পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ও সম্ভ্রান্ত বংশ হলো আরবের কুরাইশ বংশ। প্রিয় নবী (সা.)-এর শুভাগমন এই কুরাইশ বংশেই হয়েছে। গোটা পৃথিবীর মধ্যে এটি পূতঃপবিত্র মর্যাদার অধিকারী। কুরাইশ নামে পবিত্র কোরআনে একটি সুরাও আছে। মহান আল্লাহ যখন কাউকে নবুয়ত ও রিসালাতের জন্য মনোনীত করেন, তখন তাকে পূতঃপবিত্র এবং শ্রেষ্ঠতম বংশেই পাঠিয়ে থাকেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমার জন্ম পরিক্রমায় জাহেলি যুগের ব্যভিচারীদের কোনো অংশ নেই, আমার জন্ম ইসলামী রীতি অনুসারে হয়েছে।’ (বায়হাকি)
ইবরাহিম (আ.)-এর দুই পুত্র: ইবরাহিম (আ.)-এর দুই পুত্রের মধ্যে একজন ইসমাঈল (আ.) ও অপরজন হলেন ইসহাক (আ.)। ইসমাঈল (আ.)-এর বংশে আগমন করেন প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)। আর ইসহাক (আ.)-এর বংশধরদের বলা হয় বনি ইসরাইল। ইবরাহিম (আ.)-এর পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর জন্মের পর স্ত্রী হাজেরা ও সন্তানকে মহান প্রভুর নির্দেশে কাবা শরিফের কাছে রেখে যান। জায়গাটা ছিল জনমানবশূন্য ও বালুকাময় মরুভূমি। সেখান কোনো পানির ব্যবস্থা ছিল না। পরে ইসমাঈল (আ.)-এর পবিত্র পায়ের আঘাতে আল্লাহ তায়ালা অলৌকিকভাবে জমজম কূপের ব্যবস্থা করে দেন। এর পর থেকে ধীরে ধীরে সেখানে জনবসতি গড়ে ওঠে। কালক্রমে সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয় কুরাইশ বংশ। পবিত্র কাবা ঘরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল কুরাইশ বংশের লোকেদের ওপর।
কুরাইশ কাদের বলা হয়? রাসুল (সা.)-এর ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ ফিহর-এর উপাধি ছিল কুরাইশ।
ফিহর খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দে মক্কায় জন্ম গ্রহণ করেন। এ জন্য তাঁর বংশধরদের কুরাইশি বলা হয়। আদম (আ.) থেকে শুরু করে ফিহর পর্যন্ত বংশপরিক্রমায় মোট ৭৯ জন ব্যক্তির নাম ইতিহাসের মধ্যে লিপিবদ্ধ আছে।
জুবায়ের (রা.) বলেন, কুরাইশ হলো ফিহর ইবনে মালিকের নাম। তাঁর সন্তানরাই কুরাইশ বংশের অন্তর্ভুক্ত। খ্রিস্টীয় প ম শতাব্দীতে ফিহরের অধস্তন পুরুষ ‘কুসাই’ মক্কানগরীসহ গোটা হিজাজে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি পবিত্র কাবা ঘরকে একত্র হওয়ার স্থানে পরিণত করেন।
আবু জর হারবি বলেন, নজর বিন কিনানার সন্তানদের কুরাইশ বলা হয়। যারাই নজর বিন কিনানার বংশধর, তারাই কুরাইশ নামে অভিহিত। এটি বেশির ভাগ আলেমের মত। কেননা হাদিসে এসেছে, আশআস বিন কায়েস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি কিনদা গোত্রের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এলাম। তারা (কিনদা গোত্র) আমাকে তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মনে করত। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনারা কি আমাদের অন্তর্ভুক্ত নন? তিনি বলেন, আমরা বনু নজর বিন কিনানার বংশধর। আমরা আমাদের মাতার প্রতি অপবাদ আরোপ করি না এবং আমাদের পিতৃপুরুষ থেকেও পৃথক হই না। বর্ণনাকারী বলেন, (এর পর থেকে) আশআস বিন কায়েস (রা.) বলতেন, যে ব্যক্তি কুরাইশ গোত্রের কোনো লোককে নজর বিন কিনানা গোত্রভুক্ত নয় বলে দাবি করবে, আমি অবশ্যই তাকে কাজাফ তথা মিথ্যা অপবাদের শাস্তি দেব। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৬১২ আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেন, প্রিয় নবী (সা.) জিবরাইল (আ.) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি (জিবরাইল) বলেন, আমি সারা পৃথিবী পরিভ্রমণ করেছি, কিন্তু মুহাম্মদ (সা.) থেকে উত্তম কোনো মানুষ দেখিনি, আর বনু হাশেমের চেয়ে উত্তম কোনো গোত্র দেখিনি। (তাবরানি, হাদিস : ৬২৮৫) বনু হাশেম হলো কুরাইশ বংশের একটি গোত্র।
