মহালয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার আগমনধ্বনি বেজে উঠেছে। দুর্গাপূজার ঢাকে কাঠি পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। মণ্ডপে মণ্ডপে ঢাকের বোলে নেচে উঠবে শিশু থেকে বৃদ্ধ। কিন্তু যেই ঢাক দুর্গা পূজার অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ, সেই ঢাকের কারিগরদের মনেই বিষাদের বাজনা। রাজধানীর শাঁখারিবাজার এলাকায় রয়েছে শতবর্ষী কয়েকটি বাদ্যযন্ত্রের দোকান। সারাবছর বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বিক্রি হলেও, দুর্গা পূজার সময় তাদের ব্যস্ততা থাকে পূজার অন্যতম অনুষঙ্গ ঢাক আর ঢোল বানাতে ও মেরামত করতে। রাজধানী ও আশেপাশের জেলাগুলো থেকে ঢাকিরা এখানে ছুটে আসেন ঢাক মেরামত করতে অথবা নতুন ঢাক কিনতে। কিন্তু এবার ভিন্ন চিত্র ঢাকের দোকানগুলোতে। মহালয়ার কয়েকদিন আগে থেকে ভিড় জমতে থাকতো যে দোকানগুলোতে এবার ঢাকিদের আনাগোনা নিতান্তই কম সেখানে। কাজ নেই শাঁখারিবাজারের এই ঢাক কারিগরদের হাতে। কারিগররা জানান, প্রতিবছর পূজার ১ মাস আগে থেকেই অর্ডার আসে ঢাকের। ঢাক বানাতে আর মেরামত করতে ব্যস্ত সময় যায় তাদের। তবে এবার পূজোয় নেই তাদের ব্যস্ততার রেশ। ক্রেতার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন তারা।
আদি বাদ্য ভাণ্ডারের সত্ত্বাধিকারী উত্তম সুর বলেন, ঢাক বানানো আমাদের তিন পুরুষের পেশা। আমি নিজে আজ ২৫ বছর ঢাক বানাচ্ছি। তবে এবার ঢাকের চাহিদা নেই বললেই চলে। প্রতিবছর কম করে হলেও ৫-৬টা ঢাক বিক্রি করি। আর মেরামত করি ১৫-২০টা বা তারও বেশি। কিন্তু এবছর ঢাক বিক্রি করেছি মাত্র ১টা। মেরামত করেছি ৩টা। কাঠ, চামড়া বেত, নিয়ে বসে আছি, কাজ নেই।
নিউ বাদ্য ভা-ারেরে সত্ত্বাধিকারী ও ঢাকের কারিগর গোপাল দাস বলেন, ৪-৫ বছর আগেও ১২-১৪টা ঢাক বিক্রি করতাম। গতবছর বিক্রি হয়েছে ৬টা। এবছর মাত্র ২টা। তাও বড় ঢাক বিক্রি হয়নি। এসময়টা আমরা অপেক্ষায় থাকি ঢাক বিক্রির জন্য, কিন্তু এবছর কাজই নেই, মেরামতের কাজও কম।কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে কারিগররা জানান, এবছর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে টান পড়ছে পূজোর আমেজেও। বড় পূজো হওয়ায় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা চেষ্টা করেন খুব আড়ম্বরপূর্ণভাবে পূজা উদযাপনের। অর্থনৈতিক কারণে এবছর মণ্ডপের সংখ্যা গেলো বছরের তুলনায় কম হচ্ছে। তাছাড়া ঢাকিরা পুরাতন ঢাকই মেরামত করে চালিয়ে নিচ্ছেন, একারণে নতুন ঢাক বিক্রি নেই। আবার মেরামত খরচের কারণেও ঢাকিরা কারিগরদের কাছে আসছেন, যাদের একান্তই দরকার তারাই মেরামত করতে আসছেন। নিউ বাদ্য ভা-ারের উত্তম কুমার বলেন, জিনিসপত্রের দাম বেশি, অনেক জায়গায় পূজা হবে না এবার। তাই ঢাক বিক্রি কম। এছাড়াও ঢাক মেরামত করতেও ৩-৪ হাজার টাকা খরচ। তাই ঢাকিরাও বাড়তি খরচ করতে চাচ্ছেন না।
অপর কারিগর বলেন, ঢাকের সাথে সম্পর্ক মূলত ঢাকিদের। কিন্তু একজন ঢাকিকে পূজোর ৫-৬ দিনে খাওয়া-দাওয়াসহ প্রায় ২০-৩০ হাজার টাকা দিতে হয়। দুর্গাপূজা ছাড়াও বছরে কালী পূজা, সরস্বতী পূজা, অন্য পূজাগুলো মিলিয়ে ৮০-৯০ হাজার টাকা ঢাকির পিছনে খরচ। তাই মন্দির কমিটিগুলো এখন নিজেরাই ঢাক কিনে রাখে, যুবকরা ঢাক বাজায়। তারা তো ঢাক মেরামতের বিষয়টা বোঝে না। তাই ঢাক মেরামতও কমে গেছে। ঢাকের কদর কমার পিছনে আধুনিক সাউন্ড সিস্টেমের কোনও সম্পর্ক আছে কিনা জানতে চাইলে, ঢাকের কারিগর সাহা বলেন, ঢাক দুর্গা পূজার অন্যতম উপাদান। ঢাক ছাড়া পূজা সম্ভব না। ঐতিহ্যগতভাবেই ঢাকের ব্যবহার। আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম যতই আসুক ঢাকের ব্যবহার আজীবন থাকবে।
ঢাকের কারিগর জুরান দাস বলেন, আধুনিক বাজনার সাথে ঢাকের সম্পর্ক নেই। ঢাক পূজায় থাকবেই। ঢাক ছাড়া পূজা হবে না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ঢাক, করতাল ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে।
কারিগররা জানান, শাঁখারিবাজারে মূলত ৩ সাইজের ঢাক আছেÍ ছোটো, মাঝারি ও বড়। ছোটো সাইজের একটা ঢাক কাঠ ভেদে পড়ে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা। আর মাঝারিগুলো ১৫-১৮ হাজার। আর বড় ঢাক ২০-২৬ হাজার টাকা। মেহগনি, আম, নিমসহ বিভিন্ন কাঠের ব্যবহার হয় ঢাকের খোল হিসেবে। শাঁখারিবাজারে এসব কাঠ আসে মানিকগঞ্জ থেকে। একটা ঢাক বানাতে কারিগরদের সময় লাগে আকৃতি ভেদে ২-৩ দিন।সনাতন ধর্মাবলম্বী যুব সংগঠন ‘শতদল বিকাশ ক্লাব’-এর সহসভাপতি তূর্য দেবনাথ বলেন, শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রধান আকর্ষণই হচ্ছে ঢাক। ঢাকের বাদ্যে মুখরিত হয়ে ওঠে দুর্গা মণ্ডপগুলো। ছোটবেলায় সারাদিন ঢাকিদের সাথে থাকতাম। তারা কীভাবে ঢাকে বোল তোলে দেখতাম। ঢাকের শব্দ শুনলেই বোঝা যায় দেবী এসেছেন।-বাংলাট্রিবিউন