সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৪৯ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::
কোরবানী ঈদে পশু আমদানির কোনো পরিকল্পনা নেই এপ্রিলের ২৬ দিনে ১৬৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স সত্যি না কি গুজব: ফের বিয়ে করছেন শাকিব খান যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে নজিরবিহীন বিক্ষোভ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার সরকারের প্রতিদিনের কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে: ফখরুল গরমে খামারে মরছে মুরগি, কমছে ডিম রোগীর প্রতি চিকিৎসকের অবহেলা বরদাস্ত করা হবে না: স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাতীয় পার্টি কার চাপে নির্বাচনে এসেছে: ওবায়দুল কাদের বিএনপি গরিবের পাশে দাঁড়ায় আর আ’লীগ সরকারি ত্রাণ চুরি করে : ইশরাক কোনো জেলায় তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রির বেশি হলে সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে পারে- শিক্ষামন্ত্রী

ফররুখ আহমদ- মানবতার কবি

আসিফুজ্জামান
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৩

ফররুখ আহমদ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলাধীন মাঝাইল গ্রামে ১৯১৮ সালের ১০ জুন জন্মগ্রহণ করেন। ফররুখ আহমদের পিতা খান সাহেব সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর। গ্রামের পাঠশালাতেই তাঁর শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি। পরবর্তীতে কলকাতার তালতলা মডেল এম ই স্কুলে ভর্তি হন তিনি।
এরপর কলকাতার বিখ্যাত বালিগঞ্জ সরকারি হাই স্কুলে ভর্তি হন। সেই সময়ে কবি গোলাম মোস্তফা ছিলেন এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। প্রাথমিক জীবনে কবিত্ব বিকাশে কবি গোলাম মোস্তফা ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করেন। ১৯৩৭ সালে তিনি খুলনা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তারপর কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ১৯৩৯ সনে আইএ পাস করে তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন ও ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন, কিন্তু পরীক্ষা না দিয়েই কর্মজীবনে প্রবেশ করেন।
ফররুখ আহমদ প্রথমে কলকাতার আইজি প্রিজন অফিস এবং সিভিল সাপ্লাই অফিসে চাকরি করেন। ১৯৪৫ সাল থেকে তিনি মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় সম্পাদনার দায়িত্ব পান এবং ভারত বিভাগের পর ঢাকায় এসে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে যোগ দেন। এখানে তিনি ছোটদের জন্য ‘খেলাঘর’ অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন।
ফররুখ আহমদ ছাত্রাবস্থায় এমএন রায়ের র‌্যাডিক্যাল মানবতাবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বামপন্থী রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু দেশ বিভাগোত্তরকালে তিনি পাকিস্তানি আদর্শ ও মুসলিম রেনেসাঁর সমর্থক হন। কিন্তু দেশ বিভাগের পরও তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা রাখলেও ভাষার প্রশ্নে তিনি ছিলেন অটল ও অবিচল, ফলে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রতি তিনি অকুণ্ঠ সমর্থন দেন।
তিনি তখন ধর্মীয় কুসংস্কার ও পাকিস্তানের অপরিনামদর্শী রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধেও কঠোর হাতে লিখতে শুরু করেন। যে ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বাঙালির মুক্তির বীজ প্রোথিত হয়েছিল- সেই চূড়ান্ত মুক্তির সময়কাল ১৯৭১ সালেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিও তাঁর অনুরূপ সমর্থন ছিল। কবি হিসেবে যদিও ইসলামি চেতনাকে ধারণ করতেন তিনি কিন্তু নিজ মায়ের ভাষা ও জাতির প্রতি ছিল তাঁর অশেষ ভালোবাসা। তিনি ধর্মকে কখনো রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন না। সাম্প্রদায়িকতাকে তিনি কখনো প্রশ্রয় দেননি রাজনীতিবিদদের মতো। বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে কাব্যক্ষেত্রে ফররুখ আহমদের আগমন ঘটে। ১৯৪৪ সালে ২৬ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’ প্রকাশিত হয়। কিশোর অবস্থা থেকেই তিনি কাব্যজগতে প্রবেশ করেন। সে সময়ের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। এবং অতি অল্প সময়ে একজন নবীন কবি হিসেবে তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ওই সময় থেকেই পত্র-পত্রিকায় তাঁর ওপর লেখালেখি শুরু হয় এমনকি কলকাতা রেডিওতে তাঁর ওপর আলোচনা সম্প্রসারিত হয়।