কুরাইশ নামের তাৎপর্য: কুরাইশকে কুরাইশ বলার বিভিন্ন কারণ আছে। যেমন: ১. ইবনে হিশামের মতে, কুরাইশ শব্দটি ‘তাকাররুশ’ থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ ব্যবসা-বাণিজ্য করা, ব্যবসা করা, কামাই-রোজগার করা। তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করত বলে তাদের কুরাইশ বলা হয়।
২. কারো কারো মতে, কুরাইশ অর্থ জমায়েত করা বা একত্র করা। কেননা তারা বিভিন্ন দিকে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছিল, সর্বপ্রথম কুসাই বিন কিলাব তাদের হারামের চারপাশে জড়ো করেন, ফলে তাদের কুরাইশ বলা হয়েছে। ৩. কারো কারো মতে, কুরাইশ শব্দটি ‘তাকরিশ’ থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ হলো অনুসন্ধান করা। কেননা নজর বিন কিনানের ছেলেরা হজ মৌসুমে হাজিদের খবরাখবর নিতেন এবং তাঁদের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণ করতেন। হজ শেষ করে লোকেরা যাতে ফিরে যেতে পারে তার ব্যবস্থাও করতেন।
৪. ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, কুরাইশ ‘কারশুন’ শব্দ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। কারশুন হলো সমুদ্রে বিচরণকারী একটি বড় প্রাণী। যেটি ছোট-বড় সব প্রাণী খেয়ে ফেলে। এর দ্বারা কুরাইশদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। কেননা কুরাইশদের বংশেই শেষ নবীর আত্মপ্রকাশ ঘটবে। ৫. কুরাইশ সমুদ্রের একটি বড় মাছের নাম। এই মাছ অন্যান্য মাছের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে। তেমনিভাবে কুরাইশ অন্য সব গোত্রের ওপর প্রাধান্য পেয়ে থাকে। (কুরতুবি)
কুরাইশ বংশে শেষ নবীর শুভাগমন: প্রিয় নবীজি (সা.)-কে প্রেরণের জন্য ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছেন। ইবরাহিম (আ.) কাবাঘর নির্মাণকাজ শেষ করে বলেছিলেন, ‘হে আমাদের রব! তাদের মধ্য থেকে তাদের কাছে একজন রাসুল প্রেরণ কোরো। যে তোমার আয়াতগুলো তাদের কাছে আবৃত্তি করবে। তাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবে এবং তাদের পবিত্র করবে। তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২২৯)
আল্লাহ তাআলার চিরন্তন নিয়ম হলো, তিনি নবীদের দোয়া আবশ্যই কবুল করে নেন। তাই আল্লাহ ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া কবুল করেন এবং শেষ যুগের নবীকে তাঁর বংশে প্রেরণ করেন।
কুরাইশ নামে কোরআনের সুরা। কুরাইশ বংশ হলো নবীর বংশ এবং আরবের শ্রেষ্ঠতম মর্যাদার অধিকারী। ফলে লোকজন তাদের সম্মান করত এবং তাদের নেতৃত্বও মেনে চলত। তারা সিরিয়া ও ইয়েমেন অ লে ব্যবসা-বাণিজ্য করত। শীত-গ্রীষ্মের প্রতিকূল আবহাওয়াও তারা নির্বিঘেœ ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যেত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যেহেতু কুরাইশের আসক্তি আছে। আসক্তি আছে তাদের শীত ও গ্রীষ্ম সফরে। অতএব, তারা যেন এ গৃহের রবের ইবাদত করে, যিনি ক্ষুধায় তাদের আহার দিয়েছেন আর ভয় থেকে তাদের নিরাপদ করেছেন।’ (সুরা : কুরাইশ) লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, চট্টগ্রাম