ট্রেশনের জন্য প্রয়োজন হয় বিভিন্ন দামের রেভিনিউ স্ট্যাম্প। বর্তমানে ৩৪টি ক্ষেত্রে কোর্ট ফি ব্যবহার হয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে আর্থিক মামলা, ক্ষতিপূরণ, বাজারমূল্য আছে বা নেই- এ রকম স্থাবর সম্পত্তি, দখল পুনরুদ্ধার, নিষেধাজ্ঞা, মুসলিম আইনের অধীনে অগ্রক্রয়, দলিল রদ, দলিল সংশোধন, চুক্তি রদ, ঘোষণা মামলা-পরবর্তী প্রতিকার, চুক্তি প্রবল, ইজমেন্ট অধিকার, বন্ধক খালাস, ফোরক্লোসার, মোহরানা, ভরণপোষণ, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার, বিবাহ বিচ্ছেদ, অভিভাবকত্ব, সাধারণ ঘোষণা, বাটোয়ারা ও পৃথক দখল, ভাড়া, ডিক্রি রদ, ঘোষণা ও নিষেধাজ্ঞা, আপিল ও রিভিশনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়ের হওয়া মামলা। চ্যানেল২৪