রংপুরে প্রান্তিক মুরগি খামারির সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। খাবার ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, বিরূপ আবহাওয়াসহ নানা কারণে লোকসানের মুখে পড়ে মুরগি পালন ছেড়ে দিচ্ছেন খামারিরা। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বিকল্প পেশায় ঝুঁকছেন অনেকে। এ অবস্থায় সরকারি উদ্যোগের দাবি তুলেছেন তারা।
রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর সূত্রে জানায়, জেলায় নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত লেয়ার মুরগির খামারের সংখ্যা ৬৫৩। বর্তমানে কতগুলো চালু রয়েছে তার সঠিক তথ্য জানা যায়নি। তবে জেলা পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন সূত্র মতে, বর্তমানে প্রান্তিক পর্যায়ে প্রায় ৫০টি লেয়ার মুরগির খামার চালু রয়েছে।
জানা গেছে, ৯০ দশকের শেষ দিকে রংপুরে ছোট ছোট আকারে শুরু হয় মুরগি পালন। এরপর ২০০৪-০৫ সালের দিকে ব্যাপক হারে খামারভিত্তিক মুরগি পালন শুরু হয়। সে সময় লক্ষাধিক মুরগির খামার গড়ে ওঠে। কিন্তু ২০০৭ সালে মহামারি হিসেবে দেখা দেয় অ্যাভিয়াম ফ্লু। যার প্রভাব পড়ে পোলট্রি শিল্পে। ধীরে ধীরে কমতে থাকে খামার। ২০১৯ সাল থেকে পোলট্রি খাদ্যের ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় এ শিল্পে নেমে আসে বিপর্যয়। রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের মহব্বত আলী জানান, দীর্ঘদিন লেয়ার মুরগির খামারের মাধ্যমে ডিম উৎপাদন করতেন। কিন্তু মুরগির খাবার ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণে লোকসানের মুখে প্রায় এক বছর ধরে খামারের শেড পড়ে আছে। খামারে মুরগির সংখ্যা ছিল আট হাজার।
সিটি করপোরেশনের নজিরের হাট এলাকার খামারি ফিরোজ মিয়া জানান, এক বছর আগে খামার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। সেইসময় খামারে মুরগির সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার। মুরগির খাবারসহ বিভিন্ন উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাধ্য হয়েছেন আপাতত খামার বন্ধ করতে। ফিরোজের মতো খামার বন্ধ করে মুরগির অব্যবহৃত শেডে ভুট্টা, ধান ও লাকড়ির গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছেন এমন অনেক প্রান্তিক খামারি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খাবার ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিরূপ আবহাওয়া। অধিকাংশ খামার সনাতন পদ্ধতিতে পরিচালিত হওয়ায় গত ৩-৪ মাস আগে হিট স্ট্রোকে (প্রচ- গরম) নগরীর বোতলা এলাকার খামারি বেলায়েত মাস্টারের আট হাজার মুরগির মধ্যে দেড় হাজার মুরগি মারা গেছে। এছাড়া পীরগাছা উপজেলার সাতদড়গাহ গ্রামের খামারি আবু হাশেমের ১২ হাজার মুরগির প্রায় দেড় হাজার, গঙ্গাচড়া উপজেলার মৌলভীবাজার এলাকার খামারি আবু বক্করের ছয় হাজার মুরগির প্রায় ৭০০ মারা গেছে অতিরিক্ত গরমে।
রংপুর জেলা পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আরমানুর রহমান লিংকন জানান, ১৯৯৬ সাল থেকে মুরগির ডিম উৎপাদন করছেন। বর্তমানে মুরগির খাবারের দাম প্রকার ভেদে শতকরা ৪৫ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক বছর আগে ৫০ কেজির খাবারের বস্তার দাম ছিল দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা। বর্তমানে সেটি বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে তিন হাজার ২০০ থেকে তিন হাজার ৪০০ টাকা।
লিংকন বলেন, নানা অব্যবস্থাপনায় সম্ভাবনাময় পোলট্রি খামার কমতে কমতে এখন ৫০টিতে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রান্তিক খামারিদের এখন একটি ডিম উৎপাদন করতে খরচ হচ্ছে ১০ দশমিক ২০ টাকা। তবে করপোরেট কোম্পানিগুলো একসঙ্গে অনেক ডিম উৎপাদন করায় তাদের খরচ তুলনামূলক কম হয় বলে তিনি দাবি করেন। লিংকন জানান, বর্তমানে জেলায় প্রতিদিন ডিমের চাহিদা হচ্ছে প্রায় ১০ লাখ। এর মধ্যে মাত্র এক লাখ ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ পিস ডিম সরবরাহ করছে প্রান্তিক খামারিরা। বাকি ডিম সরবরাহ করছে করপোরেট কোম্পানিগুলো।
বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন রংপুর বিভাগের সমন্বয়কারী মাহবুব আলম বলেন, মূলত পোলট্রি খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত এবং উৎপাদিত ডিমের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় বর্তমানে জেলা পর্যায় খামারির সংখ্যা একশোর নিচে নেমে এসেছে।
মাহবুব আলম আরও বলেন, ভুরাঘাটে আমার ১৬ হাজার মুরগি ছিল। কিন্তু অব্যাহত লোকসানে বর্তমানে মুরগির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে চার হাজার। তার মতো অনেকে খামার বন্ধ করেননি ঠিকই, তবে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছেন। ব্যাংকের চাপে এখন কোনোমতে খামার টিকিয়ে রেখেছেন। এ অবস্থায় সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়ন ফোরামের সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবলু বলেন, প্রান্তিক খামারিদের মাধ্যমে অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে এরা বড় অবদান রাখছে। কিন্তু করপোরেট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারা ও বৈশ্বিক মন্দাসহ নানা প্রতিকূলতায় ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে খামার। ক্ষুদ্র খামারিদের টিকিয়ে রাখতে সরকারের প্রত্যক্ষ সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসা দরকার। রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এনামুল হক বলেন, জেলায় নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত লেয়ার মুরগির খামারের সংখ্যা হচ্ছে ৬৫৩টি। তালিকাভুক্ত হলেও খামারগুলো নিয়মিত চালু থাকে না।