স্বল্পকালের মধ্যেই তিনি একজন অসাধারণ প্রতিভাবান কবি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। ১৯৪৩ সালে বাংলাদেশে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফররুখ আহমদ দুর্ভিক্ষের মর্মন্তুদ দৃশ্য নিয়ে অসংখ্য কবিতা রচনা করেন। ওই সময়ে লেখা তাঁর প্রায় ১৯টি কবিতায় দুর্ভিক্ষের চিত্র ফুটে উঠেছে। দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের হাহাকার, আর্তনাদ, অনাহার ক্লিষ্টের করুণ পরিনতি, সমকালের সংকট, জরাগ্রস্ত বাস্তবতা, সাম্প্রদায়িকতার হিংস্রতা দেখে তিনি আঘাত পান। আর সকল অসঙ্গতিই তাকে সাহিত্য সাধনায় অনুপ্রেরণা যোগায়- নতুন ভাষ্যে তিনি লিখে চলেন যেন এক নতুন স্বপ্নময় জগতের কবিতা।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯৪৪ সালে দুর্ভিক্ষ নিয়ে একটি কবিতার সংকলন প্রকাশ করেন, যার নাম ছিল- আকাল; এতে ফররুখ আহমদের ‘লাশ’ কবিতাটি স্থান পায়। দুর্ভিক্ষ বিষয়ে ফররুখ আহমদের কবিতাটি ছিল সবার থেকে আলাদা, ভিন্ন ধরনের, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ও গভীর আবেদন সৃষ্টিকারী। বলা হয়ে থাকে, দুর্ভিক্ষ বিষয়ে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর মধ্যে ‘লাশ’ কবিতাটি অন্যতম।
চল্লিশের দশকে ইংরেজবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন প্রবলতর হয়। এ সময় পাকিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষে গণজাগরণমূলক কবিতা লিখে ফররুখ আহমদ বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন মুসলিম পুনর্জাগরণে বিশ্বাসী ছিলেন, তাঁকে মুসলিম রেনেসাঁর কবি বলা হয়। তাঁর রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’ সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। মূলত- এ গ্রন্থে ফররুখ আহমদের স্বাধীনতা-প্রীতি ও মানবতাবোধের সুস্পষ্ট বিকাশ ঘটেছে। ফররুখ আহমদ ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ফররুখ আহমদ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
তিনি রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের শিল্পীদের ধর্মঘটে যোগদানে সংগঠিত ও উৎসাহিত করেন এবং সেখানে কর্মরত শিল্পী-আলতাফ মাহমুদসহ অনেকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কবি ফররুখ আহমদ শিল্পী-ধর্মঘটে যোগ দেন। তিনি তদানীন্তন পাকিস্তানি শাসকদের ব্যঙ্গ করে ‘রাজ-রাজরা’ নামে একটি নাটক লেখেন যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিনীত হয়। প্রখ্যাত নাট্যকার মুনীর চৌধুরী তাতে অভিনয় করেন। পরবর্তীতে বেনজীর আহমদ ও আবু জাফর শামসুদ্দীন সম্পাদিত ‘নয়াসড়ক’ সংকলনে প্রকাশিত হয়। গীতি কবিতা, মহাকাব্য, সনেট, গল্প, উপন্যাস, নাটক, সংগীত, প্রবন্ধ, বেতার কথিকা, গীতি-নকশা প্রভৃতি সৃষ্টিশীল রচনায় তিনি নৈপূণ্য প্রদর্শন করেন। কবিতা রচনায় তিনি অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন।
কবিতাতে তিনি যেন ফিরে পেতেন নিজের স্বচ্ছন্দ ছন্দ এবং বলবার চিরায়ত ভাষা। কবিতায় তিনি আধুনিক ভাষা ব্যবহারে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন, ফলে তাঁর কবিতা কখনো সাধারণের কাছে দুর্বোধ্য ছিল না- তাঁর কবিতা ছিল সুপঠিত ও অর্থবোধকতায় প্রাঞ্জল রূপের। গদ্য কবিতা রচনায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত সিদ্ধহস্ত। ফররুখের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ছিল- ১৫টি। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ যথাক্রমে- সাত সাগরের মাঝি, সিরাজম মুনীরা, নৌফেল ও হাতেম, হে বন্য স্বপ্নেরা, ইকবালের নির্বাচিত কবিতা, কাফেলা, দিলরুবা, অনুস্বার।
কবিতার পাশাপাশি তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য ছড়া-কবিতা রচনা করেন। এসব শিশু-কিশোর পাঠ্য ছড়া-কবিতাও বেশ প্রিয় শিশুদের নিকট। তাঁর উল্লেখযোগ্য শিশু-কিশোর রচনা গ্রন্থের নাম- পাখির বাসা, হরফের ছড়া, নতুন লেখা, ছড়ার আসর, চিড়িয়াখানা, কিস্্সা কাহিনি। এ ছড়া কবি ফররুখ আহমদ বেশ কিছু স্বার্থক গল্প লিখেছেন। তাঁর লেখা দুটি সুপরিচিত গল্প যথাক্রমে- ‘প্রচ্ছন্ন নায়িকা’ ও ‘মৃত বসুধা’।
পরবর্তীকালে ফররুখের গল্পসমূহ ‘ফররুখ আহমদের গল্প’ নামে কবি-অধ্যাপক ও জীবনানন্দ গবেষক আব্দুল মান্নান সৈয়দ-এর সম্পাদনায় গ্রন্থরূপ পায়। এ ছাড়া তিনি ‘সিকান্দার শার ঘোড়া’ নামের একটি উপন্যাস লিখতে শুরু করেন কিন্তু তা অসমাপ্তই রয়ে যায়- কেননা মৃত্যু তাঁকে কেড়ে নেয়। ব্যঙ্গ কবিতা রচনার ক্ষেত্রে কবি ফররুখ বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেন। স্বনামেও তিনি প্রচুর ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছেন। সাহিত্য কর্মের স্বীকৃতিতে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আদমজী পুরস্কারসহ বেশ কয়েকটি পুরস্কারে ভূষিত হন। বাংলা কাব্য সাহিত্যের জগতে কবি ফররুখ আহমদ এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর অমর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com