অপ্রাপ্তি নয়, প্রাপ্তির সংখ্যাই ঈমানদারের জীবনে বেশি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা যদি (নিজেদের জীবনে) আল্লাহর নেয়ামত গণনা করো, তবে গুনে শেষ করতে পারবে না।’ কিন্তু আমরা জীবনের অপ্রাপ্তিগুলো নিয়ে পড়ে থাকি বলে প্রাপ্তির শুকরিয়া আদায় করতে পারি না। ফলে অশান্তি আমাদের জীবন থেকে যায় না। দ্বীনি এবং দুনিয়াবি এমন অনেক বিষয় আছে, উম্মতে মোহাম্মদী হিসেবে যা একমাত্র আমরাই পেয়েছি। অন্য নবীর উম্মতরা পাননি। তন্মধ্যে একটি হলো জুমার দিন। হাদিস শরিফে এই দিনের অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন: জুমার দিন শুধু এই উম্মতের বৈশিষ্ট্য : হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, নবীজী সা: বলেন, আমাদের পূর্ববর্তী উম্মতকে জুমার দিন সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা অজ্ঞ রেখেছেন। ইহুদিদের ফজিলতপূর্ণ দিবস ছিল শনিবার। খ্রিষ্টানদের ছিল রোববার। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দুনিয়ায় পাঠালেন এবং জুমার দিনের ফজিলত দান করলেন। সিরিয়ালে শনি ও রোববারকে শুক্রবারের পরে রাখলেন। দুনিয়ার এই সিরিয়ালের মতো কেয়ামতের দিনও ইহুদি খ্রিষ্টানরা মুসলমানদের পরে থাকবে। আমরা উম্মত হিসেবে সবার শেষে এলেও কেয়ামতের দিন সব সৃষ্টির আগে থাকব (মুসলিম-১৪৭৩)। জুমার দিন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ দিন : হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, নবীজী সা: বলেছেন, পৃথিবীর যত দিন সূর্য উদিত হবে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ দিন হলো শুক্রবার। এ দিনে আদম আ:-কে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে। এ দিনেই তাঁকে জান্নাত থেকে বের করা হয়েছিল। সর্বশেষ কেয়ামত সংঘটিত হবে শুক্রবার দিনে (মুসলিম-৮৫৪)।
সপ্তাহের সেরা দিন : রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, জুমার দিন দিবসসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং তা আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১০৮৪)।
গুনাহ মাফের দিন : রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করে উত্তম পোশাক পরিধান করবে এবং সুগন্ধি ব্যবহার করবে, যদি তার নিকট থাকে। তারপর জুমার নামাজে আসে এবং অন্য মুসল্লিদের গায়ের ওপর দিয়ে টপকে সামনের দিকে না যায়। নির্ধারিত নামাজ আদায় করে। তারপর ইমাম খুতবার জন্য বের হওয়ার পর থেকে সালাম পর্যন্ত চুপ করে থাকে। তাহলে তার এই আমল পূর্ববর্তী জুমার দিন থেকে পরের জুমা পর্যন্ত সব সগিরা গুনাহের জন্য কাফ্ফারা হবে (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৪৩)।
প্রতি কদমে এক বছরের নেকি লাভ : নবীজী সা: ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি জুমার দিনে উত্তমরূপে গোসল করে আগে আগে মসজিদে যায় এবং বাহনে না চড়ে হেঁটে যায়। ইমামের কাছাকাছি বসে মনোযোগ দিয়ে ইমামের আলোচনা শোনে, অনর্থক কাজ না করে, তবে তার প্রতি কদমের বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা এক বছর সিয়াম ও কিয়ামের সাওয়াব দান করেন (তিরমিজি-হাদিস : ৪৫৬)।
শুক্রবার মুসলমানদের ঈদের দিন : রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, এই দিন অর্থাৎ জুমার দিনকে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের জন্য ঈদের দিন বানিয়েছেন (সহিহ ইবনে মাজাহ-৯০৮)।
কবরের আজাব থেকে নাজাত : হাদিস শরিফে এরশাদ হয়েছে, কোনো মুসলমান শুক্রবারে রাতে কিংবা দিনে ইন্তেকাল করলে আল্লাহ তায়ালা তাকে কবরের আজাব থেকে রক্ষা করবেন (তিরমিজি-১০৭৪)।
ফজিলতপূর্ণ এই দিনের বিশেষ কিছু আমলের কথা হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে। এখানে কয়েকটি আমলের কথা উল্লেখ করা হলো।
১. প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে আদায় করা ফজিলতপূর্ণ। এর মধ্যে শুক্রবারে ফজরের নামাজ জামাতে আদায় করা বেশি ফজিলতপূর্ণ। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহর কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ নামাজ হলো শুক্রবারের ফজরের নামাজ। যা জামাতের সাথে আদায় করা হয় (সিলসিলাতুস সহিহা-৪/৯১)। ২. গোসল করা। ৩. উত্তম পোশাক পরিধান করা। ৪. সুগন্ধি ব্যবহার করা। ৫. আগে আগে মসজিদে যাওয়া : এই দিনের গুরুত্বপূর্ণ আমল হচ্ছে আগে আগে মসজিদে যাওয়া। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের আজান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে দ্রুত ছুটে যাও এবং বেচাকেনা বন্ধ করো। এটা তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা বোঝো’ (সূরা জুমা, আয়াত : ৯)।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, জুমার দিন মসজিদের দরজায় ফেরেশতারা অবস্থান করেন এবং ক্রমানুসারে আগে আগমনকারীদের নাম লিখতে থাকেন। যে সবার আগে আসে সে ওই ব্যক্তির মতো যে একটি মোটাতাজা উট কোরবানি করে। এরপর যে আসে সে ওই ব্যক্তি যে একটি গাভী কোরবানি করে। এরপর আগমনকারী ব্যক্তি মুরগি দানকারীর মতো। তারপর ইমাম যখন বের হন তখন ফেরেশতাগণ তাদের লেখা বন্ধ করে দেন এবং মনোযোগসহকারে খুতবা শুনতে থাকেন (বুখারি, হাদিস : ৯২৯)।
৬. সূরা কাহাফ তেলাওয়াত করা : আবু সাঈদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন সূরা কাহফ পাঠ করবে, তার জন্য দুই জুমা পর্যন্ত নূর উজ্জ্বল করা হবে (আমালুল ইয়াওমী ওয়াল লাইল, হাদিস : ৯৫২)।
৭. বেশি বেশি দরুদ শরিফ পাঠ করা : এই দিনের আরেকটি আমল হচ্ছে নবীজীর ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করা। এই মর্মে রাসূল সা: বলেন, তোমরা এই দিনে আমার ওপর অধিক পরিমাণে দরুদ পাঠ করো। কেননা তোমাদের দরুদ আমার সম্মুখে পেশ করা হয়ে থাকে (আবু দাউদ, হাদিস : ১০৪৭)।
৮. মসজিদে এসে জিকির, তেলাওয়াত ও ইবাদত ভিন্ন অপ্রয়োজনীয় অন্য কোনো কথা না বলা : হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, নবীজী সা: বলেছেন, জুমার নামাজের খুতবার সময় তুমি যদি তোমার সাথিকে চুপ থাকতে বলো, তবে এটাও তোমার অনর্থক কাজ হবে (বুখারি-হাদিস : ৯০৬)।
৯. বিশেষ করে দোয়ার গুরুত্ব দেয়া : জুমার দিনের গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ একটি আমল হচ্ছে দোয়ার প্রতি মনোনিবেশ করা। জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, জুমার দিনের ১২ ঘণ্টার মধ্যে একটি বিশেষ মুহূর্ত এমন আছে যে, তখন কোনো মুসলমান আল্লাহর নিকট যে দোয়া করবে আল্লাহ তা কবুল করেন (আবু দাউদ, হাদিস : ১০৪৮)। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে আমল করার তাওফিক দান করুন। লেখক : মুহাদ্দিস, জামেয়া রাহমানিয়া দারুল ইসলাম, দক্ষিণ কাজলা, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।